মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
অনেকদিন পর নতুন ক’রে খোকার আবার মনে হ’লো কারো জন্যে মন খারাপ করার এই বিশ্রী ব্যাপারটা না থাকলে দুনিয়াটা সত্যিই একেবারে ফিকে পানসে হ’য়ে যেত, এই এখন যেমন রঞ্জুর জন্যে তার ভারি খারাপ লাগছে। সে যখন বের হয় তখন মুখ আঁধার ছিলো রঞ্জুর। না, রেক্সে যাওয়া চলবে না। ইদানীং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন, ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র, আইনগত কাঠামো, চীনের চাবি ভুট্টোর খেল- তামাশা, এইসব নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠছে ওখানে। আর আহামরি এক লেখক পেয়েছে গোরভিদাল, তাই নিয়েও কতো মতবিনিময়ের ছড়াছড়ি; এক একটা নিরেট মাল সব।
বরং নীলাভাবী অনেক ভালো। কথার প্যাঁচে ফেলে একে অপরকে অহেতুক হেনস্থা করার কোনো অপপ্রয়াসই নেই ওখানে। আড্ডা আর তর্কের মুখোশ এঁটে বন্ধুরা যখন মাঝে মাঝে হীন মনোবৃত্তির আশ্রয় নিয়ে একে অপরের নামে কাদা ছোড়াছুড়ি করে, জারিজুরি ফাঁসের ব্যাপারে পরস্পর নোংরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়, তখন তার মন বিশ্রীরকম তেতো হয়ে যায়। নীলাভাবীর ওখানে আর যাই হোক এইসব কদর্য ব্যাপারের মুখোমুখি হ’তে হয় না তাকে; কখনো কুঁজো বামন অঞ্চারের মতো টিন ডাম বাজায় না কেউ, বরং ‘ঘুমের ভিতর বালকের পেচ্ছাবের মতো’ অলক্ষ্যে সময় কেটে যায়।
শোরগোল,–হ্যাঁ, একটা শোরগোল ক্রমশ জোরালো হ’য়ে অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়ছে বাতাসে। খোকা কান পাতলো, দ্রুত ফুঁসে উঠছে হৈহল্লা, একটা মিছিল রায়ের বাজারের দিক থেকে ক্রুদ্ধ অজগরের মতো এঁকেবেঁকে সদর রাস্তায় উঠে ই. পি. আর-এর দিকে এগিয়ে চলেছে; কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে ঢাকা শহর, কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানুষ, কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে লোহার রড, কালো পতাকা, বর্শা, তরোয়াল, বৈঠা, কোদাল, শাবল, কাঁধে নিয়েছে যে যা পেরেছে। কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে যাবতীয় দৃশ্যপট, বদলে যাচ্ছে মুখের আদল, দ্রুত দ্রুত, দ্রুত এবং ধাবমান, গ্রেসিয়ারের মতো ধাবমান; দুর্মদ মৃত্যুর মতো দরগলমান গ্রেসিয়ার। মানুষ! মানুষ!
মানুষ আর মানুষ! ‘আকাশে আকাশে ধ্রুব- তারায়, কারা অলক্ষ্যে পথ মাড়ায়’-গা ছমছম করতে থাকে খোকার। কবিতার একটি পুরোনো পঙক্তি, অথচ আজ কেন যেন সর্বাঙ্গ শির শির ক’রে উঠলো, একটা অভূতপূর্ব অপ্রত্যাশিত রোমাঞ্চের ঝাপটা লাগলো তার সর্বাঙ্গে। বাঁধভাঙা বন্যার তুমুল জলস্রোতের মতো অবিরাম অবিশ্রান্ত মানুষ; শস্যক্ষেত খামার উইঢিবি বাঁশঝাড় সাঁকো শহর-বন্দর- গণিকালয় সবকিছু সেই অপ্রতিরোধ্য জলরাশির বিমর্দিত তোড়ের মুখে অকাতরে ভেসে চলেছে। এ কোন্ নূহের প্লাবন, ভিতরে ভিতরে খোকা টাল খায়, তার মাথা দপ দপ করে।
Leave a Reply