শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:৩০ পূর্বাহ্ন

ভারতের নির্বাচনে নকল ভিডিও এবং মিথ্যাচার

  • Update Time : শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ৮.৪১ পিএম

সারাক্ষণ ডেস্ক

গত বছরের নবেম্বরে মরলিকৃষ্ণন চিন্নাদুরাই যুক্তরাজ্যে এক তামিলভাসী অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার অবলোকন করার সময় কিছু কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি লক্ষ্য করেন।

তামিল টাইগার জঙ্গী প্রধান ভিলুপিল্লাই প্রভাকরণের কন্যা দুয়ারকা নামে পরিচিত করানো এক মহিলা এক ভাষণ দিচ্ছিলেন। সমস্যাটি ছিল, দুয়ারকা এক দশকেরও বেশী সময় আগে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের শেষ সময়ে ২০০৯ সালে এক বিমান হামলায় নিহত হয়েছিলেন। তার মরদেহ আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। তখন তাঁর বয়স ছিল ২৩ বছর। আর এখন তিনি এখানে দৃশ্যত মধ্যবয়সে বিশ্বের তামিলগণকে তাদের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংগ্রামে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানাচ্ছেন।

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় তামিল নাড়ু রাজ্যের ফ্যাক্ট চেকার মিঃ চিন্নাদুরাই ভিডিওটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষ্য করেন এবং তাকে আর্টিফিসিয়েল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) সাহায়্যে উদ্ভাবিত এক ব্যক্তি হিসাবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেন। মিঃ চিন্নাদুরাইযের কাছে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো স্পষ্ট হয়ে যায়: “এটি রাজ্যে (তামিল নাড়ু) এক আবেগঘন ইস্যু, আর নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় মিথ্যা তথ্যও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।”

ভারতে নির্বাচল চলার সময় এআই-উদ্ভাবিত সামগ্রীর বিশাল সম্ভার বর্জন করা অসম্ভব। ভারতের বেশ কয়েকটি ভাষায় প্রকাশিত ক্যাম্পেইন ভিডিও, পারসন্যালাইজড অডিও মেসেজ এবং এমনকি কোন প্রার্থীর কণ্ঠে ভোটারদে উদ্দেশ্যে যন্ত্রায়িত আহ্বান সবই তখন তৈরি করা হয়। শাহিদ শেখের মত কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা এআই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ভারতের রাজনীতিকদের অবতারের বেশে দেখিয়ে কৌতুক পর্যন্ত করেছেন। আমরা এর আগে তাঁদের অ্যাথলেজার পরতে, গান-বাজনা ও নাচ করতে দেখি নি। কিন্তু যন্ত্রপাতি আরও আধুনিক হতে থাকায় যখন তা ভুয়া খবর সত্যি খররের মত মনে হতে দেখাতে থাকবে তখন এর প্রভাব কিরূপ দাঁড়াবে তা ভেবে বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত।

দেশটির সাবেক নির্বাচন কমিশনার এসওয়াই কুরেশী বলেন, “গুজব রটানো সব সমযেই নির্বাচনী প্রচারণাই অংশ। (কিন্তু) সামাজিক মাধ্যমের যুগে এটি দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে পারে।” “আসলে এটি দেশে আগুন লাগিয়ে দিতে পারে।” ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোই এআইয়ের সাম্প্রতিক উন্নয়নের সুযোগ নিচ্ছে বিশ্বের এমন প্রথম দল নয়। ঠিক সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানে এআই কারারুদ্ধ রাজনীতিক ইমরান খানকে এক সমাবেশে ভাষণ দানের সুযোগ করে দেয়।

খোদ ভারতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও প্রচার-অভিযানে উদ্ভাবনশীল প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার এরই মধ্যে করেছেন। তিনি হিন্দিতে এক সমাবেশে ভাষণ দেন এবং তা সরকার-আবিষ্কৃত এআই যন্ত্র ভাষিনী ব্যবহার করে ঠিক সময়েই তামিল ভাষায় অনুবাদ করা হয়। কিন্তু শব্দ ও ভাবকে ইচ্ছামাফিক বদলাতেও এআইকে কাজে লাগানো যেতে পারে।

গত মাসে দুইটি ভাইরাল ভিডিওতে বলিউড তারকা রণবীর সিং ও আমির খানকে বিরোধী দল কংগ্রেস দলের পক্ষে প্রচার চালাতে দেখানো হয়। তাঁদের ছবি ভুয়ো ছিল এবং তাঁদের সম্মতি ছাড়াই তৈরি করা হয়েছিল বলে তাঁরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। তারপর ২৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর সহ ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতাদের ভাষণ বিকৃত করার জন্য এআই ব্যবহৃত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।পরদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ভিডিও নকল করার ব্যাপারে দু’ ব্যক্তিকে- একজনকে বিরোধী দল আম আদমি পাটি (আপ) ও অন্যজনকে কংগ্রেস পার্টি হতে- গ্রেপ্তার করা হয়।

মিঃ মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিও দেশের বিরোধী নেতাদের কাছ থেকে অনুরূপ অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। ড্যাটা ও নিরাপত্তা গবেষক শ্রীনিবাস কোদালির মতে, যার মানে “যদি আপনি কোন অন্যায় করার সময় ধরা পড়েন, বেশির পক্ষে আপনার হাতে একটি চড় দেওয়া হতে পারে”। নির্মাতারা জানান যে, নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তাঁরা কোন্ ধরনের কাজ করবেন বা না করবেন তা ঠিক করতে তাঁদেরকে তাঁদের ব্যক্তিগত নৈতিক জ্ঞানের উপর নির্ভর করতে হয়।

রাজনীতিকরা যেসব অনুরোধ করে থাকেন সেগুলোর মধ্যে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের খ্যাতি বিনষ্ট করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের পর্নোগ্রাফিক ছবি এবং বিকৃত ভিডিও ও অডিও তৈরির অনুরোধ।দিব্যেন্দ্র সিং জাদুন বলেন, “আমাকে একবার মূল ভিডিওকে নকল ভিডিওর মত করে দেখাতে বলা হল, কারণ মূল ভিডিওটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে রাজনীতিককে খারাপ দেখাবে।কাজেই তাঁর টিম চাইল আমি যেন এক নকল ভিডিও তৈরি করি যাতে মূল ভিডিওগুলো চাপা পড়ে যায়।

দি ইন্ডিয়ান ডিপফেকার-এর (টিআইডি) প্রতিষ্ঠাতা মিঃ জাদুন কেউ কিছু তৈরি করলে তার উপর ডিসক্লেমার লাগিয়ে দেওয়ার উপর জোর দেন যাতে তা যে আসল নয় সেটি স্পষ্ট হয়ে যায়। টিআইডি ভারতীয় রাজনীতিকদের প্রচার সামগ্রী বানানোর জন্য লোকজনকে ওপেন সোর্স এআই সফটওয়ার ব্যবহারে সহায়তা করার যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে। তবুও অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। মিঃ শেখ তাঁর কাজের ফলাফলকে সামাজিক মাধ্যমে রাজনীতিকদের দিয়ে বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠায় অনুমতি বা সৌজন্য প্রকাশ করা ছাড়াই ব্যবহৃত হতে দেখেছেন। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় পশ্চিম বঙ্গে এক মার্কেটিং এজেন্সিতে কাজ করছেন।

“এক রাজনীতিক আমার তৈরি মিঃ মোদির ছবি অপ্রাসঙ্গিকভাবে এবং এটি যে এআইকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে সেকথা উল্লেখ না করেই ব্যবহার করেছেন। আর এখন কোন নকল ছবি তৈরি করা এতই সহজ যে, যে-কেউই তা করতে পারেন।মিঃ জাদুন ব্যাখ্যা করে বলেন, “যা তৈরি করতে আমাদের সাত বা আট দিন লাগত, তা এখন তিন মিনিটে করা যায়। আপনার শুধু একটি কম্পিউটার লাগবে।” বস্তুত দু’ ব্যক্তির মধ্যে ভুয়ো ফোন কল তৈরি করা ঠিক কত যে সহজ বিবিসি তা প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য করেছে। এ দু’ ব্যক্তি ছিলাম আমি ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এআই ব্যবহারে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ভারত এআই নিয়ে কোন আইন তৈরির কথা বিবেচনা করছে না বলে প্রথমে জানিয়েছিল। তবে ” মোদী কি ফ্যাসিষ্ট”? প্রশ্নের প্রতি গুগল’স জেমিনি চ্যাটবটের জবাবকে নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেওয়ার পর চলতি মার্চ মাসে সরকার সক্রিয় হয়ে উঠে।

দেশটির জুনিয়র তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর বলেন, এটি দেশের আইটি আইন লঙ্ঘন করেছে। তখন থেকে ভারত সরকার “অনির্ভরযোগ্য” বা “আন্ডার-টেস্টেড” জেনেরেটিভ এআই মডেল বা টুল প্রকাশ্যে বের করার আগে সরকারের সুনির্দিষ্ট অনুমতি নিতে টেক কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। সরকার “নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সৎ ভাবমূর্তির প্রতি হুমকির সৃষ্টি করে”-এসব টুল থেকে যাতে এমন জবাব দেওয়ার বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ারি

দিয়েছে। কিন্তু এটিই যথেষ্ট নয়। ফ্যাক্ট-চেকাররা বলেন, এরূপ কন্টেন্টের মিথ্যাচার উন্মোচন করার কাজ চালিয়ে যাওয়া- বিশেষত নির্বাচনকালে যখন ভুয়ো খবর ছড়ানো তুঙ্গে পৌঁছে তখন সেই কাজ চালিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য।তামিল নাড়ুর এক মিডিয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থার পরিচালক মিঃ চিন্নাদুরাই বলেন, “তথ্য ঘন্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে দৌড়ায়। আর আমরা মিথ্যা-উন্মোচিত যে তথ্য বিতরণ করি তা ঘন্টায় ২০ কিলোমিটার যাবে।”আর এসব মিথ্যা খবর মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মধ্যেও পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করছে বলে মিঃ কোদালি উল্লেখ করেন। তা সত্ত্বেও “নির্বাচন কমিশন এআই নিয়ে প্রকাশ্যে নীরব”।

মিঃ কোদালি বলেন, “সাধারণভাবে কোন নিয়ম-কানুন নেই। তারা বাস্তব বিধিবিধান নিয়ে এগিয়ে আসার বদলে টেক ইন্ডাস্ট্রিকে নিজেকে দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হতে দিচ্ছে।”কোন অব্যর্থ সমাধান চোখে পড়ছে না বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। “কিন্তু (এখনকার মত) মিথ্যা খবর পরিবেশন করছে এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে, তা যাচাই করা হয় নি এমন খবর যারা ছড়াচ্ছে তাদের মনে ভয়ের সৃষ্টি করতে পারে” বলে মিঃ কুরেশির মন্তব্য।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024