শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১০:২০ পূর্বাহ্ন

আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনালড ‘লূ বাংলাদেশ সফর: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের বাতাবরণ

  • Update Time : শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ১১.৫৯ পিএম

মো: আব্দুল হান্নান 

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-এশিয়া বিষয়ক সহকারী  পররাষ্ট্রমন্ত্রী  ডোনালড ‘লূ  তার ত্রিদেশীয় সফরের অংশ হিসাবে ভারত ও  শ্রীলঙ্কার পর গত ১৪-১৫ মে (২০২৪) বাংলাদেশ সফর করে। বিগত  ১৭ মাসে, এটি ছিল তার তৃতীয় সফর। জনাব লূ, তার সফর উপলক্ষে  প্রচার মাধ্যমকে অকপটেই বলেছে,বাংলাদেশের সাথে সাম্প্রতিক সময়ের যে ‘টেনশন’ ছিল, সেদিকে না তাকিয়ে, ‘আস্থা পুনস্থাপনের’  মাধ্যমে সামনের দিকে  এগিয়ে যেতে হবে।  নিঃসন্দেহে, যুক্তরাষ্ট্রে পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোনয়নে এক সবিশেষ ইতিবাচক উদ্যোগ ।

ডোনালড যখন গত জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্বালে বাংলাদেশ সফরে আসে তখন তার বার্তা ছিল অন্যরকম, আগ্রাসী, এক ধরনের চাপ-প্রয়োগমুখী। নির্বাচনে তথাকথিত ‘সম্ভাব্য অনিয়ম ও প্রভাববিস্তার’ এবং ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ প্রশ্নে আমেরিকার ভিসা নিষেধাজ্ঞার খোলামেলা হুমকি। এই নেতিবাচক প্রেক্ষাপটে, বর্তমান সফরকে মনে  হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন  প্রেরিত  বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে (নির্বাচনোত্তর ) প্রতিফলিত বিষয় – বাংলাদেশ সরকারের সাথে সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ইচ্ছা বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে,  দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক বিষয়ে সমঝোতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ইতিবাচক আলোচনা এবং প্রক্রিয়া শুরু করা।

উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠিতে, বাংলাদেশের সরকারের সাথে, অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন ,বাণিজ্য ও  বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর ভিত্তিক কৌশলগত  বিষয়ে আমেরিকার সহযোগিতা এবং অংশিদারীত্ত্বের চলমানতার সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি ছিল। এবিষয়ে, ইতিবাচক  কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে  ডোনালড  ‘লূ  এর সফর, কোন রাজনৈতিক নেতিবাচক বিষয়  বা চাপকে  ছাপিয়ে, অত্যন্ত আগ্রহোদ্দিপক, এবং খোলামেলা  হওয়ায়  রাজনৈতিক, সুশীল সমাজ  এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে ।

ডোনালড লূ এর খোলামেলা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত পাওয়া যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী,  পরিবেশ ও  জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী,  প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টার সাথে বৈঠক এবং দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকার থেকে। বিশেষকরে, বাংলাদেশের প্রাধিকারের বিষয়সমূহ যেমন,  র‍্যাবের  উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আমেরিকার সরকারের আপত্তি নাই(যদিও বিষয়টি জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের প্রক্রিয়াধীন); বিচার বহির্ভূত হত্যার সংখ্যা অবনমনে সন্তোষ প্রকাশ; বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে “জিএসপি সুবিধা”(রপ্তানি বাণিজ্যে অগ্রাধিকার বিষয়ক প্রণোদনা) বিষয়ক জটিলতা নিরসনের ইঙ্গিত দেয়াসহ বিশেষকরে  বাংলাদেশকে বিদ্যমান আর্থিক খাতের অস্বস্তিতে, আমেরিকার ইন্টারনেশানেল ডেভেলপমেন্ট ফিনেন্স কর্পোরেশন (ডিএফসি ) এর সহায়তা প্রদানের বিষয়সমূহ বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

অধিকন্তু, সরকারের মন্ত্রিপর্যায়ের আলোচনায়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিস্তৃত এবং দৃঢ়করনে, বাংলাদেশকে  উন্নয়নশীল দেশ থেকে  সহজ ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে উত্তরণের  রূপান্তর-প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকারভিত্তিক বাণিজ্য প্রণোদনা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি; ৪০টি আইটি ভিলেজে বিনিয়োগ;আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম; ছাত্র ভর্তির সুযোগ বৃদ্ধি; ‘ফ্রি রিয়েল টাইম ডেটা ফর সাউথ-এশিয়া’  কার্যক্রমের  সাথে বাংলাদেশকে সম্পৃক্তকরন এবং ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়নে সংস্কার  বিষয়সমুহে অত্যন্ত ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়। বিশেষ করে, ফ্রি রিয়েল টাইম ডেটা,  বাংলাদেশের গুরুত্তপুর্ন স্বার্থে যেমন – দুর্যোগ, বন্যা, দূষণ, সমুদ্রের উচ্চতা পর্যবেক্ষনে অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তি হস্তান্তর, সক্ষমতা অর্জন, স্মার্ট কৃষি, সবুজ এবং জলবায়ু প্রযুক্তি বিষয়ে  দু’দশের মধ্যে সহযোগিতার আশাবাদ বেড়েছে। এ সকল বিষয়ে, ওয়ার্কিং-গ্রুপ  প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সহযোগিতার কার্যকর উদ্যোগের  পরামর্শ এসেছে।

ডোনালড লূ,  দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে, আমেরিকার বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ স্থানান্তরের সমস্যা তুলে ধরলে বাংলাদেশ বলেছে এটি সাময়িক ।  সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক অস্বস্তির কারনে, তা  কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে, তবে বন্ধ হয়ে যায়নি।  বাংলাদেশ শ্রম আইন সংস্কার  বিষয়ে –  ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং  অধিকারের  বিষয়গুলি নিয়ে ‘লূ কে বিস্তারিত অবহিত করে।  বিশেষকরে অবহিত করে সরকার ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মধ্যকার বিস্তারিত আলোচনা ও তার অগ্রগতি। বাংলাদেশ সরকারও এ বিষয়য়ে বেশ তৎপর।  কেননা, আমেরিকার ইন্টারনেশানেল ডেভেলপমেন্ট ফিনেন্স কর্পোরেশন (ডিএফসি) থেকে অর্থ প্রাপ্তি, বিদেশি বিনিয়োগ, বিশেষকরে বাণিজ্যে বাজার সুবিধা প্রাপ্তিতে ( ইউ ‘তে জিএসপি প্লাস ) এবিষয়ে  সন্তোষজনক  অগ্রগতি দরকার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে চাপপ্রদানে   আমেরিকার সহায়তার  প্রশ্নে, ডোনালড লূ,  ইতিবাচক হলেও – মিয়ানমারে এখন নিরাপত্তা নেই, তাই প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হবে বলে জানায়।

ডোনালড লূ, আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের বাসায়, বিরোধী রাজনৈতিক দল ব্যতিরেকে,  নাগরিক সমাজের প্রধিনিধি, শ্রমিক নেতৃবৃন্দ সহ অনেকের সাথে বৈঠক করে। প্রচার মাধ্যম থেকে জানা যায় – মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা,  রাজনৈতিক স্পেইস, প্যালেস্টাইন ক্রাইসিস নিয়ে আলোচনা হয়। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা গাজায় পালেস্তাইনিদের উপর ইসরাইলের  নির্মম অত্যাচার, গণহত্যা এবং আমেরিকার নীতির কঠোর সমালোচনা করে। এবং, বাংলাদেশে  রাজনৈতিক স্পেইস সংকুচিত হওয়া অব্যাহত আছে বলে জানায়।

এ সফরের একটি বিশেষ দিক – যে ডোনালড লূ বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকার, অবাধ প্রচার মাধ্যম, ভিসা নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে, গত জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সফরকালে এতো সোচ্চার  ছিল, এবার সে কোন রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠকই  করেনি। স্বেচ্ছায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে দূরে থাকা বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিও বলেছে, ডোনালড লূ  এর সাথে সাক্ষাৎ না হওয়ায়  তাদের কিছু যায় আসে না । বিষয়টি বেশ কৌতুহলোদ্দীপক।

প্রসঙ্গত, একইভাবে নির্বাচন প্রাক্বালে ঢাকাস্থ আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশের নির্বাচন অনুষ্ঠান বিষয়ক সরব কার্যক্রম ও তৎপরবর্তিতে হঠাৎ করে শ্রীলঙ্কায় অবকাশ ছুটিতে যাওয়া অনেক কৌতূহলের জন্ম দিয়েছিল। নির্বাচন পরবর্তিতে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চিঠিতে সরকারের সাথে অংশীদারিত্ত্বের ভিত্তিতে সম্পর্কোন্নয়ন চলমান রাখার অভিপ্রায়, ইতোমধ্যে ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতের বদলি, এবং ডোনালড লূ এর বাংলাদেশের সাথে  আস্থা পুনস্থাপনেরঅকপট অভিব্যক্তি  রাজনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয়সমূহের ঊর্ধ্বে উঠে, নূতন করে বিস্তৃত পরিসরে বাংলাদেশের সাথে ইতিবাচক পররাষ্ট্র নীতি প্রতিপালনেরই ইঙ্গিত বহন করে। যদিও, ঢাকাস্থ আমেরিকা দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ডোনালড লূ এর  সফর প্রাক্বালে প্রেস ব্রিফিং এ বলেছিল – ওয়াশিংটন দেখতে চায়     “ বাংলাদেশ এজ এ নেট সিকিউরিটি প্রভাইডার ”  কিন্তু ডোনালড লূ  নিরাপত্তা বিষয়ক কোন বিষয়ে কোন চাপ প্রয়োগ করেনি। তবে, আমেরিকার বিশেষ বিবচনায় ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর কেন্দ্রিক কৌশলগত বিষয়টি প্রাধান্যের মধ্যেই থাকবে। কেননা, বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে  কৌশলগত এক বিশেষ অবস্থানে আছে।

অনুমিত হচ্ছে, আমেরিকা অন্তঃদৃষ্টিমূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ‘কঠিন বিষয়’ ( যেমন মানবাধিকার ) বিশেষকরে রাজনৈতিক  ইস্যু  নিয়ে কোন চাপ বা প্রভাব কোন কাজে আসবেনা। হতেও পারে, বাংলাদেশের রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের নৈর্বিক্তিক বিশ্লেষণে বর্তমান সরকারকেই মূলধারার গণতান্ত্রিক শক্তি  এবং দেশ ও জনগণের  সার্বিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের ধারবাহিকতাকে অপরিহার্য মনে করেছে। ধারাবাহিকভাবে স্বেচ্ছায় নির্বাচন-বর্জনকারী বিরোধী-শক্তি (সাম্প্রদায়িক শক্তির জোটবদ্ধ ) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংহত করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে না। এবং,বর্তমান নেতৃত্বের মাধ্যমেই বাংলাদেশ রূপকল্প ভিত্তিক উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত হবে।

অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে, আমেরিকা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে, একসাথে, আগামীর উন্নত বাংলাদেশের অভিযাত্রায় অংশীদারিত্ব চাইবে। কেননা, বাংলাদেশের সংবিধানের মূলমন্ত্র, স্বাধীনতার মূল্যবোধ এবং  নেতৃত্বের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়ের সাথে আমেরিকার নেতৃত্বের কোন দ্বিধা এবং সংঘাত নেই। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগর-কেন্দ্রিক ভু-কৌশলগত প্রতিযোগিতায়,  বাংলাদেশ কোন সামরিক সহযোগিতার বলয়ে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভূমিকায়  জড়াতে পারেনা। কারণ, তাতে  বাংলাদেশের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে। এর বাইরে,  বাংলাদেশ, আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাস,অপরাধ, চোরাচালান, সাপ্লাই-চেইন বিষয়ে – স্বচ্ছতা ও অন্তর্ভর্তিমুলক সহযোগিতা, বিশেষ করে ব্লু-ইকনমি ভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপক্ষিক সহযোগিতাকে হয়ত স্বাগত জানাবে। এবিষয়টি, বাংলাদেশ তার  ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলোক ” এ  পরিষ্কারভাবে বর্ননা করেছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক-ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের  দক্ষিণ এশিয়া  ইন্সিটিউটের  পরিচালক  মিখায়েল কুগেলমেন  বিগত নির্বাচনের প্রাক্বালে, আমেরিকা,  ভুরাজনৈতিক বাস্তবতায়, রাজনৈতিক ও মানবাধিকার  বিষয়ের চেয়ে,   আঞ্চলিক নিরাপত্তার   বিষয়টি  প্রাধান্য দিয়ে তার  নীতিতে পরিবর্তনের কথা বলেছে। কুগেলমেন, সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে হোয়াট’স নেক্সট ফর ইউএস পলিসি ইন বাংলাদেশ ? ঃ ডেইলি স্টার- জানুয়ারী ১৬,২০২৪ চীন ও  রাশিয়ার সাথে ভুরাজনৈতিক  প্রতিযোগিতার বাস্তবতায়  কূটনৈতিক স্পেইস”  এর  প্রয়োজনীতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। এমনকি কুগেলমেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উল্লম্ফন এবং উদীয়মান বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উচ্চতর অবস্থানে তুলে ধরেছে [ শ্রীরাধা দত্ত সম্পাদিত বই (২০২৪) ঃ বাংলাদেশ অন এ নিউ জার্নি ঃ মুভিং  বিয়নড  দ্য  রিজিওনাল আইডিনটিটি)। এ উল্লম্ফনে, বাংলাদেশের নেতৃত্বের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে।

ইউএস ইন্সটিটিইউট অব পিস এর বিশেষজ্ঞ এবং ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টার ইন ওয়াশিংটন এর ফেলো নিলান্থি সামারানায়েকও বলেছে ( এপ্রিল ২০২৪) আমেরিকা বাংলাদেশ নিয়ে নির্বাচনের আগে উত্তাপ ছড়িয়েছিল, কিন্তু  এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ককে অভিনিবেষ সহকারে এগিয়ে নিতে চায় (ডেইলি স্টার ঃ এপ্রিল ১৩, ২০২৪)।বিশেষভাবে উল্লেখ্য, আমেরিকা তার পররাষ্ট্র নীতি প্রণয়ন ও প্রতিপালনে নাগরিক সমাজ এবং থিংক-ট্যাঙ্ক এর বিশ্লেষণ ও মতামতকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। এতে, একধরনের পরম্পরা খুঁজে পাওয়া যায়।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বাংলাদেশও আমেরিকার সাথে দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ককে অধিকতর গুরুত্ব সাথে বিবেচনা করে। কেননা, আমেরিকা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ; প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের প্রধান উৎস; বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রধান আর্থিক-অনুদান প্রদানকারী । মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হয়েও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীর ক্ষমতায়ন, গণতন্ত্র, এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি আমেরিকা-বাংলাদেশের সহজাত সুসম্পর্কের সোপান। উপরন্ত, অর্থনৈতিক খাতেকে শক্তিশালী, বহুমুখীকরণ, আধুনিকায়ন  ও টেকসই করতে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় উল্লিখিত বিষয়ে সহযোগিতার যে সম্ভাবনা ও  আশ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছে তা বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে অধিকতর প্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করবে। নিশ্চিতভাবে, বাংলাদেশ ও আমেরিকা যদি উল্লিখিত বিষয়ে ইতিবাচক এবং ভবিষ্যতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, স্বল্প সময়ের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা দুদেশের সম্পর্কে  গুনগত পরিবর্তন আনবে।

এ প্রেক্ষিতে, স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এ সম্পর্ক কি বাংলাদেশ অনুসৃত ভারসাম্যপুর্ন পররাষ্ট্রনীতিতে কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে ?  ভারসাম্য যেহেতু আপেক্ষিক এবং কোন সংখ্যার পরিমাপে বিচার করা যাবে না, সেহেতু বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং নিজস্ব প্রাধিকারের বিবর্তনের ধারায় কিছুটা পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন লাগবেই। বাংলাদেশের নিজের প্রয়োজনে, বিশেষকরে বিনিয়োগ, শিক্ষা-প্রযুক্তি, সক্ষমতা-বৃদ্ধি, জনশক্তির উন্নয়ন,ব্যক্তিখাতের উন্নয়ন, অর্থনীতির বহুমুখীকরণ ও মানোন্নয়ন, উদভাবন ইত্যাদি বিষয়ে সকল উন্নয়ন সহযোগীর সহায়্তা ও অংশীদারিত্ব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং জরুরী । বাংলাদেশ তার সকল বন্ধু দেশ ও  উন্নয়ন সহযোগিদের সাভাবিকভাই গুরুত্ব প্রদান করবে এবং স্বাগত জানাবে।  কেননা, বাংলাদেশ অফুরন্ত প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ নয়। বাংলাদেশ শিল্পায়ন ও বাণিজ্য প্রসারে কাঁচামাল আমদানিনির্ভর ও পণ্য রপ্তানিমুখী  দেশ। ভু-কৌশলগত প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, মাহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন  ইত্যাদি বরাবরই  বাংলাদেশকে প্রত্যক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সকল  চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা  করে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে এবং হবে।

ডোনালড লূ, তার সফরকালে দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোতে সাক্ষাতকালে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে অর্থনীতির বহুমুখীকরণে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলেছে, “ আমরা আমাদের সহযোগীদের তারা কাকে পছন্দ করবে  সে বিষয়ে কিছু বলিনা” ।  কাজাকস্তানে রাষ্ট্রদূত হিসাবে অবস্থানকালের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, সেখানে বিনিয়োগ খাতে চীন সহ পশিমা দেশসমূহ ইতিবাচক প্রতিযোগিতা করছে  । এবং বাংলাদেশে আমেরিকা প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে সম্পৃক্ত হতে চায়। বলেছে, আমেরিকা বাংলাদেশকে  নিজের চোখ দিয়ে দেখে  – যা অংশীদারিত্ব, বাংলাদেশের স্বকীয়তা, কুটনৈতিক সফলতা ও সক্ষমতা  এবং মর্যাদার নামান্তর।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে, বাংলাদেশ রূপকল্পঃ ২০৪১ নিয়ে এগুচ্ছে। বাংলাদেশকে এ প্রক্রিয়ায় দরকার অর্থনীতির বহুমুখীকরণ, আধুনিকায়ন,প্রযুক্তির অভিযোজন, এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন। ডোনালড লূ তার সফরে, বাংলাদেশের এ চেলেঞ্জিং অভিযাত্রায়,  কঠিন বিষয়গুলি ” (যেমনঃ মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন) নিয়ে ‘ কাজ করতে হলে ইতিবাচক সহযোগিতার উপর ভর করেই এগিয়ে যাওয়ারঅভিপ্রায়’ ব্যক্ত করেছে। বলেছে “ আস্থা ”  ফিরিয়ে আনতে হবে। এ প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে গতি দিতে হলে,  বিশেষ বিবেচনায় জরুরিভিত্তিতে র‍্যবের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং বাণিজ্য রপ্তানিতে জিএসপি  সুবিধা জটিলতা দুর করে, আমেরিকা সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ করতে পারে। অদূর ভবিষৎতে, দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সুদূরপ্রসারী উচ্চ মাত্রায় উন্নীত করবে।

সার্বিক বিশ্লেষণে, নিঃসন্দেহে ডোনালড লূ এর বাংলাদেশ সফর আমেরিকার পক্ষ থেকে বিশেষ ইতিবাচক বার্তা বয়ে এনেছে। বাংলাদেশকে নিয়ে আমেরিকার বর্তমান মূল্যায়ন সরকার, সুশীল-সমাজ, সর্বস্তরের সচেতন জনগোষ্ঠীকে আশাবাদী করবে। নিঃসন্দেহে, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির এ পরিবর্তিত  ইতিবাচক ইঙ্গিত  বাংলাদেশের ভারসাম্যপুর্ন পররাষ্ট্র নীতির বহুমাত্রিকতাকেই সমৃদ্ধ করবে। তবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক মহল নিশ্চয়ই আমেরিকার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে, দেশের মৌলিক স্বার্থকে সমুন্নত রেখে, বাস্তবতার নিরিখে সার্বিক সকল বিষয়সমূহ তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রাধিকার ভিত্তিতে  একটি  ভবিষ্যতমুখী,  ইতিবাচক, ভারসাম্যপুর্ন পথ-নক্সার ভিত্তিতে এগুবে।

লেখক: মোঃ আব্দুল হান্নান, বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ও সচিব।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024