সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ১১:৫৮ পূর্বাহ্ন

ঐতিহ্য ও ভিন্ন স্বাদের চুইঝাল

  • Update Time : রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ১.২১ পিএম

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের দক্ষিনের বিভাগ খুলনা। আর খুলনার কথা উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নয়ন জুড়ানো সুন্দরবন আর দারুণ স্বাদের চিংড়ি। তবে বাইরে থেকে কেউ এই শহরে এলে এসবের বাইরে যে জিনিসের খোঁজ সবচেয়ে বেশি করেন আর তা হলো ঐতিহ্যবাহী খাবার চুইঝাল।

চুইঝাল হলো মসলা জাতীয় ফসল । চুইঝাল গাছ দেখতে অনেক টা পানের লতার মতো। পাতা লম্বা ও পুরু হয়ে থাকে । পাতায় কোন প্রকার ঝাল নেই। চুই ঝালের কাণ্ড মাংসের মসলা হিসেবে ব্যবহার হয়। এর কাণ্ড বা লতা ডাঁটার মতো কেটে ছোট টুকরো করে মাছ-মাংস সাথে রান্না করে খাওয়া যায়। রান্নার পর এই টুকরো গুলো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া যায়। খুব ঝাল হলেও এর একটা অপূর্ব স্বাদ ও ঘ্রাণ আছে।

বহু বছর ধরেই খুলনা অঞ্চলের পরিবারগুলোর বাজারের ফর্দে চুইঝালের অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত। বিশেষ করে মাংস রান্নার কোনো আয়োজন থাকলে তো আর কথাই নেই; অবধারিতভাবে চুইঝাল লাগবেই।

তবে মসলাজাতীয় এই পণ্য এখন আর দক্ষিণের আঞ্চলিক গণ্ডিতে আটকে নেই। গত কয়েক বছরে চুইঝালের বাজার রাজধানীসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। খুলনা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট যশোর এলাকায় বিখ্যাত মসলা এই চুই ঝাল । চুইঝালের শিকড় , পাতা ও ফুল ,ফলে ঔষধি গুণ আছে।

প্রতিদিন খুলনার বিভিন্ন এলাকায় তো বটেই, দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন ভোজনরসিক মানুষ। চুইয়ের বিশেষত্ব হলো, এটি স্বাদে ঝাল। তবে ঝালটার আলাদা মাদকতা আছে। খুব তীব্র নয়, ঝাল ঝাল ভাব। এই ভাবটাই চুই খাওয়ার পর স্বাদটাকে আরও বেশি রসময় করে তোলে।এই স্বাদ-গন্ধ, ঐতিহ্য সবমিলিয়ে বাসাবাড়ি থেকে শুরু করে হোটেল-রেস্তোরাঁ, সবখানেই সমান কদর বিশেষ ধরনের এই মশলাটির।

অনেকেই আবার সাধারণ তরকারিতে এটি ব্যবহার করেন। নিরামিষ ভোজীরাও তাদের খাবার তালিকায় একে অপরিহার্যরূপে ব্যবহার করছেন। যুগ যুগ ধরে রসনায় স্বাদ বাড়ানোর জন্য চুই ব্যবহারের প্রচলন আছে।

দেড় থেকে ২ ইঞ্চি টুকরা করে কেটে সেটা মাঝখান দিয়ে ফালি করে খাবার রান্নার একটি নির্দিষ্ট সময়ে এটা ব্যবহার করতে হয়। রান্নার পর কিছুটা গলে যাওয়া চুইয়ের টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। স্বাদ-ঘ্রাণ বাড়াতে আর ক্রেতাদের মন জোগাতে খুলনার হালিম, ঝালমুড়িতেও আজকাল বেশ ব্যবহার হচ্ছে চুইয়ের।

বর্তমানে খুলনা অঞ্চলের পাইকারি বাজারে এক কেজি ভালো মানের চুইঝালের দাম ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। আর কম দামের যে চুইঝালের কেজি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। খুচরা পর্যায়ে বিক্রেতারা স্থানভেদে পাইকারির চেয়ে কেজিতে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশি রাখেন।

সরকারি তথ্যের ভিত্তিতে প্রতি কেজির গড় দাম ১ হাজার ২০০ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশে চুইঝালের বাজারের আকার ৭০ কোটি টাকার। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বাজারের প্রকৃত আকার শতকোটি টাকার বেশি হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য বলছে, দক্ষিণাঞ্চলীয় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চুইঝাল উৎপাদন হয়েছে ৫৭৬ টন। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৩৪৭ টন চুইঝাল। এক অর্থবছরে চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে ২২৯ টন।

পাঁচ বছর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে চুইঝালের মোট উৎপাদন ছিল ২৩৮ টন। অর্থাৎ চুইঝালের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির ফলে কৃষকেরাও বাণিজ্যিকভাবে এটি উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন। বদৌলতে গত ছয় বছরে চুইঝালের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণের বেশি।

ডিএইর তথ্যানুযায়ী, চুইঝাল উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে খুলনা জেলা। গত অর্থবছরে এই জেলায় ২১৮ টন উৎপাদিত হয়েছে। পরের অবস্থানে আছে বাগেরহাট জেলা, যেখানে উৎপাদিত হয়েছে ২০০ টন। এ ছাড়া গত অর্থবছরে সাতক্ষীরায় ১২৬ টন ও নড়াইলে ৩২ টন চুইঝাল উৎপাদিত হয়েছে।

খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলের পাশাপাশি যশোর জেলাতেও চুইঝালের আবাদ হয়ে থাকে। আর এসব জেলার মানুষ আগে শখের বশে বসতবাড়ির আশপাশে চুইঝালের চাষ করতেন। এখন বাণিজ্যিকভাবে খামার গড়ে তুলছেন। অনেকে নার্সারির মাধ্যমে চুইঝালের চারা উৎপাদন করে থাকেন।

চুইঝালে দশমিক ৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল থাকে। এছাড়াও এতে রয়েছে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, গ্ইলাকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল। চুই এর শিকড়ে রয়েছে ১৩.১৫ শতাংশ পিপারিন।

আসুন এবার জেনে নিই চুই ঝালের উপকারিতা সমূহ-

১) আমাদের দেশে অধিক অংশ মানুষের গ্যাস্ট্রিক সমস্যার রয়েছে এই গ্যাস্ট্রিক এর সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে চুইঝালের ভুমিকা অনেক।

২) খাবারের রুচি বাড়াতে এবং ক্ষুধামন্দা দূর করতে আমরা চুইঝাল খেতে পারি।

৩) পরিপাক তন্ত্রতের প্রদহ সারাতে চুইঝাল অনেক দারুন উপকারি।

৪) চুইঝাল খেলে স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা কমে যায়।

৫) অধিক অংশ মানুষের ঘুমের সমস্যা রয়েছে রাতে ঘুম আসে না ঘুমের ওষুধ হিসেবে চুইঝাল খেতে পারেন । এবং শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে এবং শরীরের ব্যথা সারায় চুইঝাল আমরা নিয়মিত খেতে পারি।

৬) সদ্য প্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা দ্রুত কমাতে চুইঝাল ম্যাজিকের মতো সাহায্য করে।

৭) যাদের কাশি, কফ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও রক্তস্বল্পতা সমস্যা রয়েছে তারা চুইঝাল খেতে পারেন।

৮) চুই ঝালের সাথে আদা পিষে খেলে সর্দি সমস্যা সমাধান হবে।

সংরক্ষণ

চুইঝাল বেশিদিন ভালো থাকে না । তাই চুইঝাল পাওয়ার সাথে সাথে কেটে ফেলতে হয় । এবং কেটে ডীপ ফ্রিজে রেখে দিলে সবচেয়ে ভালো । ডীপ ফ্রিজে ১ মাস পযন্ত রাখা যায়।

প্রতি বছর বিদেশে বিপুল পরিমান চুইঝাল রপ্তানি হচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মরিচের বিকল্প হিসেবে চুইঝালের জনপ্রিয়তা বাড়লে দেশের হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। একই সাথে ভেষজ গুণ থাকার কারণে অনেক রোগব্যাধির আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024