সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪২ পূর্বাহ্ন

দিল্লি কা লাড্ডু (১)

  • Update Time : রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৩.৩৯ পিএম

সুমন চট্টোপাধ্যায়

আব কি বার চারশ পার। নরেন্দ্র মোদীর ‘নারা’। মানে স্লোগান।

দিদিমনি বলছেন,” ঘেঁচু, আব কি বার পগারপার।’

পথ বলে আমি দেব/ রথ বলে আমি/ মূর্তি বলে আমি দেব/হাসে অন্তর্যামী। ভোটের বাজারে এই অন্তর্যামীটি হোল পাবলিক। ইয়ে পাবলিক হ্যায়/ইয়ে সব জানতে হ্যায়।

বিগত দু’টি লোকসভা ভোটে পাবলিক কী চাইছে তা বোঝার জন্য হাতে থার্মোমিটার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বিশেষজ্ঞের নিদান সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষের প্রতিটি জনপদে, প্রতিটি গ্রামে এই আগাম বার্তাটি ক্রমে ক্রমে রটে গিয়েছিল যে মোদিজির ছোটানো অশ্বমেধের ঘোড়া একেবারে অপ্রতিরোধ্য, কারও হিম্মত নেই তাকে রুখে দেওয়ার। ২০১৪ সালে কেলেঙ্কারি আর অকর্মণ্যতায় নষ্ট ও ভ্রষ্ট ইউপিএ সরকারকে অর্ধচন্দ্র দেওয়ার দুর্মর তাগিদ ছিল, পাঁচ বছর পরে গোটা দেশ মজেছিল পুলওয়ামা-উত্তর উদ্বেল দেশপ্রেমে। বিজেপির সরকার গড়া নিয়ে সংশয়ের তিলমাত্র অবকাশ ছিলনা, বিতর্কের ভরকেন্দ্রে ছিল সাফল্যের সম্ভাব্য বহর।

 

১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকেই গেরুয়া শিবির ভোটে লড়ছে, প্রথমে জনসঙ্ঘ এবং আশির দশক থেকে বিজেপির নতুন অবতারে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থেকে অটল বিহারি বাজপেয়ী হয়ে লালকৃষ্ণ আডবাণী, মহীরুহ-সদৃশ সব নেতা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদীই একমাত্র যাঁর নেতৃত্বে বিজেপি একক ক্ষমতায় উপর্যুপরি দু’বার কেন্দ্রে সরকার গড়েছে। তাঁকে কেন্দ্র করে উদ্ভত যাবতীয় সঙ্গত সমালোচনা সত্ত্বেও শুধু এমন অপ্রত্যাশিত নির্বাচনী ফলাফলের জন্যই মোদির নাম ইতিহাসে জায়গা করে নেবে। আর কে না জানে’ জিতা যো ওহি সিকন্দর।’

তাহলে এবার ২০২৪-এর ফলাফল ঘোষিত হওয়ার আগে মোদির সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে কেন? এ কী শুধুই বিরোধীদের ভক্কিবাজি নাকি এমন প্রশ্নের সত্যিই বাস্তবিক ভিত্তি আছে? আব কী বার চারশ পার নেহাতই জুমলা, মোদি নিজেই তাঁর এই স্লোগানে বিশ্বাস করেন কিনা সন্দেহ। স্পষ্টতই এমন একটি হাস্যকর স্লোগান তোলা হয়েছিল মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে বিরোধী শিবিরকে জোর সে ঝটকা দিতে, জনমনে এমন একটি ধারণার বীজ বপন করে দিতে যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অজেয়, অপ্রতিরোধ্য এবং অবিনশ্বর, দুনিয়ার কোনও তাগদ নেই তাঁকে গদিচ্যুত করে।

ভোটের বাজারে এমনতরো মনস্তাত্ত্বিক লড়াই অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ রণকৌশল, যত দিন যাচ্ছে, ডিজিটাল পৃথিবীতে আমাদের স্থানান্তর যত পাকাপোক্ত হচ্ছে, ততই সমানুপাতিক হারে বাড়ছে এই কৌশলের প্রয়োজনীয়তা। হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলস দুনিয়াকে শিখিয়েছিলেন একটি মিথ্যা বারবার বলা গেলে লোকে তাকে সত্য বলে মেনে নিতে বাধ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে গোয়েবেলসের হাতের কাছে ফেসবুক, এক্স হ্যান্ডল, ইনস্টাগ্রাম, ইত্যাদি ভুবনজয়ী সামাজিক মাধ্যম ছিলনা, থাকলে তিনি যে কী প্রলয় বাধিয়ে দিতেন সে কথা ভাবলেও গা-টা শিউরে ওঠে। শেষ বিচারে ভোটের ময়দানে সত্য হার মানে পারসেপশন বা ধারনার কাছে আর অর্ধসত্য-অসত্য নিমেষে বিবিধ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ভাইরাল করে দেওয়া হলে জনমনে একটি বিভ্রান্তিকর পারসেপশন তৈরি হতে কতক্ষণ?

 

অনেক দিন আগে মুম্বাইতে নিজের বাড়িতে বসে লতা মঙ্গেশকর কলকাতার এক পরিচিত ভদ্রলোকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমান কিনা। সঙ্গীত-সম্রাজ্ঞীকে বোঝাতে সেই ভদ্রলোকের কালঘাম ছুটে গিয়েছিল। তিনি যত বলেন, এসব ভিত্তিহীন অপপ্রচার, কান দেবেননা, লতাজি তত ঘাড় নাড়িয়ে নাড়িয়ে সে কথা নস্যাৎ করে দেন। এই ঘটনাটি উল্লেখ করলাম কেবল ইন্টারনেট ট্রোলদের ক্রমাগত অপপ্রচার কীভাবে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকী লতা মঙ্গেশকরের মতো মানুষকেও, কেবল সেইটুকু বোঝাতে। এই ডিজিটাল বিপ্লবের পটভূমিতে সমাজমাধ্যমে অসত্য, অর্ধসত্য ক্রমাগত প্রচার করে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরির কৌশল, বিজেপি তাতে সিদ্ধহস্ত এবং এদেশে তার পুরধা। নরেন্দ্র মোদীর যে ভাবমূর্তি স্বদেশে-বিদেশে আজ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তার অন্যতম কারিগর পর্দার অন্তরালে থাকা কয়েকটি মুখ, উদয়াস্ত পরিশ্রম আর নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা এই ভাবমূর্তি অবিরাম পালিশ করে চলেছেন। কেবল দেবকান্ত বড়ুয়ার মতো বিজেপির কোনও নেতা এখনও পর্যন্ত মোদি ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ মোদি বলে ওঠেননি, এইটুকু।

প্রশ্ন উঠেছে কেননা জওহরলাল নেহরুর পরে কোনও প্রধানমন্ত্রী পরপর তিনবার লোকসভা ভোটে জয়ী হতে পারেননি। নেহরু এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন যে ভারতবর্ষে সেখানে কংগ্রেস দলের কার্যত একাধিপত্য ছিল, কেন্দ্রে এবং দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে। তদোপরি নেহরুর ক্যারিসমার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনও নেতা দেশের রাজনীতিতেই ছিলনা। তারপরেও কংগ্রেস টানা দেড় দশক কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল, ইন্দিরা গান্ধি পরপর দুবার জয়ী হয়েছিলেন, তার বেশি নয়। রাজীব প্রথম এবং শেষ প্রধানমন্ত্রী যাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস ৭৫ বছরে একবার ১৯৮৪ সালে চারশর বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী সত্যিই তৃতীয়বার সরকার গড়তে পারলে নেহরুর তৈরি দুর্লঙ্ঘ রেকর্ড স্পর্শ করতে পারবেন। কিন্তু দাবি করা যতটা সহজ ‘কামিয়াব’ হওয়াটা ততটা নয়। কেন যৎপরোনাস্তি সংক্ষেপে আগামীকাল তা আলোচনা করব। (চলবে)

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক,সাবেক নির্বাহী সম্পাদক আনন্দবাজার পত্রিকা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024