স্বদেশ রায়
গাফফার চৌধুরি আমার কাছে শুধু অগ্রজ প্রতিম সাংবাদিক নন, তিনি ব্যক্তি জীবনেও অনেকখানি রক্তের সম্পর্কের অগ্রজের মতোই ছিলেন। সম্পর্কটা শুরু হয়েছিলো সত্তরের দশকের শেষের দিকে। তবে প্রথম দেখা আশির দশকের শেষে। তাই তাকে নিয়ে শুধু জম্ম বা মৃত্যুদিনে লেখা নয়, তাকে নিয়ে অনেক কিছু বলারও ভাবার আছে।
বিশেষ করে দুইজন অগ্রজ প্রতিম সাংবাদিক, একজন এম আর আকতার মুকুল ও অন্যজন গাফফার চৌধুরি- দুজনেই তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে এমন কিছু কথা বলে গেছেন, যা ওনারা দুজনে কখনও লিখতে পারেননি। আমিও লিখতে পারবো কিনা সন্দেহ। তবে তাদের ওই কথাগুলো আমার জীবনে সহস্র কোটি টাকার সম্পদের থেকে বেশি। কারণ, তাদের উপলব্দিও সত্য ঘটনাগুলো আমার চিন্তা ভাবনা ও সাংবাদিকতার জীবন বদলাতে সাহায্য করেছে। একটা অন্য রকম স্রোতের মাঝেও যতটা পারি নিজের পেশার মূল নদীর কূলের একটি ঘাস ধরেও থাকার চেষ্টা করা শিখতে হয়ত সাহায্য করছে তাদের ওই শত বছরের উপলব্দি ও সত্য কিছু ঘটনা।
সচিত্র সন্ধানী, যায়যায়দিন ও জনকন্ঠে গাফফার ভাই আমার কাছে যত লেখা পাঠিয়েছেন তার একটা লেখা শুধু আমি ছাপতে পারেনি। আর সে লেখাটি তিনি লিখেছিলেন আমার একটি ঘটনাকে ঘিরে।
সুপ্রীম কোর্ট তখন আমার একটি লেখার জন্যে আমার ও জনকণ্ঠের মালিক ও সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে মামলা করে। ওই মামলা চলাকালিন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন আমার সপক্ষে একের পর এক লেখা লিখছেন। দেশের বুদ্ধিজীবি ও সাংবাদিকদের সম্মানীয় প্রায় সকলেই মামলার দিন কোর্টে উপস্থিত থাকছেন। এই সময়ে গাফফার ভাই বললেন, তিনিও আমার সপক্ষে একটা লেখা পাঠাবেন। গাফফার ভাই যথা সময়ে লেখা পাঠালেন। কিন্তু আমার সম্পাদকীয় সহকারী দুলাল আচার্য আমাকে জানালো দাদা লেখাটা তো ভিন্ন হয়ে গেছে। দুলাল খুব বিনয়ী ছেলে। ওইটুকু বলে লেখার কপি আমাকে দেয়।
আমি লেখাটা পড়ে দেখি, গাফফার ভাই লিখেছেন আগামীকাল কোর্টে আমি মাফ চাইবো আমার লেখা ভুল হয়েছে বলে। এবং কোর্টের উচিত হবে আমাকে মাফ করে দেয়া।
তখন রাত ৯ টা বাজে। শুধু দুলালকে বলি তুমি এ লেখা হোল্ড করো। অন্য একটা লেখা দাও। আমি পরে গাফফার ভাই এর সঙ্গে কথা বলবো।
পরের দিন সকালে সুপ্রীম কোর্টে আমার মামলার শুনানী ছিলো। ওই সময়ে পত্রিকায় লেখা না দেখে গাফফার ভাই ফোন করেন। এবং বিকেল হতে হতে তিনি আদালতের ঘটনা জানতে পারেন।
সন্ধ্যায় নি্উজের কাজ শেষ করে বাসায় গিয়ে রাতে ওনাকে ফোন করি। তিনি আমার ফোন পেতেই অনেকটা চিত্কার করে বলেন, তোমার জন্যে আমার আর্শীবাদ রইলো। তুমি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় মানিক ভাই( মানিক মিঞ্রা) এর ধারাকে বজায় রেখেছো। জেল মেনে নিয়েছো কিন্তু মাথা নত করোনি। আর খুব ভালো করেছো আমার লেখাটা না ছেপে।
তিনি আমারই একজন ঘনিষ্টজনের কথা বললেন, যে তিনি তাকে ফোন করে বলেছিলেন, তার সঙ্গে এর্টনী জেনারেলের কথা হয়েছে। আগামীকাল এগুলো ঘটবে, তাই তিনি লিখেছিলেন।
আমি ওনাকে বললাম, এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলমভাই এটা বলেছেন তা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ, তিনি ভদ্রলোক মানুষ। আদালতে তিনি কোর্টের পক্ষে, তাই তিনি আমার বিপক্ষে বলছেন। তবে তার সঙ্গে তো আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। তিনি আমাকে জানেন।
তিনিও স্বীকার করলেন, বললেন, আসলে মাহবুবে আলম একজন রবীন্দ্রভক্ত মানুষ। এবং ব্যক্তিজীবনে শতভাগ অসাম্প্রদায়িক। তিনি তার পেশাগত কাজের অংশ হিসেবে এটা করছেন।
আজ গাফফার ভাই এর মৃত্যুদিনে মাহবুবে আলমভাইকেও মনে পড়েছে এ কারণে উনি এমন একটা সময়ে চলে গেলেন যখন তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি। বাস্তবে সেদিন আমি গাফফার ভাইকে যাই বলিনা কেন, সত্য স্বীকার করছি, মাহবুবে আলম ভাইকে আমি কিছুটা ভুল বুঝেছিলাম। যদিও মাহবুবে আলমভাই আমার সে ভুল ভাঙানো চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি।
এখন যতই জীবনের নদীটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে ততই মনে হয়, ভুলগুলো যত দ্রুত পারা যায় সংশোধন করা উচিত। নইলে হাতে সময় থাকে না।
গাফফার ভাই এর সঙ্গে তার জীবনের শেষ সময়ে যেমন একটি দ্বিমতের অবসান হয়। যা ছিলো আমার জন্যে অনেক আনন্দের।
এই দ্বিমত নিয়ে প্রথম আলোচনা হয় ১৯৯১ সালে গাজী শাহাবুদ্দিনভাই এর সচিত্র সন্ধানীতে গাজী ভাই এর রুমে। সেখানে গাফফার ভাই রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ বিপ্লবীদের যেভাবে এঁকেছেন তার সঙ্গে একমত নন এ বিষয় ব্যখা করেন। তিনি এ নিয়ে এর আগে অনেক লেখাও লিখেছেন। ওই আসরে আমি অনেক ছোট হলেও সেদিন গাফফার ভাই এর সঙ্গে একমত হতে পারেনি। কারণ, আমার কাছে তখনও মনে হতো এখনও মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সঠিক। আসলে চরিত্র গঠনের আগে যে কোন মহত কাজে নামা হোক না কেন, শেষ অবধি নিজের চরিত্রের ঘাটতিই ওই মহত কাজকে নিচে নামিয়ে আনে। আর রাষ্ট্র সাধনা, জাতিগঠনের সাধনা তো অনেক বড় বিষয়।
এরপরে এ নিয়ে বহুবার গাফফার ভাই এর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তিনি আমাদের থেকে শতভাগ বেশি রবীন্দ্রভক্ত হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাস নিয়ে তার দ্বিমত বজায় রেখেছিলেন। সেখানে তিনি তার তীক্ষ্ম যুক্তি দিতেন।
তবে কোভিডের সময় বেশ কয়েকদিন টেলিফোনে তার সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এবং এক পর্যায়ে তিনি বলেন,” স্বদেশ, আমার এখন মনে হয় রবীন্দ্রনাথ হয়তো আমার থেকে কম বয়সে ঘরে বাইরে লিখেছিলেন। কিন্তু আমি যদি এখন ভারতের জাতীয় আন্দোলন, বাঙালির জাতীয় আন্দোলন বা রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন নিয়ে কোন উপন্যাস লিখতাম তাহলে সেটাও ঘরে বাইরের মতোই হতো।
অনেকক্ষন টেলিফোনের এ প্রান্তে স্তব্দ হয়ে বসে থাকি। আমার স্তব্দতা দেখে তিনি এক পর্যায়ে হ্যালো, হ্যালো বলতে থাকেন। অর্থাত্ তিনি বুঝতে চান লাইন কেটে গেছে কিনা?
আমি বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে তাকে বলি, আমি লাইনে আছি।
তারপরে তিনি জানতে চান, কীভাবে ঘরে বাইরে নিয়ে আমার অত ছোট বেলা থেকেই ভিন্ন মত ছিলো।
তিনি অগ্রজ। তার কাছে মিথ্যে বলিনি। বলেছিলাম ভাই এক কিশোর হিসেবে ভারতে পূ্র্ব বাংলা থেকে যাওয়া রিফিউজিদের নিয়ে সেদেশের রাজনীতিবিদদের খেলা দেখার সুযোগ হয় আমার। এমনকি বামপন্থী বিপ্লবী রাজনীতিকদের। আবার ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের সন্তান হিসেবে একাত্তরের পরে অনেক মুক্তিযোদ্ধার ভিন্ন চরিত্র দেখার সুযোগ হয়। ওই ঘটনাগুলোর উত্তর প্রথম খুঁজে পাই রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে। পরে তার অনেক নাটক ও প্রবন্ধে।
এর পরে এ নিয়ে আরো অনেক বার অনেক দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে গাফফার ভাই এর সঙ্গে।
তিনি বলেছিলেন, একটি উপন্যাস তিনি লিখবেন রাষ্ট্রবিপ্লব ও জাতি গঠনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
শুধু ওই একটি উপন্যাস নয়, রাজনৈতিক কলাম লিখতে গিয়ে গাফফার চৌধুরি তার সোনার কলম নষ্ট করেছেন। বঞ্চিত করে গেছেন বাংলা সাহিত্যকে। তিনি রাজনৈতিক কলাম লিখে সোনার কলম নষ্ট না করলে পঞ্চাশের বন্ধোপধ্যায়দের পরে বাংলা উপন্যাসের নেতৃত্ব হয়তো তার হাতেই থাকতো।
লেখক: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষনও The present world.
Leave a Reply