শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৫৮ পূর্বাহ্ন

ভারত : ধীরে বহে উন্নতি

  • Update Time : সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৬.৪৩ পিএম

সারাক্ষণ ডেস্ক

১৯৯০-দশকের প্রথমদিকে ভারত স্বদেশী বা আত্মনির্ভরশীলতার নীতি পরিত্যাগ করে, যা স্বাধীনতা লাভের পর থেকে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করত। স্বদেশী নীতি পরিত্যাগের পর ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবংআমদানি শুল্ক হ্রাস করা হয়। ২০১৪ সালের দিকে গড় ট্যারিফ ১৯৯১ সালের শতকরা ১২৫ ভাগ থেকে শতকরা ১৩ ভাগে নেমে আসে। একই সময়ে রপ্তানি বেড়ে যায়। তথাপি দেশের রপ্তানি নরেন্দ্র মোদির আস্বাদনের জন্য কিছুটা নিম্নমুখীই থাকে। তিনি বর্তমানে তৃতীয় মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে চাচ্ছেন (এবং হতেও পারেন)। ভারত এক সার্ভিস সুপারপাওয়ার হলেও বিশ্বজুড়ে জেনেরিক ড্রাগ ও ফোনসহ ম্যানুফেকচারিং সাপ্লাই চেইনে কেবল এক ক্ষুদ্র ভূমিকাই পালনকরে। বস্তুত গত দশক জুড়ে বিশ্বে পণ্য-রপ্তানিতে ভারতের অংশ শতকরা প্রায় ১ দশমিক ৮ ভাগে স্থবির হয়ে রয়েছিল। কি করা যেতে পারে? যেমন বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদ বলবেন, ভারত অবকাঠামোতে বেশী বিনিয়োগ করছে, বাণিজ্য চুক্তি সই করছে এবং লালফিতার দৌরাত্ম বিনাশ করছে। তথাপি দেশটি পরীক্ষামূলক ব্যবস্থাদিও দিকে গা ভাসাচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী হল “উৎপাদন-সংযুক্ত প্রণোদনা” (পিএলআই)। এটি ২০২০ সালে প্রবর্তন করা হয় এবং এজন্য ২ ট্রিলিয়ন রুপি (২ হাজার ৪ শত কোটি ডলার) ব্যয় করা হয়। এ স্কিমের আওতায় দেশের সাফল্যের জন্য অত্যাবশ্যক বলে দেখা হয় এমন ১৪টি শিল্প-প্রতিষ্ঠানকে যেমন ইলেকট্রনিক্স ও টেক্সটাইল শিল্পকে- ২০২০ সালের পূর্বের পর্যায়ের যে-কোন পণ্য-বিক্রয়ের মূল্যের শতকরা ৪-৬ ভাগের সম পরিমাণ অর্থ দান হিসাবে দেওয়া হয়, তবে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হয়। এ পলিসি প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি বাড়াবে বলে মন্ত্রীদেও আশা। এরই মধ্যে সরকারী রিপোর্টে চমৎকার পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। স্কিমটি প্রায় ১ হাজার ৩ শত কোটি ডলার বিনিয়োগএবং ৭ লাখ কর্মসৃষ্টির সহিত জড়িত বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়াও সবচেয়ে বড় ও বেশি উৎপাদনশীল ম্যানুফেকচারিং শিল্পগুলো ক্ষুদ্রতর ও শ্লথগতিসম্পন্ন শিল্পগুলোর তুলনায় দ্রুততর গতিতে বর্ধিত হচ্ছে বলে অ্যানুয়েল সার্ভে অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিতে দেখানো হয়। কিন্তু এর কতখানি এমনকি ঐ ব্যয় ছাড়াও ঘটত? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়া দি ইকনোমিস্ট পাঁটটি বড় শিল্পের রপ্তানি উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছে। আমাদেও সিদ্ধান্ত মোদিকে খুশীকে করবে না। ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে শুরু করা যাক। পিএলআই চালু হওয়ার পর ফোন ও ইলেকট্রনিক্সের রপ্তানি জিডিপির তুলনায় দ্রুততরগতিতে বেড়েছে। মর্গান স্ট্যানলি নামের এক ব্যাংক উল্লেখ করছে যে, ভারত বিশ্ব-বাজারে ইলেকট্রনিক-সামগ্রীর রপ্তানির পরিমাণ এক দশক আগের শতকরা ১ ভাগের তুলনায় বৃদ্ধি করে শতকরা ৩ ভাগেরও বেশি রপ্তানি করে থাকে। ফোন রপ্তানি ২০১৯ সাল থেকে মূল্যের দিক দিয়ে তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। উৎপাদিত আইফোনগুলোর এসেম্বলড হওয়ার পরিমাণ গত বছরের পূর্ববর্তী বছরের শতকরা ৭ ভাগ থেকে বেড়ে গত বছর শতকরা ১৪ ভাগে দাঁড়িয়েছিল বলে জানা যায়।

তবে ইলেকট্রনিক্সের বাইরের ছবি কমই আশাপ্রদ। আমরা বিবেচনা করছি এমন শিল্পগুলোর রপ্তানি জিডিপির হারে বা এর চেয়ে কম হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। টেক্সটাইল খাতের রপ্তানি প্রকৃতপক্ষে হ্রাস পেয়েছে, অথচ এ খাতই কৃষি বাদে অন্য যে কোন খাতের চেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করে থাকে। যেমন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রঘুনাথ রাজন দেখতে পান, আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের সংযোজন ফোন রপ্তানিতে উৎসাহ যুগিয়েছে- এ প্রক্রিয়াই কোনআইফোনের সঙ্গে বিরাটআর্থিক মূল্য যুক্ত হওয়ার কারণ। তিনি এমনকি এমতও দেন যে, ভর্তুকির মূল্য একবার হিসাবে ধরা হলে পিএলআই ভারতের জিডিপি বৃদ্ধি নাও করে থাকতে পারে। সমস্যা এই যে, সব সরকারি নীতি একই দিকে পরিচালিত হচ্ছে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ভারতের গড় ট্যারিফ স্থানীয় পণ্য কিনতে দেশের ভোক্তা ও কোম্পানিসমূহকে বুঝিয়ে রাজি করানোর প্রচেষ্টায় গত দশকে শতকরা ১৩ ভাগ থেকে শতকরা ১৮ ভাগে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ বদরি গোপালকৃষ্ণণ উল্লেখ করেন যে, ভারতের অনেক শিল্পেই সাপ্লাই চেইন এখনও ভ্রূণাবস্থায় থাকায় মধ্যবর্তী পণ্যাদির উপর আরোপিত লেভি পিএলআই কর্মসূচীর মাধ্যমে দেওয়া ভর্তুকির কিছু অংশ শুষে নিয়েছে। তিনি ইতিপূর্বে সরকারের অভ্যন্তরীণ গবেষণা-সংস্থায় বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গবেষণা-সংস্থা তক্ষশীলা ইনস্টিটিউটের প্রণয় কোটাস্তান ভারত একই সময়ে “বিশ্বায়ন ও স্থানীয়করণ” করার চেষ্টা করছে বলে সতর্ক করে দেন। তাঁর মতে, দ্বিতীয়টির পূর্বে প্রথমটি করতে পারলেই ভারত বেশি ভাল করবে। এদিকে, কর্মকর্তারা উল্লেথ করেন যে, কর্মসূচীটির উচ্চ প্রচারসত্ত্বেও এতে কর্মরত সিভিল সার্ভেন্টদেও মধ্যে প্রায়ই দক্ষতার অভাব দেখা দেয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কমিটিগুলো দিয়ে বিভিন্ন স্কিম পরিচালনা করা হয় এবং তাদের মধ্যে কোন কোনটি অন্যদের তুলনায় বেশি দ্রুত কাজ করে। ফার্মগুলো মেনে-চলা-কঠিন এমন নিয়মকানুন এবং ঝুঁকিবিমুখ প্রশাসকদের নিয়ে অভিযোগ করেন। এ পর্যন্ত মূলবরাদ্দ ২ হাজার ৬ শত কোটি ডলারের মধ্যে মাত্র ১ শত কোটি ডলার বন্টন করা হয়েছে- এটি কঠোর নিয়ম-কানুন ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার শ্লথগতিরই নিদর্শন।

কর্মসূচীটি গভীরতর সংস্কারের পথ থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বলেও কেউ কেউ উদ্বিগ্ন। সবচেয়ে সেরা প্রদর্শক মোবাইল-ফোন ইন্ডাস্ট্রীর কথা বলতে গেলে, আর্থিক প্রণোদনাই অ্যাপেলের বিনিয়োগের কারণ ছিল কিনা তা প্রমাণ করা কঠিন।

সন্দেহবাদীরা উল্লেখ করেন যে, কোম্পানিটি চীন ছাড়া অন্যান্য দেশে উৎপাদন-সামর্থ্য বাড়াতে আগ্রহী ছিল, এবং সেজন্য যে-কোন উপায়ে ভারতে বিনিয়োগ করতে পারত। তবুও পিএলআই পেয়েছেন এমন এক শিল্পপতি বলছেন, ভারত সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিনিষেধ দূর করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ- এ আভাসই, অর্থেরও চেয়ে বলতে গেলে, স্কিমটির প্রধান সুবিধা। এর ফলে ভূমি অর্জন করা থেকে শুরু করে জ্বালানির সুবিধালাভ করা পর্যন সবকিছুর ক্ষেত্রে বিদ্যমান অনিশ্চয়তা হ্রাস পায়। ভারত পিএলআই পেয়ে থাকে এমন এবং অ্যাপেলের মত বড় বড় ফার্মের জন্যই নয়, সব কোম্পানির জন্যও বাধানিষেধ দূর করে আরও উপকৃত হতে পারে। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু পিএলআইকে ব্যর্থ ঘোষণা করা অপরিণত সিদ্ধান্তই হবে। ফোন রপ্তানি যন্ত্রাংশ সংযোজনের ফলে উদ্দীপনা পেলেও এরূপ অবস্থা প্রত্যাশিতই ছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যনি রডরিক লিখেছেন, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশগুলো স্বল্প দক্ষতাসম্পন্ন এলাকাগুলেতেই তাদেও ম্যানুফেকচারিং অভিযাত্রা শুরু কওে এবং এর পরই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহএবংবড় বড় শিল্প নির্মাণের দিকে এগিয়ে যায়। অ্যাপেল ভারতে আইফোন উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনাকরছে, অন্যান্য সরবরাহকারী তার নেতৃত্ব অনুসরণ করবে।

ভারতের পক্ষে এক দশক সময়েরমধ্যে এক সমৃদ্ধিশীল ইলেকট্রনিক্স শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। আর এটি প্রতিষ্ঠায় পিএলআই এক ভূমিকা পালন করবে। ভারতের কৌশল বিকশিত হচ্ছে বলে আভাস দেখা যায়। ইলেকট্রনিক্স শিল্পে পিএলআই পাওয়ার ক্ষেত্রে এখন সামান্যই আমলাতান্ত্রিক বাধা রয়েছে। সরকার এ দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করতে চায়। সবচেয়ে সাম্প্রতিক বাজেটে মন্ত্রীরা ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশের আমদানির উপর ট্যারিফের পরিমাণ শতকরা ১৫ ভাগ থেকে শতকরা ১০ ভাগে নামিয়ে এনেছেন। তাঁরা উচ্চ আমদানি-ব্যয় সম্পর্কে সচেতন বলে দেখালেন। যখন কর্পোরেশনগুলোকে দেওয়া সরকারি দান (corporate handouts) বিশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়, তখন তা দ্রুত অর্থ হারানোর এক চমৎকার উপায়। ভারতকে এ ফাঁদের কবল থেকে রেহাই পেতে হলে এ প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও উন্নতি ঘটাতে হবে এবং তা দ্রুত।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024