সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬:০৮ অপরাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( দ্বিতীয় কিস্তি )

  • Update Time : রবিবার, ১০ মার্চ, ২০২৪, ৬.২৬ পিএম

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো।   ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না। 

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

 

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক  বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
দিবা রাত্রির কাব্য
মানিক  বন্দোপাধ্যায়

সুপ্রিয়া রাঁধে মাছ তরিতরকারী, রাঁধে ছানার ডালনা। গৃহকর্মকে সে সত্যসত্যই এত ভালবেসেছে যে, মাছের ঝোলের আলু কুটতে বসেই তার মনের আঘাত মিলিয়ে আসে। ওবেলা গাঁ থেকে দুটো মুরগি আনবার মতলবটাও এসময় সে মনে মনে স্থির করে ফেলে।

 

রান্নার ফাঁকে একসময় হেরম্বকে শুনিয়ে আসে, ‘আর কেউ হলে রান্নাঘরে গিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করত।-ওমা, ঘুমে যে চোখ ঢুলছে!’

 

‘ভারি ঘুম পাচ্ছে স্বপ্রিয়া। সারারাত ঘুমোইনি।’

 

সুপ্রিয়া বলে, ‘তাই বলে, সারাদিন শরীর বিশ্রী হয়ে থাকবে। এখন এই সকালবেলা ঘুমোতে পাবেন না। আরেক কাপ চা পাঠাচ্ছি, খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিন, তারপর দুপুরবেলাটা পড়ে পড়ে যত ইচ্ছে ঘুমাবেন।’

 

দুপুরবেলা হেরম্বের সঙ্গে গল্প করবে, না কয়েকটা বিশেষ বিশেষ খাবার তৈরি করতে বসবে এতক্ষণ সুপ্রিয়া তা ঠিক করে উঠতে পারেনি। দুপুরে হেরম্বের ঘুমের প্রয়োজনে এ সমস্তার মীমাংসা হয়ে যাওয়ায় সে নিশ্চিত হয়।

 

ভাবে, একা ফেলে রেখে কি আর খাবার করা যেত? পেটুক তো সহজ নয়? এ বেশ হল। ঘুমোবার সময়ের মধ্যেই হাত চালিয়ে সব করে ফেলব।

 

তারপর গা ধুয়ে এসে আর কাজ নয়। শুধু গল্প।

 

গম্ভীর হেরম্বের সঙ্গে সে কি গল্প করবে সে-ই জানে।

 

হেরম্বের জন্য আবার চা করতে গিয়ে সে ফিরে আসে।

 

‘একটু ব্রান্ডি খাবেন? শরীরের জড়তা কেটে যাবে।’

 

সে তামাশা করছে ভেবে হেরম্ব একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, ‘ব্রাণ্ডি! ব্রাপ্তি

 

তুই পাবি কোথায়?’

 

‘আছে। উনি খান যে!’

 

হেরম্ব অবাক হয়ে বলে, ‘অশোক মদ খায় ?’

 

সুপ্রিয়া হাসে।

 

‘নেশা করবার জন্যে কি আর খায়। আমিও ক’দিন খেয়েছি। খায়? শরীর ভাল নয় বলে ওষুধের মতো খেলে এমন চনচনে লাগে শরীর যে মনে হয় ওজন অর্ধেক হালকা হয়ে গেছে। একদিন-রাগ করবেন না তো?- একদিন অনেকটা খেয়ে ফেলেছিলাম। নেশায় শেষে অন্ধকার দেখতে লাগলাম!’

 

‘তোর সব বিষয়েই বাড়াবাড়ি সুপ্রিয়া। নেশায় কেউ অন্ধকার দ্যাখে?’ ‘দ্যাখে না? আমার যে-রকম ভয় হয়েছিল, আপনার হলে বুঝতেন।’ চাবির গোছা হাতে নিয়ে সুপ্রিয়া একটা চাবি বেছে ঠিক করে, ‘বলুন, চা খাবেন, না ব্রান্ডি খাবেন। আলমারিতে দু’বোতল আছে। কী রঙ! দেখলে লোভ হয়।’

মাতাল হবার জন্য স্বামী মদ খায় না বলে এটা সুপ্রিয়ার কাছে এখনও হাসির ব্যাপার। কিন্তু হেরম্বের মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ তার হাসি ডুবে যায়।

 

সে ভয়ে ভয়ে বলে, ‘রাগ করলেন?’ হেরম্বের রাত জাগা লাল চোখ এ প্রশ্নে তার দিকে ফিরে আসে না, স্কুলের ছেলের সামনে কড়া মাস্টারের মতো তার গাম্ভীর্য কোথাও একটু টোল খায় না। রূঢ়, নীরস কণ্ঠে সে সংক্ষেপে বলে, ‘না।’

 

সুপ্রিয়ার কানে কথাটা ধমকের মতো শোনায়। নিজেকে হঠাৎ অসহায়, বিপন্ন মনে হয়।

 

‘কি হল, বলুন। আপনাকে বলতে হবে। আমি ব্রান্ডি খেয়েছি বলে? সত্যি বলছি, একদিন শুধু শথ করে একটুখানি-‘

 

হেরম্ব বলে, ‘ছেলেমানুষের মতো কথা বলিসনে, সুপ্রিয়া। তোর অনেক বয়স হয়েছে।’

 

সুপ্রিয়া দু’পা সামনে এগিয়ে যায়। হেরম্বের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘ছেলেমানুষের মতো কথা আমি বলিনি। আপনিই আমায় ছেলেমানুষ করে রাখছেন। -এসব চলবে না, তাকান, তাকান, তাকান আমার দিকে। আমার ছ’বছর বিয়ে হয়েছে, আমি কচিখুকী নই যে, হঠাৎ কেন এত রেগে গেলেন শুনতে পাব না।’

 

হেরম্ব তার চোখের দিকে তাকাল না। তেমনি ভাবে বসে তেমনি কড়া স্বরে বলে, ‘শুনে কি হবে? তুই কি বুঝবি? তোর মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু তুই এমন আস্তে আস্তে নিজের সর্বনাশের ব্যবস্থা করছিস কেন? আমি তোকে ভাল উপায় বলে দিচ্ছি। রাত্রে একদিন অশোককে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘরের চালে আগুন লাগিয়ে দিস্।’

 

অনেকক্ষণ স্তব্ধ বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কথা বলার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে স্বপ্রিয়া কেঁদে ফেলে রান্নাঘরে চলে গেল। তার মনে হতে লাগল, বিশেষভাবে তাকে আঘাত করবার জন্যই হেরম্ব এতকাল পরে তার বাড়িতে অতিথি হয়েছে। দু’দিনের নোটিশ দিয়ে ওর আকস্মিক আবির্ভাবটা গভীর ষড়যন্ত্রের ব্যাপার। পাঁচ বছরে তার মনের অবস্থা কিরকম দাড়িয়েছে, আগে তার একটা ধারণা করে নিয়ে তাকে আঘাত দিয়ে অপমান করে তার কল্পনা ও স্বপ্নের অবশিষ্টটুকু মুছে নেবার উদ্দেশ্যেই হেরম্ব তার বাড়িতে পদার্পণ করেছে। তাকে ও শাসন করবে, সংকীর্ণ ও সংক্ষিপ্ত একটি বাগানে তার মূল বিস্তার করা দরকার বলে তার সব বাহুল্য ডালপালা ছেঁটে ফেলবে, এমন একটি শাখা রেখে যাবে না, যেখানে সে দু’টি অনাবশ্যক ফুল ফোটাতে পারে।

 

ছোট দারোগার সঙ্গে হেরম্ব তার বিয়ে দিয়েছিল। আজ একদিনে সে তাকে ছোট দারোগারই বৌ তৈরি করে দিয়ে চলে যাবে।

 

এবার আর কাজে স্বপ্রিয়া সহজে মন বসাতে পারে না, মাছের ঝোলে আলুর দমের গোটা গোটা আলু ছেড়ে খুন্তি দিয়ে তরকারীর মতো খুটে দেয়। খুন দেওয়া হয়েছে কিনা মনে করতে না পেরে খুস্তিটা উঁচু করে ঠাণ্ডা হবার সময় না দিয়েই একফোঁটা তপ্ত ঝোল জিভে ফেলে দেয়। গরমের জ্বালাটাই সে টের পায়, শুনের স্বাদ পায় না।

 

ডেকে বলে, ‘ও পাড়ে, দ্ব্যাখতো নিমক দিয়া কি নেই?’ এবং মাছের কোল মুখে করা দূর থাক পাড়ে তার ছোঁয়া পর্যন্ত খায় না স্মরণ করে তার রাগ হয়।

 

‘যাও, তুম্ বাহার চলা যাও।’

 

ভাবে, ‘হয়েছে। আজ আর আমি রোঁধে খাইয়েছি।’

 

তার মনের মধ্যে হেরম্বের কথাটা পাক খেয়ে বেড়ায়। শরীর খারাপ বলে অশোক ওষুধের মতো মদ খেলে তার অপরাধটা কোনখানে হয় সে ভেবে পায় না। আজকের ওষুধ কাল অশোকের নেশায় দাড়িয়ে গেলে সে ঠেকাবে কি করে? বারণ সে করতে পারে। একবার কেন দশবার বারণ করতে পারে। দরকার হলে পায়ে ধরে কাঁদাকাটা করতেও তার আপত্তি নেই। কিন্তু চাকরির জোরে বিয়ে-করা বৌ-এর কথা শুনছে কে? সংসারে সকলে যদি তার কথামতোই চলত তবে আর ভাবনা ছিল কিসের! মদে আসক্তি জন্মে যাবার আশঙ্কা অশোক হেসেই উড়িয়ে দেবে। বলবে, ‘ক্ষেপেছ?’ আমার ওটুকু মনের জোর নেই? এ বোতল দু’টো শেষ হলে হয়তো আর কিনবার দরকার হবে না।’ বলবে, ‘কতগুলো টাকা! থাকলে পোস্টাপিসে জমত। সাধ করে কেউ অত দামী পদার্থ কেনে!’

 

সে জবাব দেবে কি? স্বামীর মনের জোরে সন্দেহ প্রকাশ করবে? তার স্বাস্থ্য ভাল করার দরকার নেই বলে আব্দার ধরবে? অশোক ধমকে উঠলে তার মুখখানা হেরম্ব যেন তখন দেখে যায়।

 

গরমে, আগুনের তাতে, সুপ্রিয়া এতক্ষণে ঘেমে উঠেছে। উঠানে চনচনে রোদ। একটু বাতাস গায়ে লাগাবার জন্য দরজার কাছে সরে গিয়ে সুপ্রিয়া দেখতে পেল, হেরম্ব শোবার ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। দু’জনের মাঝে উঠানের ব্যবধান ভরে ঝাঁজাল কড়া রোদটা সুপ্রিয়ার কাছে রূপকের মতো ঠেকল।

 

বারান্দা থেকেই হেরম্ব বলল, ‘এত গরমে তোর নারাঁধলেও চলবে, সুপ্রিয়া। পাড়েকে ছেড়ে দিয়ে চলে আয়, যা পারে ওই করবে।’ সুপ্রিয়া কথা বলল না। আঁচলে মুখ মুছে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।

 

হেরম্ব বলল, ‘আমাকে চা দিলি না যে?’

‘এত গরমে একশোবার চা খেতে হবে না।’

 

‘এক গেলাস জল দে তবে।’

 

হেরম্বকে তৃষ্ণার্ত জেনে সুপ্রিয়ার সেবাবৃত্তি জাগ্রত হয়ে উঠল।

 

শরবত করে দেব? লেবুর শরবত?’

 

হেরম্ব আগ্রহ জানিয়ে বলল, ‘দে, তাই দে।’

 

আহত, উত্তপ্ত ও ঘর্মাক্ত সুপ্রিয়ার হাত থেকে শরবতের গ্লাস নেবার সময় এক মুহূর্তের জন্য হেরম্বের মনে হল হয়তো সত্যসত্যই মেয়েদের মঙ্গলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পুরুষেরা গোড়াতেই কোথাও একটা গলদ বাধিয়ে বসে আছে, সে জন্য ওদের মনের শৈশব কোনদিনই ঘুচতে চায় না। খুণ যদি ধরে তো একেবারে কাঁচা মনেই ধরে, নইলে ওরা আজন্ম শিশু। জীবন-সাগরের তীরে বালি খুঁড়ে পুকুর তৈরি করে ওরা খুশী থাকবে, সমুদ্রের সঙ্গে তাদের সে কীর্তির তুলনা কখনো করে না। ডাবের জলে ডাবের শাঁসে জগতের ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর হয় চিরদিন এই থাকত ওদের ধারণা, জগতের ক্ষুধাও ওরা বুঝবে না, তৃষ্ণার প্রকৃতিও জানবে না।

 

শরবত পান করে হেরম্ব বলল, ‘কাল ফিট হয়েছিল, আজ আবার রাঁধিতে গেলি কেন?’

 

– ‘বাড়িতে অতিথি, রাঁধিব না? অতিথি থাবে কি ?’

 

‘অতিথি দইচি’ড়ে দিয়ে ফলার করবে।’

 

‘অতিথির অত দরদ দেখিয়ে কাজ নেই।’

 

সুপ্রিয়ার মুখের মেঘ আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছিল। সে ভাবতে আরম্ভ করেছিল যে, হেরম্ব খেয়ালী মানুষ, মনের খেয়ালে ও যদি একটা অদ্ভুত কিছু করতে চায়, রাগ করে আর লাভ কি হবে? যে উদ্দেশ্যে যে মনোভাব নিয়েই ও এসে থাক, সে বিনা প্রতিবাদে ওকে গ্রহণ করবে। নিজের সুখ-দুঃখ মান- অভিমানের কথাটা একেবারেই ভাববে না। বড় ভাইএর মতো ও যদি তাকে শাসন করে, ছোট বোনের মতো সে নীরবে শাসিত হবে। ভ্রান্ত কল্যাণকামীর মতো ও যদি তার মনে ব্যথা দেয়, মুখ বুজে সে ব্যথিত হবে। ও যদি তার চোখের জল দেখতে চায় দু’চোখ দিয়ে বারবার করে জল ঢেলে ওকে সে চোখের জল দেখাবে। স্বপ্নহীন মাধুর্যহীন রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে তাকে যদি আকণ্ঠ নিমজ্জিত দেখতে চায়, পাকা গিন্নীর মতো ব্যবহার করে ওকে সে তাক লাগিয়ে দেবে।

 

হেরম্বের নিদ্রালস প্রভাতটি অতঃপর সুপ্রিয়ার এই গোপন প্রতিজ্ঞার ফলাফলে ক্ষুব্ধ ও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। সহসা সুপ্রিয়া যেন তার কাছে একটা দুর্বোধ্য রহস্যের আবরণ নিয়েছে। বিদায়কামী কচের কাছে দেবযানীর অভিশাপের মতো সুপ্রিয়ার আকস্মিক ও অভিনব সহজ হাসিখুশির

ভাবটা হেরম্বের কাছে দুর্বলের বিশ্রী প্রতিশোধ নেওয়ার মতো ঠেকতে লাগল। মনে হল, ইদারার জলের মতো ঠাণ্ডা মেয়েটা হঠাৎ বরফ হয়ে গেছে। স্নিগ্ধতা দেখালে আরও জমাট বাঁধছে, রূঢ়তার উত্তাপে বিনা বাক্যব্যয়ে গলতে আরম্ভ করে দিচ্ছে। কিন্তু গ্রহণ করছে না কিছুই।

 

সুপ্রিয়ার রান্না শেষ হতে বারোটা বাজল। ফিট হতে শুরু হওয়ার পর থেকে তার চোখের কোলে নিষ্প্রভ কাজলের মতো একটা কালিমার ছাপ পড়েছিল। এই আবেষ্টনীর মধ্যে তার চোখ দু’টি আজকাল আরও বেশী উজ্জ্বল দেখায়। এখন, এই গরমে এতক্ষণ কাঠের উনানে রান্না করার ফলে তার সমস্ত মুখ মলিন নিরুজ্জ্বল হয়ে গেছে। হেরম্ব আর একবার স্নান করবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে এলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেরম্ব ব্যথিত হল। একধার থেকে কেবল রান্না করে যাওয়ার পাগলামি মেয়েদের কেন আসে হেরম্বের তা অজানা নয়! আরও অনেককেই সে এ নেশায় মেতে থাকতে দেখেছে। সুপ্রিয়ার মতো তাদের এমনি রান্নার ঝোঁক চাপে, রেধে রেধে আধমরা হয়ে তারা খুশী হয়।

 

অথচ তাদের সঙ্গে, যারা ভাববার উপযুক্ত মন থেকে বঞ্চিত, সুপ্রিয়ার একটা অতিবড় মৌলিক পদার্থ আছে। ওর এত রান্না-করাকে হেরম্ব কোনমতেই সমর্থন করতে পারল না। বারান্দায় দাঁড়ালে বাড়ির প্রাচীর ডিঙিয়ে বহুদূর অবধি প্রান্তর চোখে পড়ে। মাঠ থেকে এখন আগুনের হলকা উঠছে। খানিক তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাধা লেগে যায়। আমাকে ঠাণ্ডা করতে চাস, তুই যে হেরম্ব বলল, ‘বার বার স্নান করিয়ে গরমে গলে গেলি নিজে?’ সুপ্রিয়া এখনো হাসল, ‘গলে গেলাম? ননীর পুতুল নাকি ?’

 

হেরম্ব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘হাসিস নে। তুই কি বলবি জানি, তবু তোকে বলে রাখি, শরীর ভাল রাখার চেয়ে বড় কাজ মানুষের নেই। শরীর ভাল না থাকলে মানুষ ভাবুক হয়, দুঃখ বেদনা কল্পনা করে, ভাবে জীবনটা শুধু ফাঁকি। বদহজম আর ভালবাসার লক্ষণগুলি যে একরকম তা বোধহয় তুই

 

জানিস নে ?-‘

 

দাড়িয়ে দাড়িয়ে সুপ্রিয়া আনমনে হেরম্বের মুখে স্বাস্থ্যতত্ত্ব সম্পর্কীয় উপদেশ শুনল। কিন্তু তার একটি কথাতেও সায় দিল না।

 

সূর্যাস্ত পর্যন্ত ঘুমিয়ে উঠে হেরম্ব দেখল আয়নার সামনে সুপ্রিয়া চুলবাঁধা শেষ করে এনেছে। সে টের পেল, সুপ্রিয়ার একটি আশা সে পূর্ণ করেছে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024