স্বদেশ রায়
৯০ এর দশকের শুরুতে একটি বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলাম “রাজনীতিবিদদের মান সম্মান” শিরোনামে। ওই সময়ে সে পত্রিকার সম্পাদক কলামটির জন্য একটি সম্পাদকীয় নোটও লিখেছিলেন। সে সময়ে যে দৈনিক পত্রিকায় কাজ করতাম ওই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে ওই কলামের বিষয় নিয়ে বেশ কিছুটা বির্তকও হয়েছিলো।
ওই কলামে রাজনীতিবিদদের মান সম্মানের বিষয়ে যে যুক্তি দিয়েছিলাম, বর্তমানে সে যুক্তির একটিও দাঁড় করানোর কোন সুযোগ নেই। এর মূল কারণ যে রাজনীতিবিদরা তা নয়, মূল কারণ সময় ও পৃথিবীর পরিবর্তনের গতি। আর এটা স্বাভাবিক। যারা ইতিহাসের মানুষ তারা আরো ভালো জানেন, এটাই সমাজ বিজ্ঞানের বাস্তবতা। সমাজ পরিবর্তনশীল। সমাজের একটি উপাদান রাজনীতি, তার পরিবর্তনও তাই স্বাভাবিক। যে কারণে রাজনৈতিক কলাম আর রাজনীতি বিষয়ক বই কখনও এক নয়। রাজনীতি বিষয়ক বই একটি সুদূর প্রসারি চিন্তা আর রাজনৈতিক কলাম তাৎক্ষণিক বিষয়।
তবে সমাজের পরিবতর্নের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি পরিবর্তিত হলেও সমাজ যেমন কিছু মৌলিক উপদানের ওপর দাঁড়িয়ে পরিবর্তিত হয়, রাজনীতিও তেমনি কিছু মৌলিক উপাদানের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আর তার একটি “রাজনীতিবিদদের মান সম্মান”। সমাজে যদি রাজনীতিবিদদের সম্মান কমে যায় তখন রাজনীতিও ধীরে ধীরে অপাঙতেয় হয়ে পড়ে।
রাজনীতিবিদগন যে কোন দেশে সর্বোচ্চ সম্মানী হবেন এমনটি চিন্তা করা বোকামি। রাজনীতিবিদ সর্বোচ্চ জনপ্রিয় হতে পারেন, তবে সম্মানী সমাজে অন্য কোন পেশার আর কেউ হতে পারেন এটাও বাস্তবতা। যেমন মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধী- মহাত্মা গান্ধী নামে ভারতে একটা সময়ে সব থেকে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তার অর্থ এ নয় যে তিনি ভারতের সমাজেও সভ্যতায় কৌটিল্য, রবীন্দ্রনাথ, রামমোহনের থেকে বেশি সম্মানীয়।
তবে রাজনীতিবিদেদের প্রতি একটি আলাদা সম্মান ও ভালোবাসা এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছিলো এ কারণে, রাজনীতিবিদরা সমাজের যারা সম্মানীয় তাদেরকে আরো বেশি সম্মানিত করতেন বলে।
যেমন পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন পদ্ধতি নষ্ট করার ক্ষেত্রে জ্যেতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা ব্যানার্জি তিনজনের মধ্যে কে বেশি দায়ী তা ভবিষ্যতে সে দেশের গবেষকরা গবেষণা করে নির্ধারণ করবেন। তবে তারপরেও সেখানকার মানুষ মমতা ব্যানার্জির থেকে জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে আলাদা কাতারে রাখেন। কারন, তারা রাজনীতির বাইরে অন্যান্য গুনের যারা অধিকারী তাদরেকে মতাদর্শগতভাবে তাদের রাজনীতিতে বিশ্বাসী করার চেষ্টা করছেন বটে যেমন একজন ধর্ম প্রচারক করেন। তবে তারা কখনও নিজেই যে ওই গুনের অধিকারী এমনটি হবার চেষ্টা করেননি। অন্যদিকে এখন পশ্চিমবঙ্গে শিল্পী থেকে দার্শনিক অবধি সবই মমতা ব্যানার্জি।
এখানে শুধু ভারতের একটি রাজ্যের উদাহরণ দিলাম কিন্তু এ সত্য, পৃথিবী জুড়ে এই একটি নতুন ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে- এক শ্রেনীর রাজনীতিবিদ সমাজের সম্মানের সর্বস্ব গ্রাস করতে চান। অর্থাৎ আগের অবস্থানের উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছেন এক দল।
এর প্রভাব স্বাভাবিকই পড়তে শুরু করেছে সমাজে। যদিও কেউ কেউ বলেন, সমাজ বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সবই রাষ্ট্র নিয়ে নিয়েছে। তাদের সকল যুক্তির প্রতি বিনম্র সম্মান রেখে বলা যায়, রাষ্ট্রের পরিবর্তন, সম্রাজ্যের পরিবর্তন মানুষ তার বাহু বলে করেছে বার বার। কিন্তু বরফ যুগের মত যুগের পরেও ধ্বংসাবশেষ থেকে যে মানব জেগে উঠেছে সেখানেও একই মানব সমাজ। তারপরে ওই সমাজের ওপর পড়েছে হাজার হাজার বছরের সভ্যতার কঠিন স্তর, একে কয়েক হাজার বছরের আবিস্কৃত রাষ্ট্র আর কয়েকশ বছরের রাজনীতি দিয়ে কখনই ধ্বংস করা বা গ্রাস করা যায় না। তাই সমাজ থাকবেই।
রাজনীতি ও রাজনীতিবিদগন যদি সমাজেকে স্বীকার না করেন তা হলে ভুল হবে। যেমন সমাজকে অস্বীকার করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হয়ে গেছে। এত কিছুর পরেও চায়না এগিয়ে চলেছে তার মূলে তার সমাজ ও তার সভ্যতা। আমেরিকারও একটি মূল শক্তি তার নিজদেশে সে সব সমাজ ও সভ্যতাকে সম্মান দেয়। ট্র্রাম্প যখনই অন্য সমাজ ও সভ্যতাকে অস্বীকার করতে চাচ্ছেন তখনই তাদের রাজনীতিবিদদের সম্মান নেমে যাচ্ছে, প্রশ্ন উঠছে রাজনীতিকে নিয়ে।
বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে রাজনীতিবিদের মান সম্মান অন্য পেশার মাধ্যমে নষ্ট করা হচ্ছিলো এবং রাজনীতিবিদরা সাময়িক লাভের জন্য সে পথও নিচ্ছিলেন। বর্তমানের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমানে রাজনীতিবিদদের অনেকে নিজেকে আরো বেশি ক্ষমতাশালী ও বিত্তশালী করার জন্যে যে পথ নিচ্ছেন তাতে রাজনীতিবিদের প্রতি সাধারণ মানুষের যতটা ভয়, রাজনীতিবিদদের আনুকূল্যে নিজে বেঁচে বর্তে থাকার সুবিধার জন্য যতটা তাদেরকে প্রয়োজনীয় মনে করে- ততটা সম্মান করে না। কারণ, অনেক রাজনীতিবিদের আচরণ মূলত মুর্তির ভেতরটা দেখিয়ে দিচ্ছে। রাজনীতিবিদের প্রকৃত পোষাক মানুষেরে চোখে ধরা পড়ছে।
তাই রাজনীতিবিদ যেহেতু একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠির নেতা, সে কারণে মানুষ তাকে ভয় পাচ্ছে, বেচে থাকার স্বার্থে তার কাছে যাচ্ছে কিন্তু অন্তরে স্থান দিচ্ছে না।
আর কোন সমাজে মানুষের অন্তর থেকে যদি রাজনীতিবিদের প্রতি সম্মান উঠে যায় তাহলে তার প্রবল ধাক্কা এক সময়ে গিয়ে পড়ে রাজনীতির ওপর। অর্থাৎ এর একটা পর্যায়ে গিয়ে মানুষ রাজনীতিকেই অপছন্দ করবে। কারণ, অন্তরে ভালোবাসা না থাকলে ওপরে বেশিদিন সম্মান দেখানো যায় না। তাই অন্তর থেকে অবস্থান চলে গেলে বাইরের থেকে তা চলে যেতে বড়জোর কিছু দিন মাত্র সময় নেয়।
অন্যদিকে মানুষ ও সমাজ যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী তাই মানুষের অন্তরের চাহিদা অনুযায়ী সমাজ মোড় নেয়। ওই মহাভারতে যাকে ব্যসদেব দেখিয়েছেন, বাসুকি নাগের পাশ ফেরা বলে। অর্থাৎ সমাজ নিজেকে নিজেই বদলে নেয়। সেই বদলে নেয়াতে যে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদ থাকবেন না তা নয়। তবে নতুন আরেকটি শ্রেনী ও আরেক ধরনের রাজনীতি আসে। যা ইতোমধ্যে পৃথিবীর অনেক দেশে যাত্রা শুরু করেছে।
এ কারণে বর্তমানের এই অবস্থার জন্যে শুধু রাজনীতিবিদদের আচরণের দোষও বিনা গবেষণায় দেয়া উচিত নয়। কারণ, পৃথিবীতে প্রযুক্তি, বানিজ্য ও চলাচলের পরিবর্তনের ফলে মানুষের মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে এ পরিবর্তনের ঢেউ সবখানে লাগবেই। পরিবর্তনের ঢেউ কখনই থামানো যায় না।
সমাজের পরিবর্তনের লক্ষণগুলোর ভেতর কোন কোনটার চরিত্র অনেকটা নলকূপের পানিতে ময়লা আসা শুরুর মতো। তাই নব্বইয়ের দশকের রাজনীতিবিদদের মান সম্মান ছিলো গুরুত্বপূর্ণ এখন রাজনীতিবিদের টিকে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আর টিকে থাকতে হলে অবশ্যই মানুষের অন্তরের সম্মান দরকার।
আর নব্বইয়ের দশকের আগে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা যেভাবে সম্মান উপভোগ করেছেন তা তো এখন আর সম্ভব নয়। কারণ, গণতন্ত্রের আবেদন, স্বৈরতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা এসব কিছুর সংজ্ঞ বদলে গেছে মানুষের কাছে। মানুষ এখন এক কঠিন বাস্তবতার পাথরের ওপর দাঁড় করাতে পেরেছে নিজেকে। অর্থাৎ মানুষ নিজেকে এগিয়ে নিয়েছে। সে এখন কেবল একটি ক্ষীণ রশিতে বাধা দূরন্ত ঘোড়া।
লেখক: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present world.
Leave a Reply