সুমন চট্টোপাধ্যায়
এমন সার্বিক নৈরাশ্যের মধ্যেও হঠাৎ কিছু কিছু ঘটনা দেখে বেশ আমোদ হয়। ব্যাপারটা যদি ভূতের মুখে রাম নাম হয় তাহলে তো কথাই নেই। সাহেব হলে বলা যেত, স্যাটান চ্যানটিং স্ক্রিপচারস।
অনেক কাল আগে এক মার্কিন কার্টুনিষ্ট, বেন গ্যারিসন, ভারতীয় সাংবাদিকদের ভেড়ার পাল সাজিয়ে একটি কার্টুন এঁকেছিলেন। কার্টুনটি দুনিয়া জুড়ে শোরগোল ফেলে দিলেও ব্যক্তিগতভাবে আমার সেটিকে বেশ স্কুলরুচির শিল্পকর্ম বলে মনে হয়েছিল। অনেক কাল পরে সেই কার্টুনটিকে কালাধার থেকে তুলে এনে এই ফেসবুকে একজন আলোকচিত্রী সাংবাদিক এদেশের ও এ রাজোর সাংবাদিকতাকে ছিছিক্কার করেছেন। ইচ্ছে করলে বলতে পারতাম, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও।’ বলছিনা, কারণ তুতু ম্যায় ম্যায় করে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি গুলিয়ে দিয়ে কোনও লাভ নেই, বরং এই অবকাশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে আমেরিকা আর ভারতের একটা তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে।
গোড়াতেই বলে রাখি, এ বিষয়ে আমেরিকা যদি যৌবনের মাধুরী দীক্ষিত হয় ভারত তাহলে বড়জোর শ্রীমতী ভয়ঙ্করী।
আমেরিকায় সাংবাদিকেরা সেই দুর্লভ প্রজাতি যাদের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ সেদেশের সংবিধান। মার্কিন সংবিধানের পয়লা নম্বর অ্যামেন্ডমেন্টেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কোনও হ্যাঙ্কি-প্যাঙ্কি নেই, সোজা বলে দেওয়া আছে ফ্রিডম অব দ্য প্রেস। ফলে লেখায়, কার্টুনে, ছবিতে ওরা যা খুশি তাই করতে পারেন, শাসকের রক্তচক্ষু অথবা রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক আচরণের দুর্ভাবনা তাদের নেই।
এখানেই শেষ নয়, মার্কিন প্রশাসনের কাছে এই মর্মে যদি কোনও আগাম খবর থাকে যে কোনও মিডিয়ায় এমন কিছু প্রকাশিত হতে চলেছে যার ফলে দেশের সুরক্ষা বিঘ্নিত হতে পারে তাহলেও সেই মিডিয়ার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাবেনা, খবর না ছাপানোর অনুরোধও নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন পোস্টের হ্যারিসন সলসবেরি ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন, শত্রু-বাহ অতিক্রম করে গিয়ে একের পর এক প্রতিবেদনে তিনি লিখতে শুরু করলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের অগ্রগতি নিয়ে জনসন প্রশাসন মার্কিনদের যা বলে চলেছে তা আসলে চপের চপ, এ যুদ্ধে আমেরিকা অবধারিতভাবে হারছে। পুলিৎজার কমিটি সলসবেরিকে পুরস্কৃত করেনি তাঁর রিপোর্টিংকে দেশ বিরোধী আখ্যা দিয়ে। কিন্তু তাতে কী! সলসবেরির লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরেই মার্কিন মুলুকে জনমত ঘুরতে শুরু করে, অচিরে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। পেশাদার সাংবাদিকের আনুগত্য যে কারও প্রতি নয়, এমনকী স্বদেশের প্রতিও নয়, এ হচ্ছে তার অনন্য নজির।
সুরক্ষার শেষ এখানেই নয়। আমেরিকায় সরকার এমন কোনও আইন আনতে পারবেনা যার বলে তারা কোনও মিডিয়াকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনও কিছু ছাপতে বাধ্য করতে পারে। দুই, জনস্বার্থ সম্পর্কিত সত্য সংবাদ প্রকাশের জন্য সংবাদপত্রের ওপর ফৌজদারি অথবা দেওয়ানি, কোনও রকম ক্ষতিপূরণই চাপাতে পারবেনা। এমনকী কোনও উচ্চপদস্থ সরকারি ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি অসত্য ও ক্ষতিকারক খবর ছাপা হয় তথাপিও নয়। তিন, অন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে ধার্য হয়না এমন কোনও কর সংবাদপত্রের ওপর চাপানো চলবেনা। চার, খবরের ‘সোর্স’ জানানোর জন্য সাংবাদিকের ওপর কোনও রকম চাপ সৃষ্টি করা যাবেনা। পাঁচ, আদালতকক্ষে সাংবাদিকদের অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে, আদালতের কার্যবিবরণী প্রকাশ করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতাও থাকবে তাদের। এই যে মহার্ঘ প্রাপ্তিগুচ্ছ, এটা মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের অবদান যারা ফ্রিডম অব দ্য প্রেস যে কোনও মূল্যে রক্ষার প্রশ্নে যতটা সতর্ক ততটাই তৎপর।
এবার দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্র জননী জন্মভূমির দিকে চোখ ফেরানো যাক। ভারতীয় সংবিধানে আমেরিকার মতো স্পষ্ট করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলাই নেই। আমাদের সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় কেবল বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখার কথা বলা আছে। সাংবিধানিক পরিষদে এ নিয়ে আলোচনার সময় ড্রাষ্টিং কমিটির চেয়ারম্যান আম্বেদকার বলেছিলেন, আলাদা করে সংবাদপত্রের নামোল্লেখ অপ্রয়োজনীয় কেননা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে, ব্যক্তি অথবা সংবাদপত্রের মধ্যে তারতম্য বিধানের প্রশ্ন ওঠেনা। ভাবলে অবাক লাগে আম্বেদকারের এমন সর্বনাশা ব্যাখ্যা বাকি সবাই মেনে নিয়েছিলেন, মায় জওহরলাল নেহরুও।
নাকের বদলে আমরা এই যে নড়ুনটি পেলাম তাকেও আগাপাশতলা শেকল পড়িয়ে প্রায় পঙ্গু করে দেওয়া হোল স্বাধীনতার সূচনা থেকেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া হোল বটে সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হোল কিছু বিরক্তিকর বিধিনিষেধ কেতাবী ভাষায় রিজনেবল রেষ্ট্রেইন্ট।। যেমন এমন কিছু বলা বা লেখা যাবেনা যা দেশের ঐক্য অথবা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কিছু করা চলবেনা, বহির্বিশ্বের বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের কথা মাথায় রাখতে হবে, মাথায় রাখতে হবে পাবলিক অর্ডার, ডিসেন্সি, মরালিটি, আদালত অবমাননা, মানহানি এবং উত্তেজনা অথবা হিংসায় কোনও রকম প্ররোচনা না দেওয়ার কথাও। অর্থাৎ এক হাত দিয়ে মুষ্টিভিক্ষা দিয়ে অন্য হাতে সেটুকুও কেড়ে নেওয়া হোল। এই যে গুচ্ছের বিধি-নিষেধ সেগুলিই হয়ে উঠল রাষ্ট্রের সবক শেখানোর অস্ত্র। প্রতিটি বিধি-নিষেধই ‘সাবজেকটিভ’, যে যার অবস্থান থেকে তা সুযোগমতো ব্যবহার করতে পারে। এরপরে গত ৭৫ বছরে নানা সময়ে যে সব দানবিক আইন দেশে লাগু হয়ে নাগরিককে ক্রীতদাসের স্তরে নামিয়ে আনার চেষ্টা হয়েছে, তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম।
এই বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রাখলে ভারতীয় মিডিয়ার দুর্বলতা কিংবা অসহায়তার উৎসে পৌঁছন সম্ভব। সত্যিকারের স্বাধীন মিডিয়া বলতে যা বোঝায় কস্মিনকালে ভারতে তার অস্তিত্ব ছিলনা। সেই কারণেই ভারতে কোনও নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো কাগজ নেই, কোনও দিন হবেওনা। খন্ডিত, সঙ্কুচিত, পদে পদে অবদমিত স্বাধীনতা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যতটুকু এগোন সম্ভব আমরা ততটুকুই এগিয়েছি। আর বর্তমানে যে ছবিটি দেখছি তাতে না আছে নতুনত্ব না অভিনবত্ব। ইন্দিরা গান্ধির জমানায় বিশেষ করে জরুরি অবস্থাকালে এর চেয়ে অনেক কঠিন সময় ভারতের মিডিয়াকে পার হয়ে আসতে হয়েছে। তদোপরি গোটা বিশ্বজুড়ে, এমনকী উদারমনা আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপের অনেক দেশেই গণতন্ত্র আজ নতুন বিপন্নতার সম্মুখীন। সব দেখে শুনে মনে হয় কোনও এক অশুভ, অদৃশ্য শক্তি যেন ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দিতে মরীয়া।
তাই পরিপ্রেক্ষিত ভুলে, বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, বেচারা সাংবাদিকদের গালপাড়া হাস্যকর। দাক্ষিণ্যলোভী, চাটুকার, রাজাকে কু-মন্ত্রণা দেওয়া সাংবাদিক সব যুগে ছিল, আজ হয়ত তাদের সংখ্যা কিঞ্চিৎ বেড়েছে। একাদিক্রমে চল্লিশ বছর এই পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে দায়িত্ব নিয়ে বুক চিতিয়ে বলতে পারি ক্ষমতার পদলেহিরা সংখ্যায় নগন্য, নিজেদের পেশাতেই হয় উপহাস নয় করুণার পাত্র। বাকি যে সংখ্যাগুরু সাংবাদিককুল, যাদের সংখ্যা নব্বই-পঁচানব্বই শতাংশও হতে পারে, সুযোগ আর চাকরির নিরাপত্তা পেলে তারা প্রত্যেকে গেরিলার মতো সত্যান্বেষণে বের হবেই। আমি তাদের চোখের দৃষ্টিতে, শক্ত চোয়ালে, স্পষ্ট সেই প্রাত্যয় দেখতে পাই। কিন্তু এটা তো ঘোড়া আগে না গাড়ি তার প্রশ্ন নয়, জীবিকার প্রশ্ন। নিজের দোষে বা গাফিলতিতে আজ এরা পঙ্গু হয়ে যায়নি অবর্ণনীয়, শ্বাসরোধকারী একটা চাপিয়ে দেওয়া তালিবানি ব্যবস্থার শিকার এরা। সম্মান না করুন এদের অসম্মান করবেননা।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক,সাবেক নির্বাহী সম্পাদক আনন্দবাজার পত্রিকা
Leave a Reply