মাক্সিম গোর্কি
পুরনো এক আঙুর-বাগিচার ঘন পল্লবের মধ্যে লুকনো শাদা রঙের ক্যান্টিনটার দরজার পাশে এক জগ মদ নিয়ে বসে আছে ভিন্চেজে। আর জিয়োভান্নি। ভিনচেজে। ঘর রঙ করার কাজ করে, জিয়োভারি টার্নার। বাজারে টেবিলটার মাথার ওপরে আঙুরলতার চাঁদোয়া, তার সঙ্গে নিশে আছে কনভলভুতুলাস আর ছোটো ছোটো চীনে গোলাপ। ভিন্চেন্জা দেখতে ছোটোখাটো, হাড় বার করা গাঢ় রঙ। কালো চোখ দুটোয় স্বপ্নাতুরের মৃদু হাসি। ওপর ঠোঁট আর গালের কামানো দাড়ি গোঁপের কালচে নীল আভা সত্ত্বেও সে হাসিতে তার মুখখানায় কেমন একটা সরল ছেলেমানুষী ভাব ফুটে ওঠে। হাঁ-মুখটা তার ছোটে। সুকুমার মেয়ের মতো, হাত দুখানা লম্বাটে। চঞ্চল আঙুলগুলো তার খেলা করে একটা সোনালী ফুল নিয়ে। ফুলটাকে সে তার ভরাট ঠোঁটের ওপর চেপে ধরে চোখ বেঁজে।
আস্তে করে বলে, ‘তা সম্ভব। আমি ঠিক জানি না, তা হতে পাবে।’ দীর্ঘ লম্বাটে মাথাটা সে নাড়ে। চওড়া কপালের ওপর এসে পড়ে তার লালচে চুলের কোঁকড়া কোঁকড়া স্তবক। জিয়োভান্নি বলে, ‘আরে খাঁ।, হ্যাঁ। যতো উত্তরের দিকে এগুবে, ততোই শক্ত শক্ত মেজাজের লোক দেখা যাবে।’ অগ্রবরস জিয়োভান্নির, মাথাখানা বড়ো, চওড়া কাঁধ, কোঁকড়া কালো চুল। মুখের রঙ তামাটে, রোদ পোড়া নাক থেকে শাদা শাদা মরা চামড়া উঠে যাচ্ছে, ঘাঁড়ের মতো নিরীহ বড়ো বড়ো চোখ। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা নেই। হাতগুলো তার মেশিনের তেল আর লোহার গুঁড়োয় কালি-মাখা। যে হাত যেমন ধীরে নাড়াচাড়া করে ও. কথাও বলে তেমনি ধীরে। ভাঙা ভাঙা নখওয়ালা কালো কালো আঙুলে মদের গেলাস চাপ দিয়ে ধরে ও কথা বলে চলে তার ভারি মোটা আওয়াজে:
“মিলান, তুরিন – চমৎকার, চমৎকার সব কারখানা, আর নতুন রকমের সব মানুষও গড়ে উঠছে সেখানে, নতুন একটা মাথা জেগে উঠছে। কিছু দিন সবুর কর, দেখবি সারা দুনিয়াটা আরো ভালো হয়ে উঠবে, আরো বিচক্ষণ।’
‘হ্যাঁ’, বললে বেঁটেখাটো ভিচেজো। তার পর রোদের একটা ঝলকের দিকে গেলাসটা উঁচু করে ধরে গাইতে শুরু করল:
প্রথম যবে নয়ন মেলি বিশ্বভুবন খানা উষ্ণ কোমল হাসে! হায়রে, তবু দিন যে ফুরোয়, বয়স পেরোয়, মাটি শীতল হয়ে আসে।
শোনো বলি, বতো উত্তরের দিকে যাবে, ততই ভালো কাজ। ফরাসীরা আমাদের মতো আলসে নয়, তারপর ধরো জার্মানদের, তারপর ঐ রাশিয়ানদের। জাত বটে একখানা।’
‘অত্যাচার চলেছে, নিপীড়ন চলেছে, জান সান স্বাধীনতা হারাবার ভয় তোয়াক্কা না করে বড়ো বড়ো ব্যাপার ঘটিয়েছে ওরা। ওদের জন্যেই দ্যাখো সারা পূর্ব দেশ জেগে উঠল।’
বাথা নুইয়ে ভিনচেৎজো বললে, ‘খাহাদুরের দেশ। ইচ্ছে হয়, ওখানে গিয়ে থাকি…’
‘তুই গিয়ে থাকবি।’ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে হাঁটুর ওপর চাপড় মেরে চেঁচিয়ে উঠল টার্নার, ‘এক হপ্তার মধ্যেই জমে বরফ হয়ে যাবি।’
দুজনেই হেসে ওঠে দরাজভাবে।
ওদের চারপাশে নীল সোনালী ফুল ফোটা। বাতাসে কাঁপে সূর্যকিরণ, কাচের পাত্রে ও গেলাসে ঝিলিক দেয় আলমান্দি মদ আর দূর থেকে ভেসে আসে সমুদ্রের কানাকানি।
উদার হাসি হেসে টার্নার বলে, ‘তবে শোেন, ভিন্নজো, বলি কি করে আমি সোশ্যালিস্ট হলাম। তুই এটা কবিতা করে লেখ। গল্পটা জানিস?’
রঙ-মিস্ত্রি বলে, ‘না তো’। গেলাসের মধ্যে মদ ঢালে সে, লাল স্রোতোধারার দিকে তাকিয়ে হাসে, ‘আমাকে কখনো তো বলিসনি। সমাজতন্ত্রের খোলসটা তোর হাড়ে মজ্জায় এমন এঁটে বসা, যে আমার তো ধারণা তুই সমাজতন্ত্রী হয়েই বুঝি জন্মেছিস!’
‘তোরই মতো, সকলের মতোই বোকা আর ন্যাংটা হয়েই আমি জন্মেছিলাম। বড়োলোকের একটি মেয়েকে বিয়ে করব বলে স্বপ্ন দেখতাম জোয়ান বয়সে। সৈন্য দলে যখন ছিলাম, তখন প্রাণপণে খাটতাম যাতে অফিসারের পরীক্ষা পাশ করতে পারি। তারপর আমার বয়স যখন তেইশ, তখন টের পেতে লাগলাম দুনিয়ার ব্যাপার-স্যাপার তো ঠিক ‘সব ঠিক হ্যায়’ গোছের নয়, এ ব্যাপারে বোকাহাবা হয়ে জীবন কাটানো বড়ে। লজ্জার কথা হবে।’
রঙ-নিস্ত্রি টেবিলের ওপর কুনুই রেখে ঝুঁকে বসে, আর মাথাটা ভুলে তাকায় পাহাড়ের দিকে, পাহাড়ের একেবারে চুড়োয় যেখানে বড়ো বড়ো পাইন গাছগুলো শাখা দোলাচ্ছে, সেখানে।
‘আমাদের ইউনিটটাকে পাঠানো হয়েছিল বোলোনিয়াতে। ওখানকার চার্থীরা গণ্ডগোল লাগিয়েছিল, কেউ বলছিল খাজনা কমাতে হবে, কেউ চাইছিল নজুরি বাড়াতে হবে। আমার ধারণা ছিল, ও দুটো কথাই ভুল। জমির খাজনা কমিয়ে মজুরি বাড়ানে। আজগুবি ব্যাপার বলে আমার মনে হয়েছিল। জমিদারদের যে সর্বনাশ হয়ে যাবে তাহলে … আমি শহরের লোক, আমার কাছে সব ব্যাপারটা বেদম নির্বুদ্ধিতা বলে মনে হল। তাছাড়া গরম আবহাওয়া, অনবরত এখন থেকে ওখানে বদলী, রাত্রে পাহারার কাজ- কেননা লোকগুলো জমিদারদের হাল-লাঙল ভাঙছিল, ফসল পোড়াচ্ছিল, নিজেদের সম্পত্তি বাদে যা কিছু পাচ্ছিল ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল- এই সব মিলিয়ে আমারও রাগ ধরে গিয়েছিল খুব।’ অল্প অল্প চুমুক দিয়ে মদ শেষ করে ও। তারপর চাঙ্গা হয়ে বলে যেতে থাকে:
‘ভেড়ার মতো পালে পালে ওরা ঘুরে বেড়াত মাঠে। মুখে কথাটি নেই, গোমড়া মুখ-যে কাজটা করবে তা করবে। আমরা ওদের ছত্রভঙ্গ করতাম সঙ্গীন দেখিয়ে, কখনো কখনো রাইফেলের কুঁদো দিয়ে গুঁতিয়ে। ওরা কিন্তু ভয় পেত না। ধীরে সুস্থে চলে যেতো, ফের জমায়েত হত আবার। গির্জায় মহোপাসনার মতো একঘেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপারটা। দিনের পর দিন এমনি চলল যেন সান্নিপাতিক অব। আমাদের করপোরাল ছিন ল্যুতো, খাসা লোক, দাড়ি থাকুঞ্জি, নিজেও চার্থী, সমস্ত ব্যাপারটায় ভয়ানক খারাপ লার্নছিল তার। কাহিল হতে লাগল ও.. চেহারা দিচ্ছিরি হয়ে গেল, দেখাত ভীষদ
করুণ। ‘বলত, “বিচ্ছিরি ব্যাপার ছে, মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত গুলিয় চালাতে হবে। ধুত্তোরি যতো সব।”
‘ওর বকবকানিতে আমরাও আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠছিলান। তাছাড়া প্রতিটি কোণ্য-কানাচে, প্রতিটি পাহাড় আর গাছের ওপর থেকে ঐ গোয়ার-গোবিন্দ চাষাগুলো মাখা বার করে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত আমাদের দিকে, দুচোখে ঘৃণা। স্বভাবতই আমাদের ওপর ওদের খুব একটা সুনজর ছিল না।’
তিনচেজে। বলে, ‘নে খা।’ বলে পুরো একটা গেলাস এগিয়ে দেয় বন্ধুর দিকে।
টার্নার বলে, ‘ধন্যবাদ। শক্ত লোকেদের স্বাস্থ্যের জন্যে।’ মদটা গিলে হাত দিয়ে মোচটা মুছে নিয়ে যে বলে যায়:
‘একদিন আমি দাঁড়িয়ে আছি একটা জলপাই কুঞ্জের পাশে টিলার ওপর, গাছগুলে। পাহারা দিচ্ছিলাম, কেননা বাগে পেলেই চাষীরা গাছগুলো পয়মাল করে ছাড়ছিল। টিলাটার নিচে গর্ত খুঁড়ছিল দুটো চাষা- একজন বুড়ো, একজন জোয়ান। দিনটা ছিল ভারি গরম, আগুনের মতো জ্বলছে সূর্য-সেই রকম একটা দিন যখন ইচ্ছে করে মাছ হয়ে জলের তলে গিয়ে থাকি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই দুটোর কাজ দেখতে দেখতে বিরক্ত ধরে যাচ্ছিল, রাগ হয়ে যাচ্ছিল। দুপুরে ওরা কাজ থামিয়ে বার করলে কিছু রুটি, পনীর আর এক জগ নদ। মনে মনে বললাম আমি, গোল্লায় যা তোরা! বুড়ো লোকটা এতক্ষণের
মধ্যেও একবারও আমার দিকে চায়নি। হঠাৎ যে কি যেন বললে ছোকরাটাকে। ছোকরাটা মাথা নাড়লে, তাতে বুড়োটা ধমকের মতো করে চেঁচিয়ে উঠল:
“যা বলছি!”
‘ছোকরাটা আমার কাছে এল জগটা নিয়ে। গলার স্বরটা তার বিশেষ প্রসন্ন নয়।
‘বললে, “বাবা ভাবছে, তোমার হয়ত তেষ্টা পেয়েছে, সেই জন্যে কিছু মদ পাঠিয়ে দিল।”
‘ব্যাপারটা বিব্রত করে তোলার মতো, কিন্তু ভালোও লাগল। দান প্রত্যাখ্যান করে আমি বুড়োটার দিকে মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানালাম। কিন্তু আকাশের দিকে মুখ তুলে বুড়োটা বললে:
“থাও সিনোর, খেয়ে নাও! সৈন্য বলে তোমাকে এটা দিচ্ছি তা নয়, দিচ্ছি মানুষটাকে। আমাদের কাছ থেকে মদ খেলে সৈন্যেরা যে দয়ালু হয়ে উঠবে তা আমরা ভাবি না।”
‘মনে মনে বললাম, “শালা হুল ফোটাচ্ছে দ্যাখো!” তারপর এক ঢোক মদ খেয়ে ওদের ধন্যবাদ জানালাম, ওরা পানাহার করতে লাগল নিচে গিয়ে। কিছু পরে হুগো এল আমার বদলী নিতে- হুগোর বাড়ি ওই সালের্নো। হুগোকে আস্তে করে বললাম, ওই চাষা দুটো লোক ভালো। সেইদিন সন্ধেবেলা, যেখানে চাষের যন্ত্রপাতি রাখা হত সেই চালাটায় যখন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন ছাতের ওপর থেকে কয়েকটা টালি এসে পড়ল আমার ওপর। একটা পড়ল মাথায়, সেটা খুব জোরে লাগল না। কিন্তু আর একটা আমার বাঁ কাঁধের ওপর এমন জোরে এসে লাগল যে হাতখানা অসাড় হয়ে গেল।’
আকর্ণবিস্তার মুখ করে হাসতে লাগল টার্নার, চোখ দুটো কুতকুতে হয়ে এল তার। হাসতে হাসতে বললে:
‘ঐ এলাকাটায় সে সময় টালি, লাঠি আর পাথর যেন প্রাণ পেয়ে ঘুরে বেড়াত। জড় বস্তুর প্রতিহিংসায় আমাদের কয়েকজনের মাধ্য ফুলে উঠেছিল মোক্ষন। সৈন্যটা হয়ত কোথাও যাচ্ছে কিংবা দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে লাফিয়ে এসে ঘা মারত লাঠি, নয়ত আকাশের কোথা থেকে নেমে আসত ঢিল। স্বভাবতই এতে ক্ষেপে যেতাম আমরা।’
ছোটোখাটো দেখতে রঙ-মিস্ত্রির দুচোখে ফুটে উঠল একটা বিষাদের দৃষ্টি, মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে এল তার। মৃদুস্বরে বললে: ‘এই সব কথা শুনলেই কষ্ট লাগে…’
‘উপায় নেই। লোকের চৈতন্য হয় খুব ধীরে ধীরে। কিন্তু যা বলছিলাম। সাহায্যের জন্যে চিৎকার করতে লাগলাম আমি। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল একটা বাড়িতে। আমাদেরই আর একজনও সেখানে শুয়ে। পাথরে ওর মুখখানা কেটে গেছে। কি করে হল জিগ্যেস করায় ও একটু শুকনো হেসে বললে:
“একটা বুড়ির কীতি দোস্ত, পাকাচুল এক ডাইনী পাথর ছুঁড়ে মেরে তারপর বলে কিনা, আয় আমায় খুন কর।”
“”গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওকে?” জিগ্যেস করলাম।
“না, আমি বলেছি, আমি নিজেই পড়ে গিয়ে চোট খেয়েছি। আমাদের কম্যান্ডার অবিশ্যি তা বিশ্বাস করেনি। যেমন করে আমার দিকে চাইছিল, তাতেই টের পেয়ে গেছি। কিন্তু কি করে কবুল করি যে একটা বুড়ি মেয়ে এসে আমার মারল! ধুত্তোরিকার। জীবন ওদের বড়ো কষ্টের, কেন যে আমাদের ঘেন্না করে তা বেশ বুঝি।”
‘আমি মনে মনে ভাবলাম, এই ব্যাপার তাহলে। খানিক বাদে একটি ডাক্তার এল, সঙ্গে দুজন মহিলা। একজন দেখতে ভারি সুন্দর, কটা চুল, ডেনিসিয়ান বলে মনে হয়, অন্য জন কেমন ঠিক মনে নেই। ওরা আমার কীর পরীক্ষা করে দেখল- বিশেষ কিছু যে হয়নি তা বলাই নায়লা। কর্তৃপ্রেস লাগিয়ে ওরা চলে গেল।’
ভুরু কুঁচকে চুপ করে যায় টার্নার। হাত দুখানা ঘসতে থাকে প্রজোরে। মদের গেলাস দুটো আবার ভর্তি করে দেয় বন্ধু। মদ ঢালার গ্রহয় জগটা এত উঁচু করে ধরে যে সুরার রক্তিম ধারাটা কাঁপতে থাকে বাতাসে।
বিষণ্ণভাবে বলে যাব চার্নার, ‘আমি আর আমার সাথী বসে- ছিলাম জানলার পাশে। আমরা ছিলাম রোদের আওতা থেকে দূরে, ছায়ার মধ্যে। বাগানের মধ্যে সেই সুন্দরী মেয়েটি আর তার বন্ধু পায়চারি করছিল ডাক্তারের সঙ্গে। সুন্দরী মেয়েটির কথা কানে আসছিল আমার- ওরা বলছিল ফরাসী ভাষায়, ভাষাটা আমারও বেশ ভালো জানা ছিল।
‘শুনলাম মেয়েটি বলছে, “ওর চোখ দুটো দেখেছিলে? ও-ও একজন চাষী, নিশ্চয় ইউনিফর্ম খুলে ফেললেই ও ঠিক অন্য সকলের যতোই সোশ্যালিস্ট হয়ে উঠবে। অমনি ধারা যাদের চোখ তারা সারা দুনিয়া দখল করতে চায়, সব ‘কিছু বদলে দিতে চায়, আমাদের তাড়িয়ে দিয়ে আমাদের সর্বনাশ ঘটাতে চায়, ভাবতে কেমন লাগে। জার এ সব কিছু করতে চায় কিনা একটা বিচারের নাম নিয়ে!” নির্বোধ, অন্ধ, ন্যায় ডাক্তার বললে, “বোকাসোকা লোক সব – আধখানা শিশুর
মতো, আধখানা জন্তর মতো!”
“জত্তর মতো, ঠিকই। কিন্তু শিশুর মতো কি দেখলেন ওদের মধ্যে?”
“মানে ঐ সব বিশ্ব সান্যের স্বপ্নগুলোর কথা বলছি…” ‘মহিলাটি চেঁচিয়ে উঠল, “ভেবে দেখুন একবার। আমি কি না ওই ঘাঁড়-চোখো লোকটার সঙ্গে সমান, ঐ পাখির মতো মুখওয়াল। লোকটার সমান, আমরা সকলেই, আপনি, আমি, যে, সবাই আমরা। সমান কিনা ওদের সঙ্গে, ঐ যতো বাজে লোকগুলোর সঙ্গে। ভাড়া করে এনে যে লোকগুলোকে দিয়ে তাদেরই ভায়েদের খুন করানো যায়, খুন করানো যায় ওদেরই মতো জন্তুগুলোকে…”
‘মেয়েটি অনেক কথা বলে গেল, বলল বেশ উত্তেজনার সঙ্গে। শুনতে শুনতে আমি মনে মনে ভাবছিলাম, “হায় সিনোরা।” ওকে আমি আগেও দেখেছিলাম, আর জানিস তো, মেয়ের কথা সৈন্যরা কি তীব্রভাবেই না ভাবে। স্বভাবতই আমি ভেবেছিলাম মেয়েটির বেশ নরম মন হবে, দয়ামায়া থাকবে, বুদ্ধিও থাকবে, কেননা সে সময় আমি ভাবতান, উঁচু জাতের লোক হলেই সে বুদ্ধিমান হবেই হবে।
‘সঙ্গীকে জিগ্যেস করলাম, “ওরা কি বলছে তা ও বুঝতে পারছে কি না?” লোকটা ফরাসী জানত না। আমি যখন তাকে বললাম, সুন্দরী মেয়েটি কি বলেছে, তখন ভয়ানক রেগে উঠল সে। লাফিয়ে উঠে পায়চারি করতে লাগল ঘরের মধ্যে, জ্বলতে লাগল চোখগুলো, মানে একটা চোখই জ্বলতে লাগল, কেননা অন্য চোখটা ব্যাণ্ডেজ করে বাঁধা।
‘ও ফুঁসতে লাগল, “এই কথা তাহলে! আমাকে কাজে লাগাতে কসুর নেই, কিন্তু মানুষ বলে গণ্য করা চলবে না তাহলে। ওঁর জন্যে আমি সেপাইগিরির অপমান সইছি, আর আমার আত্মসম্মান উনি চলছেন পা মাড়িয়ে। মানুষের মর্যাদাও উনি আমাকে দিতে চান না। ওঁরই সম্পত্তি রক্ষা করার জন্যে আমি আমার বিবেক পর্যন্ত হারাতে বসেছি…”
লোকটা অনুপ্ত ছিল না। ভয়ানক অপমানিত লাগছিল এব।
ধামারও। পরের দিন আমরা খোলাখুলিই ওই মহিলাটি সম্পর্কে
আলাপ করলাম, কিছুই রাখা ঢাকা না করে। ল্যুতো বিড়বিড় করে
কি বলবে, তারপর সাবধান করে দিলে আমাদের। ‘ভুলে যেও না হে। তোমরা হলে সৈন্য, ডিসিপ্লিন বলে একটা জিনিস আছে!”
তুলে আমরা যাইনি, কিন্তু সেই দিন থেকে আমরা অনেকে, সত্যি কথা বলতে গেলে প্রায় সবাই এমন হয়ে গেলাম যেন বোবা ভাণা। আমাদের এই হঠাৎ রাশ ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নিলে চাখারা। দাবি ওরা জিতল। আমাদের সঙ্গে খুব ভাব জমাতে লাগল ওরা। সুন্দরী মহিলাটি ওদের কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারতেন। যেমন ধরো, কি করে সৎলোকের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় তা ওঁকে ওরা শেখাতে পারত। তারপর আমরা যারা রক্ত ঝরাবার জন্যে গিয়েছিলাম সেই আমরা যখন অবশেষে ওখান থেকে বদলী হয়ে গেলাম, তখন অনেকেই আমরা উপহার পেলাম ফুল। গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে আমরা যখন কদম ফেলে চলেছি, তখন ঢিল আর টালির বদলে ওরা আমাদের ফুল মারতে লাগল ছুঁড়ে ছুঁড়ে। ঐ ফুলগুলো হল আমাদের রোজগার। বিরূপ অভ্যর্থনার কথাটা আমরা ভুলে গেলাম এই চমৎকার বিদায় অভিনন্দন পেয়ে।’
জিয়োভান্নি হাসে। বলে:
‘এই হল কাহিনী, এ থেকে একটা কবিতা বানিয়ে দে,
ভিন্ চেজ্যে…’
চিন্তার হাসি হেসে রঙ-মিস্ত্রি বলে:
‘ঠিকই, কবিতা বানাবার মতোই মালমশলা। হয়ত পারা যাবে। পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেলে প্রেমের কবিতা তেমন আসে না।’
হাতের ফুলটা তার এতক্ষণে দলামোচড়া হয়ে এসেছে। সেটা ফেলে দিয়ে আর একটা ছিঁড়ে নেয় সে। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলতে থাকে:
‘মায়ের বুক থেকে প্রেমিকার বুক-এই সবখানি পথ যখন মানুষ পার হয়ে আসে তখন অন্যতর এক সুখের দিকে তার যাওয়া উচিত…’ওর সঙ্গী গেলাসের মদটায় একটু ঝাঁকি দেয়, কিছু বলে না। আঙুর-বাগিচা পেরিয়ে কোমল মর্মর ওঠে নিচের সমুদ্র থেকে। কবোষ্ণ বাতাসে ভাসে ফুলের গন্ধ।
‘আমরা যে এত নরম, এত আলসে সে ওই সূর্যের জন্যে।’ অস্ফুট স্বরে বলে টার্নার।
ভিচেনজে। তার সুক্ষ্ম এ জোড়া কুঁচকে মৃদু স্বরে বলে, ‘ভালো প্রেমের কবিতা আমি আর লিখতে পারছি না, নিজের ওপর এমন রাগ ধরে যাচ্ছে।’
‘কিছু লিখেছো নাকি?’
রঙ-মিস্ত্রির কাছ থেকে সঙ্গে সঙ্গে জবাব পাওয়া যায় না। অনেকক্ষণ পরে সে বলে, ‘হ্যাঁ, কালকে এসে গেল কবিতাটা, “কমো” হোটেলের ছাদের ওপর।’
তারপর মৃদু তন্ময় সুরেলা গলায় ও আবৃত্তি করে যায়:
নির্জন তটভূমি, প্রাচীন ধূসর শিলাতটের দিকে চেয়ে কোমল বিদায়-বাণী বলে হেমন্তের সূর্য, অন্ধকার পাথরের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে ক্ষুধিত তরঙ্গ সূর্যকে ধৌত করে দিতে চায় সমুদ্রের নীল শীতল জলে।
তামারঙা পাতা বারে হেমন্তের বাতাসে মৃত পাখির উজ্জ্বল শবের মতো ভেসে যায় জোয়ারের ফেনায়, ক্রুদ্ধ সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকে এক বিষণ্ণ বিবর্ণ আকাশ, শুধু হাসে সূর্য, ধীরে ধীরে বিশ্রামের কোলে ডুবে যেতে যেতে।
দীর্ঘ বিরতি নেমে আসে; মাটির দিকে চেয়ে মাথা নুইয়ে থাকে রঙ-মিস্ত্রি। হৃষ্টপুষ্ট টার্নার হাসে, তারপর বলে:
‘অনেক জিনিস নিয়েই ভালো কিছু লেখা যায়, কিন্তু সবচেয়ে ভালো লেখা মানুষকে নিয়ে, সবচেয়ে ভালো হয় ভালো মানুষদের গান!’
Leave a Reply