নিজস্ব প্রতিবেদক
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানী গুলশানে হোটেল রেঁনেসায় ব্র্যাক আয়োজিত এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।সেমিনারে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু নিয়ে তাদের বক্তব্যে প্রদান করেন। ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচারক আসিফ সালেহ্ সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন। সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাকের কর্মকর্তা এবং অনেক সাংবাদিকরা।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ । প্রধান অতিথি ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় (ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান) স্বাস্থ্য খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা কাজ করছি। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হবে যাতে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার খাতগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে সক্ষমতা এবং সচেতনতা তৈরি করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ চরম তাপপ্রবাহের প্রভাব মোকাবেলায় আরও ভালভাবে প্রস্তুত হতে পারে।” তিনি বলেন, “প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানগুলির উপর জোর দিয়ে অবকাঠামো এবং নকশা প্রণয়নের জন্য প্রকৌশলী এবং স্থপতিদের প্রস্তুত করতে হবে। আমাদের বর্তমান অবকাঠামোগুলোকে নতুন করে সাজাতে হবে এবং তাপ উৎপাদন কমাতে নতুন প্রযুক্তি আনতে হবে।”
তাপপ্রবাহের কারণ ও পূর্বাভাস নিয়ে অনলাইনে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপক এলফাতিহ এ. বি. এলতাহির ও গবেষক ইয়েওন উ চোই। তারা বলেন, “এপ্রিল-মে হচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের সময়, যখন পানির ঘাটতি দেখা দেয় এবং তাপমাত্রা বেড়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এমন চরম তাপমাত্রাই স্বাভাবিক হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করা যায়। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মোকাবিলায় এখন থেকেই সব ধরণের প্রস্তুতি নিতে হবে।”
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিন বলেন, “বর্তমানের এই ঢাকা শহর গড়ে তোলার সময় চরম তাপপ্রবাহের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়নি। সীমিত সম্পদ হাতে নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই উন্নয়নের কথা বিবেচনায় রেখে আমাদের সকলকে সমন্বিতভাবে গৃহিত প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করতে হবে।”
বাংলাদেশে এ বছরের তাপপ্রবাহের প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা উপস্থাপন করেন ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, নগর উন্নয়ন কর্মসূচি ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির পরিচালক ড. মো: লিয়াকত আলী। তিনি বলেন, “গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, প্রচণ্ড তাপে বোরো ধানের আবাদ ৬ থেকে ১৬ শতাংশ কমে যেতে পারে। আমের মুকুল ঝরে গেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহে পোলট্রি খাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকার। দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদনে ২৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। তীব্র তাপের কারণে ঢাকা বছরে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের শ্রম উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। এর ফলে, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার মোট উৎপাদনশীলতার ৫ শতাংশ হারাতে পারে, যা প্রায় ৪০ লাখ পূর্ণকালীন চাকরির সমান এবং এর ফলে প্রায় ৪.৯ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি হারাতে হতে পারে।”
সেমিনারে তাপপ্রবাহের কারণ এবং এর প্রতিকার বিষয়ে বক্তব্য রাখেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ধরিত্রী কুমার সরকার, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. শামীম হাসান ভূঁইয়া, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ. কে. এম. সাইফুল ইসলাম। সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার তাপস রঞ্জন চক্রবর্তী।
৭৬ বছরের রেকর্ড ভাঙা তাপপ্রবাহে কৃষি, প্রাণিসম্পদ, স্বাস্থ্যসহ সব সেক্টরই ক্ষতির মুখে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের মোট উৎপাদনশীলতা কমবে ৫ শতাংশ, জিডিপি হারাবে ৫ দশমিক ১ শতাংশ বাংলাদেশে চলতি বছর এপ্রিল মাসে তাপমাত্রার ৭৬ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ, স্বাস্থ্যসহ সব সেক্টরেই ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে প্রচণ্ড গরমে বোরো ধানের আবাদ হুমকির মুখে পড়েছে। আমের মুকুল ঝরে গেছে; দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদনে ২৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। চরম জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘটনা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সহসাই এ থেকে পরিত্রাণের সুযোগ নেই।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, “যে কোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এটি কোভিডের সময় দেখেছি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় দেখেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও দেখছি। যাদের কথা বলার সুযোগ নেই; যাদের কথা শোনার কেউ নেই, তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। দুর্ভাগ্যবশত, এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠি এমন কিছুর জন্য ক্ষতির শিকার হচ্ছে, যার জন্য তারা মোটেও দায়ী নয়।” তিনি বলেন, “আমি সাধুবাদ জানাই আমাদের নীতি নির্ধারকদের, বিশেষ করে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীমহোদয়কে। তারা শুধু বাংলাদেশই নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পক্ষে বৈশ্বিক ফোরামে কথা বলছেন। তবে জলবায়ু অর্থায়ন ও অভিযোজন অর্জনের জন্য আমাদের এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।”
ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারের উদ্দেশ্য ছিল তাপপ্রবাহের বিজ্ঞান-নীতি-অনুশীলন সমন্বয় সম্পর্কে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে অবগত ও সচেতন করা।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি মোকাবিলায় এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি-এর সহযোগিতায় ‘জামিল অবজারভেটরি-ক্রুজনেট’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ব্র্যাকের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে জলবায়ুর আগাম তথ্য সরবরাহ করে জলবায়ু বিপদাপন্ন এলাকার জনগোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলারত স্থানীয় কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠী এবং এমআইটির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জ্ঞানের ব্যবধান কমাতে কাজ করছে। কার্যকর জ্ঞান বিনিময় ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে প্রকল্পটি কৃষকের সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে চায় যাতে তাদের উৎপাদনশীলতা ও আয় টেকসইভাবে বৃদ্ধি পায়।
Leave a Reply