সারাক্ষণ ডেস্ক
ভূমি ও কৃষি সংস্কারের বিষয়টি এখন উন্নয়ন আলোচ্যসূচিতে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। বিষয়টি মূলধারার উন্নয়নের আলোচ্যসূচিতে গুরুত্বের সাথে অর্šÍভুক্ত হওয়া জরুরি।
বরিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা ও ভূমি অধিকারের বাস্তবতা শীর্ষক এক জাতীয় সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব রাশেদ খান মেনন এমপি একথা বলেন।
রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, সরকারের গৃহহীন, ভূমিহীনমুক্ত উপজেলা- এই ধরণের ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টিকে পুনরায় বিবেচনা করা দরকার। এ ধরণের পরিকল্পনাকে বাস্তবসম্মত করতে হবে। এর পাশাপাশি নারীকে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে এবং সম ও ন্যায্য মজুরীর বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। তিনি কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পরামর্শ দেন। ভূমি অধিকারের ক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেই সাথে ভূমি ও কৃষি সংস্কারের বিষয়টি উন্নয়ন অগ্রাধিকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, জমির সিলিংয়ের জন্য যে ৩৩ বিঘার প্রস্তাব রয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য কোন নীতিমালা আজও হয়নি। ভূমি সংস্কারের প্রশ্নে এই বিষয়গুলোকে আরো গুরুত্ব সহকারে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
প্যানেল আলোচনায় সঞ্জীব দ্রং বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয়ণ প্রকল্পগুলোর বেশীরভাগ জাতীয় মহাসড়কের দুপাশে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জায়গায় সমস্যা রয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। কারণ আশ্রয়ণগুলোর আশেপাশে কাজের ক্ষেত্র না থাকায় লোকজন সেই আশ্রয়ণগুলো থেকে সুফল লাভ করতে পারছে না। সুতরাং কর্মক্ষেত্র, পরিবেশ ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে আশ্রয়ণগুলো নির্মাণ করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন সমাজে বহুবছর ধরে নারীরা বঞ্চনা ও অবিচারের মধ্যে বসবাস করছে। আমরা বড় বড় উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই উন্নয়নগুলো টেকসই হওয়াটা জরুরি। পাহাড়-নদী ধ্বংস করে উন্নয়ন করা হচ্ছে, এগুলো অপরিণামদর্শী উন্নয়ন। এক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন সময় সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার তুলে ধরে সমতল আদিবাসীদের জন্য আলাদা ভূমি কমিশন প্রণয়নের জোর দাবি জানান।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডাঃ ফওজিয়া মসলেমের সভাপতিত্বে¡ অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপনের মাধ্যমে ‘ভূমিহীন মানুষ. খাসজমি এবং সরকারের গৃহায়ন প্রকল্প’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন গাজী মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী। এতে প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন ড. সীমা জামান, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এবং এএলআরডি-র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। এছাড়াও নারী অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, উন্নয়নকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধি এবং তৃণমূলের নারী প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
প্রবন্ধ উপস্থাপক গাজী মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দী বলেন আজকের ভূমিহীনদের বড় অংশই ‘গতকালের’ ক্ষুদে পারিবারিক কৃষক। আর ‘আগামীকাল’ এরাই ক্ষেতমজুর-এর ‘অন্তিম কৃষি পরিচয়’ লয় করে ভিড় করবে শহরের অনানুষ্ঠানিক খাতে, ঠাঁই নেবে বস্তিতে। তিনি আরো বলেন, ২ শতকের উপরে ঘর গৃহহীনতা খানিকটা দূর করতে পারলেও ভূমিহীনতা দূর করার মহৌষধ নয়। তাই তিনি সরকার কর্তৃক বিভিন্ন উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীন ঘোষণা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে বলে অভিমত দেন।
শামসুল হুদা বলেন, যখন থেকে শ্রেণী শোষণের সমাজ ব্যবস্থা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই নারীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নারীর অন্যান্য অধিকারের মধ্যে ভূমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার কর্তৃক ৩৯৪ টি উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীন ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কেন এ ধরণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এটা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। আবার নদী, জলাকে ভরাট করে কোন কোন জায়গায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। এভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে আশ্রয়ণ নির্মাণে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। উন্নয়নের সম্মুখভাগে রয়েছে আমাদের নারীরা। নারীর দৃষ্টিতে উন্নয়নকে দেখতে হবে। বড় বড় কয়েকটা পদে নারীদের বসিয়ে দিলেই নারীর উন্নয়ন তরান্বিত হবে না। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় দেখতে হবে সকল স্তরের নারীরা নিরাপদ ও সম্মানিত বোধ করছেন কি না, অধিকার পাচ্ছেন কি না। ভূমি, পানি ও মানবাধিকারে ভূমিহীন ও আদিবাসী নারীসহ প্রান্তিক অবস্থান থাকা নারীদের অভিগম্যতা আছে কিনা, সেটা দেখতে হবে। তাহলেই উন্নয়নের অগ্রযাত্রা তরান্বিত হবে।
ড. সীমা জামান বলেন, নারীরা অধিকারের দিক থেকে পিছিয়ে আছে। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমি অধিকারের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ উন্নয়নের অন্যান্য দিকগুলোতে এগিয়ে আসতে হবে।
সেমিনারে সভাপ্রধান ডা: ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ভূমি অধিকারের বাস্তবতা বাংলাদেশে নারীকে, আদিবাসী মানুষকে ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ তৈরি করেছে। নারীরা জাতির সকল সংগ্রামে-সাহসে যুক্ত হয়েছে। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের নির্যাতনের ইতিহাস উঠে আসে, কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা, সহযোগিতার পূর্ণ চিত্র উঠে আসেনি। নারীর ভূমিকা ইতিহসে উপেক্ষিত। নারীর ক্ষমতায়ন থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে আছি। নারী আন্দোলন আসলে একটি সামাজিক আন্দোলন। বর্তমানে নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়েছে- এটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। নারীর জন্য সংবেদনশীল পরিবেশ তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে নারীর উন্নয়ন অগ্রযাত্রা তরান্বিত হবে।
এছাড়া রাজশাহী থেকে আফজাল হোসেন, পাবনা থেকে শরীফা আক্তার নিপা, দিনাজপুর থেকে সাবিনা হে¤্রম, ফরিদপুর থেকে মনিরা ও সাতক্ষীরা থেকে কৃষ্ণপদ মুন্ডা প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।
Leave a Reply