শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:৫৭ পূর্বাহ্ন

ইতালির রূপকথা (ভাই বোন-১)

  • Update Time : শনিবার, ২৫ মে, ২০২৪, ৮.০৫ পিএম

মাক্সিম গোর্কি

আঙুরলতার শ্যামল-কৃষ্ণ ঝালরের ফাঁক দিয়ে এক ঝলক সোনালী রোদ এসে পড়েছে হোটেলের বারান্দায় – শূন্যে যেন টানটান হয়ে আছে সোনার সুতোগুলো। ধূসর টালি পাথরের মেজে আর শাদা টেবিল ক্লথের ওপর ছায়ার আঁকিঝুঁকি নক্সা- মনে হয় বুঝি তার দিকে বহুক্ষণ চেয়ে থাকলে যেন কবিতার মতো কিছু একটা ফুটে উঠবে, ধরা দেবে তাদের অর্থ। মুক্তোর মতো, অথবা সেই জ্যোতিহীন আশ্চর্য পাথর অলিভাইনের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ আঙুর ঝুলছে রোদ্দুরে, টেবিলের ওপর কাঁচের জলপাত্রে জ্বলছে নীল হীরে।

টেবিলগুলোর ফাঁকে মেজের ওপর পড়ে আছে একটা ছোট লেসের রুমাল। স্বভাবতই একটি মহিলার হাত থেকে তা পড়ে গেছে, এবং মহিলাটি যে অপূর্ব সুন্দরী তাতে সন্দেহ নেই। আলস্যে ভরা এই উষ্ণ প্রশান্ত দিনখানিতে যখন সূর্যের সামনে যা কিছু মামুলী আর একঘেয়ে সব লজ্জায় মুখ ঢেকে অদৃশ্য হয়েছে তখন একথা না মনে হয়ে উপায় কি।

সব কিছু স্তব্ধ; শব্দ যেটুকু তা শুধু ঐ বাগানের পাখিগুলোর কিচিরমিচিরে, ফুলের ওপর মৌমাছি গুঞ্জনে, আর পাহাড়ের কোথায় এক আঙুর-বাগিচা থেকে ভেসে আসা একটা গানের অস্পষ্ট রেশে। যে গান গাইছে দুজনে- নারী আর পুরুষে, এক কলি গানের পর থামছে মিনিট খানেক করে, তাতে কেমন একটা প্রার্থনার ভাব এসে লেগেছে গানখানায়।

বাগান থেকে এগিয়ে আসেন একটি মহিলা, শ্বেত পাথরের সুপরিসর সিঁড়ি ভেঙে ওঠেন আস্তে আস্তে। বয়সে বুড়ি, অনেকটা লম্বা, ময়লা রঙের কঠোর মুখখানা, ভুরু দুটো কোঁচকানো, পাতলা ঠোঁট দুখানি এমন জেদ করে চাপা, যেন মনে হয় এই মাত্র সে কাকে বলেছে, ‘কিছুতেই না!’

অস্বিসার কাঁধের ওপর থেকে নেমেছে একটি দীর্য চওড়া সোনালী সিল্কের সূতোয় বোনা ম্যান্টেল, লেসের ঝালর লাগানো। কালো একটি লেসের স্কার্ফে ছোট্ট পাকাচুলে ভরা মাথাখানা ঢাকা। এক হাতে একটি লম্বা হাতলওয়ালা লাল ছাতা, অন্য হাতে রূপোলী সুতোয় কাজ করা একটি কালো মখমলের হাত-ব্যাগ। রোদ্দুরের চিকন জালি- বুনটের মধ্যে দিয়ে মেয়েটি হেঁটে যায় সৈন্যের মতো কদম ফেলে, বারান্দার বাঁধানো পাথরে ঠোকা লেগে লেগে জোরে আওয়াজ বেরোয় ছাতাটা থেকে। পাশ থেকে দেখলে মুখখানা তাঁর আরো কঠোর মনে হয়; নাকটা বাঁকা, থুতনিটা চোখা, তাতে মস্ত ধূসর একটা আঁচিল, চোখের কালো কোটরের ওপর ঢিপ হয়ে নামা কপাল, সূক্ষ্ম সুক্ষ্ম বলি রেখার মধ্যে লুকনো চোখ দুটো এত গভীরে যে মনে হয় মহিলাটি বুঝি অন্ধ।

হাইলারীর পেছনে হাঁসের হতো এগাশে ওপাশে দুলতে খুলতে এগিয়ে যাগে একটি বুসো লোক, ব্যারাগোই। দেখতে, নুয়ে পড়া প্রকার হাবাগানার ওপরে একটি ধুসর রঙের নরম চুপি। ওয়েস্ট কোর্টের পকেটে ভাগ হাত ছুটি খোঁজা, ফলে তাকে আরো চওড়া দেখায়, আায্যে বাঁকাচোল লাগে দেহটা। লোকটার পরনে শাদা হাউ, পারে নরম সোব দেওয়া পাল জুতো। রুগ্ন মুখখানা আধ খোলা, তাঁর ভেতর থেকে হলদে হলদে অসমান দাঁতগুলো দেখা যায়। ওপরকার ঠোঁটের গুলর খোঁচা খোঁচা হয়ে আছে কয়েকটা কালো কালো বিজিবি চুল। যব ঘন নিঃশ্বাস ফেলে লোকটা, কষ্ট হয় নিঃশ্বাস ফেলতে, নাফটা কেঁপে কেঁপে ওঠে, কিন্তু যোচটা নড়ে না। বাঁটকুল পা দুখানা তয়াবহ রকমের বাঁকা, হাঁটার সময় বড়ো বড়ো চোখ দুটো নিপ্রাণের মতো চেয়ে থাকে মার্টির দিকে। ছোটো দেহখান। তার বড়ো বড়ো একগাদা জিনিসে সাজানো: বাঁ হাতের অনামিকায় যন্ত এক সোনার জড়োয়া আংটি, ঘড়ি চেন হিসেবে ব্যবহৃত একটা কালো ফিতের শেষ প্রান্ত থেকে ঝোলে একটা চুনি বসানো সোনার পদক, আর শীল টাইয়ের ওপর একটা বিরাট আকারের রামধনুরঙা পাথর, লোকে বলে এ রকন পাথর নাকি দুর্ভাগ্য আনে।

আরো একটি মূতি দেখা দেয় বারান্দায়, ইনিও একজন বৃদ্ধা, ছোটোখাটো গোলগাল দেখতে, লাল রঙের কোমল একখানা মুখ, সজীব দুটি চোখ, সন্দেহ থাকে না, যে বুড়িটি হাসিখুশি, বকবক করতে ভালোবাসে।

বারান্দা পেরিয়ে ওয়া হোটেলের দরজার দিকে এগিয়ে যায় ঠিক যেন হহার্ড-এর আঁকা একখানা ছবি: অসুন্দর, বিষণ্ণ, কিম্ভুত, এবং এই উজ্জ্বল সূর্যের নিচেকার সবকিছু থেকে এত সুদূর যে মনে হয় তাদের দেখামাত্র যেন পৃথিবী নিষ্প্রভ ও বিবর্ণ হয়ে উঠবে।

ভাই বোনে ওরা হলান্ডের লোক, জনৈক হীয়া ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কারের ছেলে মেয়ে। ওদের সম্পর্কে লোকে যা রটায় তা বিশ্বাস করতে হলে বলতেই হবে কাহিনীটা অদ্ভুত।

ছেলেবেলায় কুঁজো লোকটা ছিল বেশ শান্ত, লাজুক, এবং ভাবুক গোছের, খেলনাপাতি কি খেলাধুলায় উৎসাহ ছিল না। এ নিয়ে ছেলেটির দিদি ছাড়া কিন্তু কেউ মাথা বামাত না; মা বাপের ধারণ। ছিল, হতভাগ্য জীবচার পক্ষে এই রকম আচরণই স্বাভাবিক, কিন্তু ভাইয়ের চেয়ে চার বছরের বড়ো ছোটো দিদিটি কিন্তু ভাইয়ের এই অদ্ভুত রকম সকম দেখে খুবই বিচলিত বোধ করত।

মেয়েটি সবসময় লেগে থাকত তার ভাইয়ের পেছনে, তাকে খুশি করার চেষ্টা করত, হাসাতে চাইত। খেলার জন্যে দিদি খেলন। এনে দিত, কিন্তু ভাই সেগুলিকে গাদাগাদি করে স্তূপ করে রাখত পিরামিডের মতো। কদাচিৎ সজোরে হাসতে দেখা যেত তাকে; আশে- পাশের সবকিছু সম্পর্কে যে ফাঁকা ফাঁকা নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে ভাইটি চেয়ে দেখতো, বড়ো বড়ো চোখের ঠিক সেই দৃষ্টি দিয়েই সে তাকাত দিদির দিকেও। এ দৃষ্টি দেখে ক্ষেপে যেত দিদি।

পা ঠুকে সে চেঁচিয়ে উঠত, ‘খবদার অমন চোখ করে তাকাবি না আমার দিকে, বড়ো হয়ে হবি তো একটা পঙ্গু।’ চিমটি কাটত দিদি, চড়-চাপড় মারত। কেউ কেউ করে ভাই তার সরু লম্বা হাত দিয়ে মাখাটা আটকাবার চেষ্টা করত, কিন্তু কখনো দিদির কাছ থেকে পালাতো না, নালিশও করত না কারো কাছে।

পরে, দিদির এক সময় মনে হল, যে-জিনিসটা তার নিজের কাছে অত স্পষ্ট, সেটা ভাইও বুঝতে পারবে। এই ভেবে সে শান্ত- ভাবে বোঝালে:

‘তোর শরীরটা যখন বিকৃত, তখন বুদ্ধিমান তোকে হতেই হবে, নইলে তোকে নিয়ে আমাদের লজ্জার শেষ থাকবে না- মা-বাবা, সকলেরই লজ্জা! বড়োলোকের বাড়িতে যদি একটা পঙ্গু ছেলে থাকে, তাহলে চাকর-বাকররা পর্যন্ত কাজ করতে লজ্জা পায়। বড়োলোকের বাড়িতে সবকিছুই হতে হবে হয় সুন্দর, নয় বুদ্ধিমান। বুঝেছিস?’

‘বুঝেছি।’ নস্ত মাথাটা এক পাশে হেলিয়ে দিদির দিকে অন্ধকার নিষ্প্রাণ দৃষ্টি তুলে ও জবাব দিলে গম্ভীরভাবে।

ভাইয়ের প্রতি ছোট্টো দিদির এই মনোভাব দেখে মা-বাপ খুদি হয়েছিল, তার সামনেই তারা মেয়েটির মায়াদয়ার প্রশংসা করত, এবং ক্রমশ যে কুঁজো ছেলেটার সর্বস্বীকৃত সঙ্গী হয়ে দাঁড়ালো। ভাইটিকে দিদি শেখাতো, কি করে খেলনা নিয়ে খেলতে হয়, পড়া বুঝিয়ে দিত আর পড়ে শোনাতো পরী আর রাজপুত্রদের। কাহিনী।

তাই কিন্তু সমানেই তার খেলনাগুলো স্তূপাকৃতি করে তুলতে লাগল যেন তা থেকে কিছু একটা গড়ে উঠবে। পড়াশুনাতে ও বিশেষ মন দিল না। রূপকথার লোকজনদের আশ্চর্য আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা শুনেই কেবল একটু অস্পষ্ট হাসি ফুটে উঠত তার মুখে। একদিন দিদিকে যে জিগ্যেস করলে:

‘রাজপুত্রেরা কেউ কখনো কুঁজো হয় নাকি রে দিদি?’

‘ना।’

‘কোটালপুত্রেরা?’

‘না, না।’

কষ্টের দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ল ছেলেটির বুক থেকে। দিদি তার কর্কশ চুলের ওপর হাত রেখে বললে:

‘কিন্তু জ্ঞানী যাদুকরের। হয় সবসময়েই কুঁজো।’

‘তাহলে আমি যাদুকর হবো’, বললে ও বাধ্যের মতো। তারপর একটুখানি কি ভেবে জিগ্যেস করলে:

‘পরীরা সবাই খুব সুন্দর, নারে দিদি?’

‘সবাই।’

‘তোর মতো?’

‘বোধ হয়! আমার চেয়েও হয়ত সুন্দর।’ সত্যি কথা বললে দিদি। ছেলেটির যখন আট বছর বয়স, দিদি লক্ষ্য করলে, যখনই ওরা ঘরবাড়ি উঠছে এমন জায়গা দিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে চলত, তখনই ছেলেটার মুখ চোখ বিস্ময়ে ভরে উঠত। মিস্ত্রিমজুরগুলোকে ছেলেটা লক্ষ্য করত মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তারপর দিদির দিকে চোখ ফেরাতো ও, নিষ্প্রাণ চোখ দুটোয় একটা প্রশ্ন।

দিদি জিগ্যেস করছিল, ‘এগুলো দেখতে ভালো লাগে তোর?’ ও বলত, ‘হ্যাঁ।’

‘কেন?’

‘কেন কি জানি।’

কিন্তু একদিন ও ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল:

‘কতো ছোটো লোকগুলো, কতো ছোটো ছোটো ইঁট, কিন্তু কি বড়ো বড়ো বাড়ি তৈরি করছে ওরা। এমনি করে সারা শহরটা তৈরি হয়েছে নাকি রে?’

‘হয়েছেই তো।’

‘আমাদের বাড়িখানাও?’

‘নিশ্চয়ই।’

ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দিদি নিশ্চিত সুরে বললে:

‘বড়ো হলে তুই একজন বিখ্যাত স্বপতি হবি।’

এক রাশ কাঠের ব্লক কিনে আনা হল ওর জন্যে। বাড়ি বানাবার এক তীব্র ঝোঁক তখন থেকে পেয়ে বসল ওকে। দিনের পর দিন ও তার ঘরের মেজের ওপর বসে নিঃশব্দে গড়ে তুলত লম্বা লম্বা মিনার; সেগুলো যখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ত, তখন আবার তা বানাতে বসত। ঝোঁকটা তার কাছে এমন অপরিহার্য হয়ে উঠল যে এমন কি খেতে বসেও ছুরি, কাঁটা, তোয়ালের আংটা দিয়ে সে কিছু না কিছু বানিয়ে যেত। চোখ দুটো তার গভীর আর একাগ্র হয়ে উঠতে লাগল। হাত দুখানা সজীব হয়ে উঠে চঞ্চল হয়ে রইল সারাক্ষণ, আর যা কিছু পাওয়া যেত, তাই নিয়েই নাড়াচাড়া করে যেত আঙুলগুলো।

শহরের মধ্যে দিয়ে বেড়াবার সময়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে দেখত কি করে বাড়ি গড়া হচ্ছে, ধীরে ধীরে মাটি ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে উঠছে আকাশের দিকে। কাঁপা কাঁপা নাক দিয়ে ইঁটের ধূলে। ভরা বাতাস আর ফুটন্ত চুণের গন্ধ টেনে নিত ও লোভীর মতো, চোখ দুটো তার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আসত আর একটা স্বপ্নাতুর ভাবুকতার ছায়া পড়ত সে চোখের ওপর। যদি ওকে বলা হত, এই ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকা ঠিক নয়, সে কথা ওর কানেই ঢুকত না।

‘চলে আয়!’ দিদি তার হাত ধরে টানতে টানতে বলত। মাথা নিচু করে এগিয়ে যেতে যেতেও সে ফিরে ফিরে তাকাত বার বার।

‘তুই একজন স্বপতি হবি, তাই না?’ বার বার করে দিদি জিগ্যেস করত ওকে।

‘হ্যাঁ, হবো।’

একদিন ওরা যখন ড্রাইংরুমে ডিনারের পর কফির জন্যে অপেক্ষা করছে, তখন বাপ বললে, খেলনাপাতি ছেড়ে ছেলেটার এখন সত্যি করে গড়াশুনা শুরু করা দরকার। কিন্তু দিদি এমন একটা সুরে কথা কয়ে উঠল যে বোঝা গেল তার মতটাও ভেবে দেখতে হবে ওকে কোনো ইস্কুলে পাঠাবার কথা তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না, বাবা?’ একটি চুরুট ধরালে বাবা; পরিষ্কার করে দাঁড়ি গোঁপ কামানো বিপুলাকৃক্তি একটি লোক সে, সারা শরীরে ঝিলিক দেওয়া এক রাশ জড়োয়া। বললে:

‘কিন্তু কেন পাঠাবো না শুনি?’

‘কেন, সে তো ভালো করেই জানো।’

নিজের সম্পর্কে কথা হচ্ছে বলে কুঁজো ছেলেটা ঘর থেকে সরে গেল। সয়ে যেতে যেতে শুনলে, দিদি বলছে:

‘কিন্তু সকলেই যে ঠাট্টা করবে ওকে নিয়ে।’

‘হ্যাঁ, তাতো বটেই।’ মা বললে এমন একটা সুরে যা হেমন্তের বাতাসের মতো সেঁৎসেঁতে।

আবেগভরে দিদি বললে, ‘ওর মতো যারা, তাদের সকলের চোখের আড়াল করে রাখা উচিত!’ মা বললে, ‘হ্যাঁ, তাতো বটেই, গর্ব করে দেখাবার মতো তো

নয়। সত্যি মেয়েটার মাখা আছে তো।’

বাপ সায় দিলে, ‘ঠিকই বলেছো।’

‘কিন্তু দেখো, মেয়েটার কি বুদ্ধি…’

দোর গোড়ায় ফিরে দাঁড়িয়ে কুঁজো বললে:

‘আমিও বোকা নই, বলে রাখছি…’

বাপ বললে, ‘বোকা কি না সে দেখাই যাবে।’ আর মা বললে:

‘কেউ তো তা বলছে না…’

ভাইটিকে নিজের পাশে বসিয়ে দিদি ঘোষণা করল, ‘তুই পড়াশুনা করবি বাড়িতে। স্বপতি হতে গেলে যা যা জানা দরকার সব তোকে শিখতে হবে। মন বসবে তো?’

‘বসবে। দেখে নিয়ো।’

‘কি দেখব?’

‘কিসে মন বসে।’

ওর চেয়ে দিদি লম্বায় বেশি উঁচু নয়, ওর মাথা ছাড়িয়ে দিদির মাথা মাত্র অর্ধেকটা উঁচু, কিন্তু ওর কাছে মনে হত, দিদি যেন সকলকে ছাড়িয়ে উঠেছে, মা-বাবাকে পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। বয়স তখন তার পনেরো, ওকে দেখে মনে হত একটা কাঁকড়া, কিন্তু দিদিটি ছিল, তন্বী, লম্বাটে, স্বাস্থ্যময়ী- ওর কাছে মনে হত যেন একটা রূপসী পরী সারা ঘরখানাকে, এবং তাকেও যাদু করে রেখেছে।

এরপর কুঁজোটার কাছে নিয়মিত আসতে শুরু করলে যতো নিষ্প্রাণ অমায়িক লোকজন, তারা ওকে কিছু শেখাতে চাইত, বোঝাত, ধৈর্য ধরে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করত। কিন্তু ছেলেটা নির্বিকারভাবে স্বীকার করত শিক্ষকেরা যা বলছে তার এক বর্ণও তার মাথায় ঢোকেনি। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকত শিক্ষকদের দিকে, আর আপন মনে কি ভেবে যেত। মন থাকত অন্য দিকে, কথা বলত অল্প, কিন্তু মাঝে মাঝে প্রশ্ন জিগ্যেস করে বসত বিচিত্র রকমের:

‘যারা কিছুই করতে চায় না, তাদের কি হয়?’

নিখুঁত আদব কায়দার লোক ছিল তার শিক্ষক; গলা পর্যন্ত বোতাম আঁাঁটা কালো পোষাকে তাকে দেখাতো ধর্মযাজক ও সৈন্য উভয়ের মতোই। শিক্ষক বললে:

‘এদের কপালে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপারটা ঘটে! যেমন ধরো, এদের অনেকেই হয়ে বসে সোশ্যালিস্ট।’

কুঁজো বললে, ‘ধন্যবাদ।’ শিক্ষকের প্রতি তার আচরণ ছিল যেন এক পরিণত বয়সীর শুক অমায়িকতার মতো, ‘কিন্তু সোশ্যালিস্ট কি বন্ধ।’

খড়ো জোর ওরা হল সাধারণভাবে খলসে আর দিবাস্বপ্ন প্রিয়, মনের দিক থেকে পঙ্গু, ঈশ্বর সম্পত্তি, অথবা স্বজাতি সম্পর্কে কোনো চিন্তাভাবনা নেই।’

ওর শিক্ষকেরা জবাব দিত সবসময়েই খুব সংক্ষিপ্তাকারে এবং যে জবাব তার স্মৃতির মধ্যে গেঁথে বসত যেন পেভমেন্টের নড়ি। ‘বুড়ি হলেও কি মনের দিক থেকে পঙ্গু হতে পারে?’

‘নিশ্চয়ই…’

‘ছোটো মেয়ে?’

‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা হল জন্মগত…’

শিক্ষকেরা ওর সম্পর্কে বলত:

‘অঙ্কে ওর বিশেষ মাথা নেই, কিন্তু নীতিকথা সম্পর্কে ওর আগ্রহ খুব বেশি…’

ওর দিদি যখন জানলে যে শিক্ষকদের সঙ্গে ও বসে বসে আলাপ করে, তখন বললে, ‘তুই বড়ো বেশি বকিস।’

‘আমার চেয়ে ওরা বেশি বকে।’

‘ঈশ্বরের কাছে তুই তো তেমন মন দিয়ে প্রার্থনা করিস না…’ ঈশ্বর কি আমার কুঁজ সারিয়ে দেবে…’

অবাক হয়ে দিদি চেঁচিয়ে উঠল, ‘বটে! এই সব কথা মাথায় ঢুকেছে দেখছি!’

দিদি ঘোষণা করলে, ‘এবারের মতো ক্ষমা করলাম, কিন্তু এ সব চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দে, বুঝেছিস?’

‘বুঝেছি।’

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024