সুমন চট্টোপাধ্যায়
ওঁকে ক্ষমতায় আনার পিছনে আপনার যথেষ্ট অবদান আছে। এখন ভুলে গেলে চলবে?
চুপচাপ ফুলে ছাপ কে লিখেছিল, আপনি না?
রোমের রাস্তায় গান গেয়েছিলেন, এখন বেসুরো ঠেকলে চলবে?
এক সময়তো ওঁর পিছন পিছন ঘুরতেন, এখন আপনাকে ছুঁড়ে ফেলেছেন বলে আপনার এত রাগ, আমরা কী বুঝতে পারিনা?
বি জে পি-র দালালি করার মুচলেখা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এখন আপনাকে বিরোধিতা করতেই হবে, তাই না?
কী সব চোখাচোখা প্রশ্ন! কিংবা প্রশ্ন তো নয়, ডগায় বিষ মাখানো এক একটা তীর। রোজ ধেয়ে আসে আমার পানে। ফেসবুক অথবা ইউ টিউবের কমেন্ট বক্সে। দু’একটা দিন দেখতে না পেলে মনটা বড় ভারাক্রান্ত লাগে। চক্ষে জল আসে। সেদিন নিজেই নিজের গায়ে চিমটি কেটে পরখ করে নিই, আমি আছি তো? নাকি…..!
এই অকিঞ্চিৎকর কলমচি-জীবনে আমি ফুলের তোড়া আর ইষ্টক দু’টোই পেয়েছি, কোনটা বেশি কোনটা কম বোকার মতো তার
হিসেব করতে বসিনি কখনও। রক্ত-মাংসের মানুষ বলে সর্বদা হয়তো সুখে অথবা দুঃখে সমান বিগতস্পৃহ থাকতে পারিনি, দু- চারটি চিলের জবাব হয়ত পাটকেলে দিয়েও ফেলেছি। এখন মনে হয় না করলেও চলত।
অন্যের কথা বলতে পারবনা, আমি কিন্তু গুরুকুলে রীতিমতো অনুশীলন করে তবেই সহিষ্ণু হওয়ার শিক্ষ অর্জন করেছি। আমার প্রাক্তন সম্পাদক- যাঁর কাছে আমার দেনা অপরিশোধ্য- অভীক সরকার এক্ষেত্রেও আমার শিক্ষক ও পথ প্রদর্শক। যৌবনের গোড়ায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার হলে আমি অযথা উত্তেজিত হয়ে পড়তাম, মনে হোত বেয়াদপদের একবার সবক শেখানো প্রয়োজন। সম্পাদকের ঘরে ঢুকে গজর গজর করতাম, তাঁর অনুমতি চাইতাম প্রত্যাঘাতের আগে। প্রতিবার আমার আকুতি প্রত্যাখাত হোত, পরে এক সময় এমন ছেলেমানুষি করতে ভুলেই গেলাম।
অভীকবাবু বলতেন,” একটি ছোট্ট বিষয় মাথায় রাখবে সর্বদা। আমরা যদি নিজেদের আড্ডায় মন্ত্রী-আমলা- অমাত্য-শিল্পী- সাহিত্যিকের নিয়ে নরক গুলজার করতে পারি, তাহলে কিছু লোক আমাদের নিয়েও করবে। জীবনে যত এগোবে ততই বাড়তে থাকবে এমন আপদ। ফলে গায়ের চামড়া ধীরে ধীরে এতটাই পুরু করে তুলবে যাতে তোমায় দেখে গন্ডাররাও লজ্জা পায়। মনে করবে তোমার জীবনে এসবই অর্জিত বিনোদন। পারলে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে দেবে।”
বাকি জীবনে একটি দিনের জন্যও আমি এই গুরুমন্ত্র বিস্মৃত হইনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ষড় রিপুও বশ মেনে গিয়েছে, আমাকে রাগানো কিংবা উত্যক্ত করা বড্ড কঠিন, প্রায় অসম্ভব।
যদি সুস্থ, তথ্য অথবা যুক্তি ভিত্তিক আলোচনা হয়, আমি সাগ্রহে যোগ দেব, প্রয়োজনে নিজের মতামত পরিমার্জন মায় সংশোধনও করে নেব। সেই সুযোগ পাচ্ছি কোথায়? কিংবা যদি কোনও তথ্যগত প্রশ্ন শুনি, সাধ্যমতো আমি তার জবাব দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু যা আদতে নিষ্পাপ প্রশ্ন নয়, প্রশ্নের আদলে চুলকুনি, গায়ের জ্বালা মেটানো, সত্যের ইচ্ছাকৃত অপলাপ, তার জবাব দেওয়া মূর্খামি। মতলবী প্রশ্নের প্রাপ্য একমাত্র উপেক্ষা। আমি তাহাই করিব।
গন্ডারের সংযোজন অনেক বন্ধুভাবাপন্ন পাঠক বলেছেন আমার আগের পোস্টের প্রথম তিনটি প্রশ্ন সঙ্গত, আমার এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাঁদের কৌতুহল নিরসনের জন্য রইল আমার উত্তর। প্রথম ও শেষবার।
১) ওঁকে ক্ষমতায় আনার প্রশ্নে আমার অবদান! এমন একটা বোকা বোকা প্রশ্নের জবাবে অনেক কথা লেখা যায়, আমি সচেতনভাবে সে কাজ করছিনা। যৎপরোনাস্তি সংক্ষেপে-
ক) আমি নিজে কখনও নিজেকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি, করার প্রশ্ন ওঠেনা। পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি রাজ্যের শাসনক্ষমতায় পালাবদল কোনও ব্যক্তি বিশেষের অবদানের জন্য হতে পারেনা, আমি সুপারম্যান নই, অরণ্যদেবও না। পালাবদলের কারণানুসন্ধানে আমিও ব্যস্ত আছি, সময় সুযোগ হলে বই আকারে ছাপাব।
খ) দিল্লি থেকে ফেরার পরে আমি আনন্দবাজারের বার্তা বিভাগের হাল ধরেছিলাম ১৯৯৩ সালে। ছেড়ে দিতে বাধ্য হই ২০০৪ সালের মাঝামাঝি। তার দীর্ঘ সাত বছর পরে রাজ্যে পালাবদল হয়।
গ) একটি বাংলা কাগজের প্রয়োজনে একজন জনপ্রিয় বিরোধী নেত্রীকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত আমি সেটুকু দিয়েছি। তাঁকে ‘অগ্নিকন্যা’ নামে আমি ভূষিত করিনি বরং ‘পটুয়াপাড়ার অগ্নিকন্যা’ বলে ক্রমাগত বিদ্রুপ করে গিয়েছি। একে যদি অবদান বলে তাহলে আমার কিছু করার নেই।
গ)২০০১ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় নীতিতে বৈপ্লবিক বদল ঘটে, কাগজের শতবর্ষের ইতিহাসে সেই প্রথম একজন কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী একটি বুর্জোয়া কাগজের নিঃশর্ত সমর্থন পেতে শুরু করেন যা তাঁর কার্যকালের শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে কাগজের সেতুবন্ধনে আমার অবশ্যই বড় ভূমিকা
ছিল, যার জন্য আমার কিঞ্চিৎ গর্ববোধ আছে, বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই।
ঘ) স্টার আনন্দ এবং কলকাতা টিভিতে প্রথম দফায় আমি আমার মতো করে বুদ্ধদেববাবুকে সমর্থনের ধারাটি অব্যাহত রেখেছিলাম। ব্র্যান্ড বুদ্ধ নামকরণটি ছিল আমারই।
৬) ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনও সম্পর্কই ছিলনা।
চ) ২০১১ সালে বুদ্ধবাবু তৃতীয়বারের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতে পারলে সিপিএমের যে কোনও ক্যাডারের চেয়ে আমি অনেক বেশি খুশি হতাম। কেননা বিধান রায়ের পরে বুদ্ধবাবুকে আমি বাংলার শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী বলে মনে করি, সেটা আমার ঘোষিত অবস্থান। হয়নি যে সেটা আমার অবদান নয়, সিপিএমের স্বখাত সলিলে অবগাহন।
ছ) আনন্দবাজারের কলমে ওঁর মতো বুদ্ধদেববাবুকে নিয়েও আমি অনেক কটু কথা লিখেছি আবার পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তাঁকে বাংলার শেষ ভরসাস্থল বলেও মনে করেছি। আমার মূল্যায়ন বদলেছিল কেননা বুদ্ধবাবু সচেতনভাবে নিজেকেও বদলে ছিলেন। সাংবাদিক-রাজনীতিকের নিত্য ঠোকাঠুকি গণতন্ত্রকে সমৃদ্ধ করে। সবচেয়ে হাস্যকর সমর্থন অথবা বিরোধিতার প্রশ্নে ধারাবাহিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যা আমার মতে জড়বুদ্ধিতার লক্ষণমাত্র। একদা কাউকে সমর্থন করেছিলাম বলে সারা জীবন তাঁকেই সমর্থন করে
যেতে হবে, তাঁর স্পষ্ট অধঃপতন দেখার পরেও, এ বড়ো আপদের যুক্তি। In this world the only thing constant is change, consistency is the virtue of a fool.
জ) সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনে আমার কোনও অবদান ছিলনা। যদিও দু’জায়গাতেই পুলিশের নারকীয় অত্যাচার আমিও মেনে নিতে পারিনি, সাধ্যমতো প্রতিবাদ করেছি।
ঝ) ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের আসন একে নেমে যাওয়ার পরে আমরা নেত্রীর পলিটিকাল অবিচুয়ারি লিখতে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। মিডিয়া অথবা নাগরিক সমাজ অথবা অন্য কোনও বহিশক্তি তাঁকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেনি। করেছিল বামেদের ভ্রান্ত জমি-নীতি এবং তার গা-জোয়ারি রূপায়ন। অতি অল্প সময়ের জন্য যাঁরা বাংলাকে বাঁচানোর আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন, তাঁদের ভুলেই রাজা আজ রসাতলে। এই পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রাখলে ব্যক্তি সাংবাদিক অথবা বিশেষ কোনও মিডিয়া গোষ্ঠীর অবদানের প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব।
ঞ) বাকি রইল একটি বই। ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’। ১৯৯৮ সালে লেখা, তাঁর কংগ্রেস ছাড়ার অতি নাটকীয় প্রেক্ষাপটের না আঁখো দেখা হাল। ছাব্বিশ বছর পরে সেই বইটির কথা উল্লেখ করার অর্থ কী? আমি তো রামায়ন-মহাভারত লিখিনি, কমিউনিষ্ট ম্যানিফেস্টোও নয়। লিখেছি বেশ করেছি। আবার লিখব। নাম দেব ‘আগাছার নাম ঘাসফুল’। চলবে?
পুনশ্চ- মাদার টেরিজার সেইন্টহুড পাওয়ার দিনে তাঁর নেতৃত্বে রোমের রাস্তায় যে বৈতালিকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে একমাত্র আমিই অনুপস্থিত ছিলাম। সচেতনভাবে। আগের দিনের রিহার্সালে আমি অবশ্যই ছিলাম। তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল?
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক,সাবেক নির্বাহী সম্পাদক আনন্দবাজার পত্রিকা
Leave a Reply