মণীশ রায়
পুরো নাম মোহাম্মদ আবদুর রউফ মুন্সী।
এককালে শরীয়তপুর কলেজে মুন্সী স্যার হিসাবে পরিচিত ছিলেন সবার কাছে। দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক। হালকা-পলকা শরীর। মুখভরা দাড়ি। চোখে ভারি চশমা। মাথায় সর্ষের তেল মাখানো চানাচুরের মতো উস্কোখুস্কো চুল আর পরনে ন্যাতানো পাজামা-পাঞ্জাবি।
ছাত্রদের ভেতর কেউ কখনও মুন্সী স্যারকে পাজামা-পাঞ্জাবী ছাড়া অন্য কোন পোশাকে দেখেনি। স্যারের শীর্ণ দেহে পাজামা-পাঞ্জাবি পতাকার মতো পতপত করে খোলা বাতাসে উড়তে চাইতো। তা দেখে অনেকের মনে হতো, কঞ্চি বাঁশে বুঝি ঝুলে রয়েছেন তাদের মুন্সী স্যার !
ভাবুক প্রকৃতির মানুষ। হাঁটতে হাঁটতে কখনও থেমে যান মাঝপথে। ক্লাসে কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। জানালা দিয়ে দূরের আকাশে চোখ রাখলে সে চোখ আর ফিরিয়ে আনতে পারেন না ক্লাসে। তখন ছাত্র-ছাত্রীদের ঠোঁটের ফাঁকে খেলা করে গোপন হাসির ছটা !
সেদিকে তাকিয়ে আসমার বান্ধবী রেনু একদিন ফিসফিসিয়ে জানাল ,‘ জানিস, স্যার না একদিন মধ্যরাতে বউর গলা চেপে ধরেছিল।’
চোখ বড় বড় করে আসমা পাল্টা জিজ্ঞাসা করল,‘ কি বলিস ? কেনো ?’ বিস্ময়ের ঘোর ওর চোখে-মুখে।
‘দেহ থেকে কিভাবে প্রাণ যায় তা পরখ করে দেখার সাধ জেগেছে যে স্যারের মনে , সেজন্য ! স্যার বিষয়টার গভীরে যেতে চাইছিলেন তো।’ বলে রেনু ডান হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসি ঢাকে ক্লাসের ভেতর।
‘দূর। ওগুলো বানানো কথা। বিটলা ছাত্রছাত্রীদের কাজ।’ মুখ ঘুরায় বিএ ক্লাসের ছাত্রী আসমা। কিছুতেই বিশ্বাস জন্মায় না রেনুর কথায়।
এতোদিন পর আজ ফের সেই মুন্সী স্যার। মনে পড়ে গেল ক্লাসে পাঠদানের সময় তাঁর অদ্ভুত কিছু কথা।
মুন্সী স্যার
একদিন ক্লাসে মানুষের নিষ্ঠুরতার ফিরিস্তি দিচ্ছিলেন মুন্সী স্যার। সহসা স্যার মন্তব্য করে বসলেন,‘ তোমরা কি জানো পৃথিবীতে এতো যে কান্নার মহাপ্লাবন, এর সিকিভাগও মানুষ অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়ে কাঁদে না ? জেনে রেখো , মানুষ কাঁদে শুধু নিজের কথা ভেবে। সে নিজেকে ছাড়া আর কারো জন্য কাঁদতে পারে না। কান্নার ভান করে শুধু। ’ বলে একটুখানি থামলেন। চোখে রহস্যময় একচিলতে হাসি। মানুষটার শরীরের তুলনায় কণ্ঠ ছিল ভরাট। মাইকের দরকার হতো না। যখন কথা বলতেন তখন ঝনঝন করে বাজতো সবার কানে।
সেদিন আসমার কানে বড় নিষ্ঠুর হয়ে বেজেছিল স্যারের কথাগুলো। বলা যায় খারাপ লেগেছিল। মানুষের এতো ভালোবাসা, এতো-মমতার মায়াভরা গল্প কি সবই তবে বৃথা ? মানুষ কি পরের জন্য জীবন বাজি রাখে না ? মানুষ কি হাসতে হাসতে অন্যের জন্য জীবন দেয় না ? মানুষ কি শুধুই স্বার্থান্ধ এক প্রাণী?
প্রচ- বিরক্ত হয়ে সেদিন রেনুর কাছে আসমা মন্তব্য করেছিল,‘ সবাই ঠিকই বলে। মুন্সী স্যার আসলেই একটা বদ্ধ পাগল। উন্মাদ লোক। ’
সেই মুন্সী স্যার মারা গেছেন চারবছর হল। অথচ ইদানীং আশ্চর্যজনকভাবে সেই অপ্রিয় কথাগুলোই বড় মনে পড়ছে। যতই নিষ্ঠুর আর ঘৃণা-সঞ্চারী বলে মনে হউক, আসমার জীবনে তা ঠিকই ফলে গেল।
যেদিন অনিক আচমকা স্ট্রোক করে রেস্টুরেন্ট থেকে হাসপাতালে নিতে নিতে রাস্তায় দুম করে মরে গেল, সেদিন সে মোটেই দুঃখ পায়নি। বরং আনন্দ-উল্লাসে ধেই-ধেই করে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু-হাত তুলে নাচতে চেয়েছিল। কাউকে নয় , নিজেকেই নিজে যেন বিড়বিড় করে বলে উঠেছিল,‘ বানচোতটা শেষ পর্যন্ত মরল তাইলে ? একটা আস্ত শয়তান দূর অইছে আমার জীবন থেকে । হিপ হিপ হুররে ! ’
ঠিক তখনি পাশের রুম থেকে বাচ্চাদের কান্নার শব্দ ওকে উতলা করে তোলে। অনিকের বড় বোন আগলে রেখেছেন ওদের। তিনি নিজে অবিরাম ছোটভাইয়ের জন্য কাঁদছেন এবং সাত-আট বছরের বাচ্চা দুটোকেও উসকে দিচ্ছেন বাপের জন্যে চোখের জলে ভাসতে। এসময়টায় সহসা কেন যেন নিজেকে বড় অরক্ষিত আর নিরাপত্তাহীন লাগে আসমার ।
নিজেকে আর সামলাতে পারে না, ছুটে গিয়ে পিঠাপিঠি বয়সের শিহাব-আসিফকে জড়িয়ে ধরে সে-ও আর্তনাদ করে ওঠে,‘ আমি অহন কি করুম গো। কই যাবো , অ আল্লাগো। তুমি আমারে কোন্ পরীক্ষায় ফালাইলা মাবুদ। ’ বলে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ঢাকার ভাড়া বাসায় বিলাপ করে কাঁদতে থাকে সে। তা দেখে মহল্লার আধা পরিচিত প্রতিবেশীরা জড়ো হতে শুরু করে। ওর আহাজারি শুনে ওদের সবার চোখ সজল হয়ে ওঠে। কে যেন পিছন থেকে সান্ত¦নাভরা কাঁদ-কাঁদ গলায় বলে ওঠে,‘কাইন্দো না , কাইন্দা গড়গড়ি খাইলে কি স্বামীর রূহ শান্তি পাইবো ? বাইচ্চারার মুহের দিকে চাও। এরাই তোমার ভরসা। শক্ত অইয়া দাঁড়াও। তুমি শক্ত না অইলে তুমার বাইচ্চারা কই যাইবো কও ? ’
সরাসরি না তাকিয়েও আসমা বুঝতে পারল , মহিলা অনিকের বোন। স্বামী-সন্তান নিয়ে বাড্ডার আশেপাশে ভাড়া থাকে। দুঃসংবাদ শুনে সবার আগে তিনিই ছুটে আসেন ভাইয়ের বাসায়। পুলিশের মতো ওর ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে গার্মেন্টস-ওয়ার্কার মহিলা এখন মাতব্বরি ফলাচ্ছেন একের পর এক।
মহিলার এসব আলগা কথাবার্তা যে কবে শেষ হবে তা ভেবে ওর মাথা ঘোরে। অসহ্য লাগে মহিলার উপস্থিতি।
এসময় আসমার চোখের সামনে অনিকের চেহারা ভাসে। অসম্ভব হ্যান্ডসাম এক পুরুষ। চাঁছাছোলা নির্মেদ শরীর। মাথাভরা কোঁকড়া চুল। সবাইকে আপন ভেবে নেওয়ার মিষ্টি এক ব্যক্তিত্বের ছটা দৃষ্টি জুড়ে। তাকাতেই মন স্নিগ্ধতায় টলোমলো করে। তাছাড়া , এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে গল্প করতে পারতো যে যখন কথা বলতো তখন আসমার শুধু শুনতেই ইচ্ছে হতো। তাকিয়ে থাকতো ওর দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
গুলশানের একটা নামজাদা রেস্টুরেন্ট কাম বারে অনিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতো। হাতভরা টাকা। থাকতো বাড্ডার দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে। আসমা সেখানেও পা রেখেছে বিয়ের আগে। একদিন অনিক ওর জাদুকরি কণ্ঠ ও চোখের দৃষ্টিতে মোহ ছড়িয়ে ওকে জানাল,‘ জান, কটা দিন সময় দাও। তিনহাজার স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট বায়না করে ফেলবো। দেখো। ’ এসময় এমনভাবে সিগারেটের ধোঁয়া রিং করে করে আকাশে ছড়িয়ে দিতো যে আসমার মনে হতো, সপ্তাহ খানেকের ভেতরই বুঝি ফ্ল্যাটটা হেঁটে এসে ওদের জানাবে , আমি এসে গেছি। এখানে বসবাস করে তোমরা এবার ধন্য করো আমায়।
মাত্র মাস তিনেকেই আসমা বুঝে গেল, শরীয়তপুরের সাধারণ এ মেয়েটির কাছে অনিক হল এক স্বপ্নের রাজপুত্র। একে ছেড়ে দিলে কিংবা অবহেলা করলে সুন্দর জীবনের সংজ্ঞাটা গোড়াতেই আমূল বদলে যাবে। তাই দেরি না করে সে দ্রুত লেখাপড়া ছেড়ে ইডেন কলেজের হোস্টেল থেকে কাজী অফিস হয়ে সোজা ওর দুই রুমের ফ্ল্যাটে উঠে পড়লো।
অনিকের প্রতি তীব্র আকর্ষণের দ্বিতীয় কারণটা আরও মধুর। সে ছিল প্রকৃতি-প্রেমিক। নদী, পাহাড় , গাছপালা , আকাশ, চাঁদ ওর বড় প্রিয় বিষয়। যখন তখন আনমনা-উদাসীন হয়ে পড়া ওর স্বভাব। চোখের সামনে কেউ ফুল ছিঁড়লে ওর ভীষণ রাগ হয় । চেহারায় পড়ে কষ্টের ছাপ । আসমাকে বলে,‘ কোনকিছু সুন্দর দেখতে পেলেই মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয় কেন বলতে পারো ? ’ এমন কি, গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেললেও যেন ওর বুকে বাজে। ঝুম বৃষ্টির রাতে কোথাও একটা বিড়ালছানা মিঁউমিঁউ করলেও ওর মায়া উপচে পড়ে । ঘরের ভেতর রয়েছে পোষা একটা ময়না পাখি। ‘মিস্টার অনিক জেন্টলম্যান’ বলে বলে জান দেয় সারাক্ষণ। অনিক বলে , ‘এটা আমার মেয়ে। ওরে আমি ভীষণ ভালোবাসি। ওকে বন্দি করে রাখতে ইচ্ছে করে না। তবু রাখি। মেয়েকে নিজের কাছে রাখা কি দোষের বল ? আমি স্বার্থপর?
সেই মানুষটাকে কি না ভালোবেসে পারা যায় ?
একটা আচ্ছন্নতা বা ঘোরের গর্তে পড়ে আসমা হয়ে গেল অনিকের। যে মানুষটা এমন নিবিঢ়ভাবে প্রকৃতি-লগ্ন হয়ে থাকতে চায় , গাছপালা-নদী-পাখির কথা বললে যার চোখেমুখে এক মায়াবী দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামের শ্যামল ছায়ার মতো যার এমন মিষ্টি ব্যক্তিত্ব, সে কি কখনও ভুল পুরুষ হয়? তার জন্য সবকিছু বাজি ধরতে রাজি আসমা।
সে সেটাই করল। ইডেন কলেজের হোস্টেল ছেড়ে দিল। সেই সঙ্গে লেখাপড়া। মফস্বলবাসী আব্বা-আম্মা , পরিবার-পরিজন সবাইকে বলতে গেলে ত্যাগ করল এককথায়। বাজিতে জিতবে , কেবল এ নেশায় বুঁদ হয়ে রইলো কদিন। মনের মানুষের কাছে থাকার কী যে নেশা যৌবন বয়সের , তা এখন ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে ভয় ও শঙ্কায়।
যাহোক , বছরখানেকের মাথায় আসমা বুঝতে পারল অনিকের পুরোটাই একটা ভান। কোনরকমে এসএসসি পাস করে গ্রাম থেকে ঢাকায় উঠে আসা ভাগ্যান্বেষণকারী এ যুবক। নানা জায়গায় ধাক্কা খেতে খেতে গুলশানের এক রেস্টুরেন্ট কাম বারে থিতু হবার সুযোগ পেয়েছে। সে ঠক, প্রতারক, নির্দয়, হতদরিদ্র এক স্বামী। একদা গর্বভরে সে যে বার-কাম-রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার হিসাবে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছিলো , সে আসলে সেখানকার সামান্য এক ওয়েটার। প্রতিদিন বড়লোকদের উচ্ছিষ্ট মদ পান করে বাড়ি ফেরে মাতাল হয়ে এবং টিপস হিসাবে যে বাড়তি টাকা আয় হয় তা দিয়ে নিয়মিত জুয়া খেলে নিঃস্ব হয়ে আসমার উপর ঝাল ঝাড়ে.‘ বানচোত, মাগি, তোর জন্য জীবনটা আমার শেষ। তুই আমার জীবনের শনি। মনে লয় গলা টিপে মেরে ফেলি তোরে। ’
প্রথমদিকে ভালোবাসার শক্তি দিয়ে আসমা পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছে ; মানিয়ে চলে যদি সংসারটা বাঁচে তো মন্দ কি ?
আসলে আসমা কারো কাছে পরাজিত হতে চায়নি। পরিবার-পরিজন বন্ধু-বান্ধব আব্বা-আম্মা ভাই-বোন কারো কাছেই আসমা আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয়। তাই সে কুরিয়ার সার্ভিসের এক ফার্মে চাকরি যোগাড় করে বাঁচতে চাইল কোনরকমে। কিন্তু অনিক যেরকম সেরকমই রয়ে গেল। সুন্দর চেহারা , মিষ্টি ব্যক্তিত্ব ধ্বসে গেল। প্রকৃতি-প্রেম হয়ে উঠল বনাঞ্চলের দাবদাহের মতো সর্বভূক। নিয়মিত মারধর , তুচ্ছতাচ্ছিল্য , গালিগালাজের মধ্য দিয়ে এককালের প্রিয়তম হয়ে উঠল ওর জীবনের খলনায়ক। শুধু মাঝে মাঝে সবার সামনে পোষা ময়নাপাখিটা বলে উঠত,‘অনিক জেন্টলম্যান। অনিক, আই লাভ ইউ।’ তখন আসমার গা জ্বালা করতো তীব্র রাগে। বুলিওলা পাখিটার গলা চেপে ধরে মেরে ফেলার প্রায়ই্ ইচ্ছে জাগতো।
সেই অনিকের মৃত্যু আসমাকে কাঁদাবে কেন ? তবু কাঁদতে হচ্ছে। পাড়াপ্রতিবেশী সবাইকে বুঝাতে হচ্ছে , আসমা পতিপ্রেমে পাগল এক নারী। এটাই সমাজের দস্তুর। সবাইকে এ ঘেরাটোপের ভেতরই নিস ফেলে বাঁচতে হয়!
তখনই মুন্সী স্যারের কথা নতুন করে আবার মনে পড়ল। স্যারের কথাগুলো কি সত্যি হচ্ছে ওর জীবনে?
স্বামীর মৃত্যুর চারদিনের মাথায় আসমা আত্মীয়-পরিজন সবাইকে অগ্রাহ্য করে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠিয়ে দিল। সে নিজে সেজেগুঁজে গেল অফিসে। তা দেখে অনিকের ঠোঁটকাটা বড়বোন বলে উঠল,‘ বিধবাদের রয়ে-সয়ে চলতে হয় আসমা। অত স্বাধীনতা ভাল নয় কিন্তু।’
আসমা ফস করে উত্তর দিল ,‘ খাওয়াবে কে ? আপনি ?’
জেবুন্নিছার চেহারা কালো হয়ে গেল অপমানে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেরিয়ে গেলেন বাসা ছেড়ে।
এদিকে ওর বাবার বাড়ির কেউ আসেনি ওকে দেখতে। আসমার মনে হলো , রাগ-গোস্বা এসব কিছু নয়। হয়তো মেয়ের কোন দায়িত্ব ওদের কারো ঘাড়ে বর্তায় কিনা সেই ভয়ে নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছে রাগ-অভিমানের মুখোশের আড়ালে। সবই ভং ! এতোদিনে আসমা ঠিকই বুঝে গেছে সংসারের সারবস্তু।
সে পাত্তাই দিল না এসব। নিয়মিত অফিস করল। এমন কি , ওর যে স্বামী মারা গেছে তাও উহ্য রাখল অফিসে।
অফিস শেষে বান্ধবীদের নিয়ে হাতির ঝিলে ঘুরে বেড়াল। কফি খেল কফিশপে। হাতে একটা উল্কি কাটার শখ জন্মেছে মনে । সহকর্মী জলিকে জিজ্ঞাসা করল , ‘ কী উল্কি কাটি ক তো দোস্ত?’
‘জামাইর মুখ । ’
আসমা ঝালমুড়ি খেতে খেতে কী যেন ভাবল। তারপর বলে উঠল,‘ ঠিক ধরেছিস। সেটাই করব।’
মুখে একথা বলল বটে। কিন্তু মনে মনে ভাবল, উল্কি একটা আঁকব ঠিকই। তবে সেটা জামাইর মুখ নয়। শয়তানের ড্রাগন-চেহারা।
রাতে খেয়ে-দেয়ে বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরে বালিশে মাথা রাখতেই চোখ ভরা ঘন ঘুমে কখন যে সকাল হয়ে এল টেরই পায়নি আসমা। কোন টেনশন নেই মনে ও মগজে। স্বাধীনতার স্বাদ যে এতো আনন্দময় ও মনোরম হতে পারে তা স্বাধীনতাহীনতায় থেকে এতোদিন বুঝতেই পারেনি। অনিক বেঁচে থাকলে হয়তো সারাজীবনেও এর অমিয় স্বাদ পেতো না। তাতে কোন সন্দেহ নেই্ মনে।
বেঁচে থাকার অপরূপ এ আনন্দটুকু অনিকের মৃত্যুই একেবারে হাতের মুঠোয় এনে দিল ওর।
আসমার জীবনের পরাক্রমশালী নিষ্ঠুর কুৎসিত গিরগিটি তুল্য পুরুষটিকে নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না। মনে হলেই শুধু গালি চলে আসে মুখে, হারামজাদা!
ইদানীং সাতসকালে বাচ্চাদের স্কুলের রিক্সাভ্যানে তুলে দিয়ে অফিসের জন্য নিজেকে তৈরি করতে ইচ্ছে করেই বেশ খানিকটা সময় নেয় সে। বাধা কাজের মেয়েকে সব বুঝাতে বুঝাতে গাঢ় মেরুন রঙের লিপস্টিক ঘষে ঠোঁটে। মাথায় শ্যাম্পু করা ফাপানো চুল ছড়িয়ে দেয় পিঠে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিজের দিকে।
বেরোবার সময় বারান্দায় রাখা অনিকের কন্যাতুল্য পোষা ময়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আসমা। তারপর মুখ ভেংচে চাপা গলায় বলে ওঠে ,‘ তোর বাপ তো শেষ। এখন কারে জেন্টলম্যান কবি হারামি? কারে আই লাভ ইউ কবি বজ্জাত ?’ বলে বুক ভরা তৃপ্তি নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। নিজেকে এসময় অনিক মনে হয় আসমার। রাজা ভাবার আনন্দটাই ভিন্ন। এ বলে বোঝানো যাবে না।
আরও কদিন বাদে আসমা ইডেন কলেজে গিয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেল। ওর জীবনের অধরা সাধগুলো সে পূরণ করতে চায়। সেভাবেই সে এগিয়ে যাবে সামনের দিকে। আর কোন কাচা ভুল নয় জীবনে আত্মবিশ্বাসী আসমা হাতের মুঠি শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করে নিজেকে নিয়ে।
বাসায় ফিরে ফের ওর চোখ পড়ে যায় পাখিটার উপর। ব্যঙ্গের হাসি খেলা করে ঠোঁটের ফাঁকে।
আর ঠিক তখনি পোষা ময়নাটা ওকে হতভম্ব করে কথা কয়ে ওঠে,‘ আসমা ইজ জেন্টলম্যান। আসমা , আই লাভ ইউ। ’
বিস্ময়ের ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর আসমা সহসা হোঃ হোঃ করে অট্টাহাসিতে ভেঙে পড়ে।
ওর হাসির শব্দ বারান্দার গ্রীল গলিয়ে একসময় আকাশে মেশে !
Leave a Reply