শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:৩৩ পূর্বাহ্ন

শুরু হলো পণ্ডিতের মূর্খামি

  • Update Time : রবিবার, ২৬ মে, ২০২৪, ৬.৩৮ পিএম

সুমন চট্টোপাধ্যায়

উফ্ আর কয়েক ঘন্টা পরেই সমগ্র ভারত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। মানে পয়লা জুন। কেননা সেদিন সন্ধ্যাতারা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পর্দা নামবে তাপক্লিষ্ট, প্রাণান্তকর রকম দীর্ঘ নির্বাচন পর্বে। ওইদিনেই আবার কলকাতার ভোট। প্রথম কয়েকটি পর্বে ভোটের পালা মোটামুটি নির্বিঘ্নে সাঙ্গ করা গেলেও ভাগীরথী পেরিয়ে ভোটের হাওয়া যত দক্ষিণমুখী হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ফিরে গিয়েছে পরিচিত ছবিতে, বেঘোরে মৃত্যু, মারামারি, পুলিশি অত্যাচার খবরের শিরোণাম হয়েছে অনবরত। শেষ দফায় ছবিটা ফের বদলাবে হিংসায় অভ্যস্ত আমরা তা বিশ্বাস করিনা।

ওই পয়লা জুনই আবার শেষ ভোটটি ই ভি এম যন্ত্রে বন্দী হওয়ার পরে আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান’ স্টাইলে চ্যানেলে চ্যানেলে শুরু হবে এগজিট পোল বা বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল জানানোর প্রতিযোগিতা। সেখানেও সব শেয়ালের এক রা’ হওয়ার উপায় নেই। কে কোন মতলবে কার প্রসাদ খেয়ে কতটা বিকৃত করে সমীক্ষার ফল দেখাবে আমরা তার কিছুটা অনুমান করতে পারব পুরোটা নয়। প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভারতীয় মিডিয়া তার বিশ্বাসযোগ্যতা খুইয়েছে অনেক কাল, আম জনতা থানার দারোগাকে যতটা বিশ্বাস করে, মিডিয়াকে তাও করেনা। তবু এগজিট পোল নামক যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, এবারও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। বলিউডের ব্লক-ব্লাস্টার ছবি যেমন কিছুক্ষণ বাস্তবকে ভুলিয়ে দেওয়ার হাতছানি দিয়ে দর্শক টানে, এগজিট পোলও তেমনি এখন আমাদের কাছে নিছক বিনে পয়সার বিনোদন, কিছুক্ষণের জন্য গা গরম হয় এই যা!

অস্যার্থ, সত্যটি জানার জন্য আমাদের সেই গণনা-প্রহর পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। তখনই হিন্দিতে যাকে বলে ‘দুধ না দুধ, পানি কা পানি’ পরিষ্কার হয়ে যাবে। তার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত পুরোটাই হয় মূর্খের পান্ডিত্য নতুবা পন্ডিতের মূর্খামি।

প্রথমে পন্ডিতের মূর্খামির প্রসঙ্গ আলোচনা করা যাক। সংক্ষেপে বলতে গেল দুই ভোট পন্ডিত প্রশান্ত কিশোর বনাম যোগেন্দ্র যাদবের উচ্চকিত কাজিয়া। না, কুস্তির আখড়ায় ঢুকে এঁরা পরস্পরকে প্যাঁচ মারছেননা, দু’জনেই পরস্পরের প্রতি ব্যক্তিগত স্তরে যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। এঁদের তু তু ম্যাচ ম্যায়টা হচ্ছে টেলিভিশন আর ইউ টিউবের পর্দায়। দুয়ের ব্যক্তিত্ব বা কথা বলার ধরণটাও একেবারে বিপরীত মেরুর। যোগেন্দ্র ধীর স্থির, একটি অসতর্ক অথবা অসংযমী মন্তব্য করেননা, ষোলো আনা অধ্যাপক সুলভ, বিনম্র, চুল দাড়ি গামছায় শোভিত এই দিগ্গজকে হরিয়াণার চাষি পরিবারের সন্তান বলে বিভ্রম হয়।

তুলনায় প্রশান্ত কিশোর বেশ দাবাং গোছের, চেহারার গড়ন দেখলে সালমান খানের কথা মনে পড়ে, নাপিতের পরিমার্জনায় রাখা দাড়ি, পশ্চিমি পোশাক, হাতের আস্তিন গুটিয়ে কথা বলেন প্রত্যয়ের সঙ্গে মুষ্টিবদ্ধ করে। ভোট-পন্ডিতির রাজসভায় দু’জনের স্থানই প্রথম সারিতে। এঁদের কার কথা আপনার বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে সেটা একান্তভাবেই শ্রোতার নিজস্ব রাজনৈতিক পছন্দের ওপর নির্ভর করে। তবে কারও কথাই ফেলনা নয়, বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য।

লোকসভা ভোটের নির্ঘন্ট প্রকাশিত হওয়ার এক মাস আগে থেকেই প্রশান্ত বলে আসছিলেন, এবারও নরেন্দ্র মোদী সরকার গড়বেন এবং বিজেপি এককভাবে ২০১৯-এর চেয়েও ভাল ফল করবে। গতবার বি জে পি এককভাবেই পেয়েছিল ৩০৩টি আসন। প্রশান্তর ভবিষ্যদ্বানী অনুসারে সেই সংখ্যাটিও এবার বি জে পি হাসতে হাসতে ছাড়িয়ে যাবে।

ভোটের আগে প্রশান্তর এই বক্তব্য কারও কাছে অতিকথন বোধ হয়নি কেননা তখন প্রায় সকলেই কম-বেশি একমত ছিলেন যে ‘আব কী বার চারশ পার’-এর হুঙ্কারে বাহুল্যের আতিশয্য থাকলেও মোদীই অনায়াসে তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হবেন। মানে ২০১৯-এর স্লোগান ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’ সামান্য তরলীকৃত করে মনে হয়েছিল ‘আসবেন কো সেই মোদীই’। মোদ্দা কথায় তার মানে ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে কোন দল জিতবে গ্যালারিতে তা নিয়ে বড় একটা মতবিরোধ ছিলনা।

গোল পাকতে শুরু করল ম্যাচের প্রথম ওভার দেখার পরে। যোগেন্দ্র যাদবের মতো বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হোল, উইকেটের চরিত্র খেলার আগে যেমনটি মনে করা গিয়েছিল তেমনটি আদৌ নয়। বিজেপিকে দেখে যতটা ছলছল পুকুর মনে হয়েছিল বাস্তবে আদৌ তা নয়, নীচে জমাট শ্যাওলাও যেন পুকুরে নামলেই দৃশ্যমান হচ্ছে। এই ‘কাউন্টার ন্যারেটিভ’ প্রবলতর হতে শুরু করল পরের ওভারগুলিতে। পঞ্চম ওভারের পরে বিজেপি শিবিরে যখন হৃদকম্পন শোনা যেতে আরম্ভ করল, প্রধানমন্ত্রী উপর্যুপরি জনসভায় যা মুখে আসে তাই বলে কংগ্রেস ও তার জোট সঙ্গীদের গালমন্দ শুরু করলেন, গোদী মিডিয়ার পছন্দের লোকেদের একে একে ডেকে এনে আগে থেকে তৈরি হওয়া প্রশ্নমালার আজব সব জবাব দিতে শুরু করলেন (যেমন তিনি আসলে মাতৃগর্ভজাত মানুষ নন, খোদ পরমাত্মার মানবদেহী প্রতিনিধি) তখন এমন রব উঠল যে এসবই অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের পূর্ব-লক্ষণ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

ঠিক এমন একটি ক্রান্তিকালে মুশকিল আসানের মতো দিল্লির মিডিয়া আকাশে ফের উদয় হোল প্রশান্ত কিশোরের। তিনি তাঁর পুরোনো মন্তব্যেরই পুনরুচ্চারণ শুরু করলেন কিন্তু ষড়যন্ত্রের তত্ত্বে বিশ্বাসী নাগরিক সমাজে তাঁর এই সময় নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠল। ২০১৪ সালে প্রশান্ত যেহেতু মোদীর জয়ের নেপথ্য করিগরদের অন্যতম ছিলেন তাই প্রশ্ন উঠতে শুরু করল এই ভোট কুশলী আসল মতলবটা কী? তিনি কি শাসকের সুপারি নিলেন?

আমি এই প্রচারে কর্ণপাত করার বান্দা নই। কেন তার ব্যাখ্যা দেব আগামীকাল। (চলবে)

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক,সাবেক নির্বাহী সম্পাদক আনন্দবাজার পত্রিকা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024