সারাক্ষণ ডেস্ক
নদী রক্ষার নামে নদীর অধিকার মেরে ফেলা হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, এলজিইডি, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের নদীগুলো ধ্বংস হওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে অভিযোগ করেছেন দেশের ৮ টি বিভাগ থেকে জাতীয় নদী সম্মেলনে আগত শতাধিক নদী আন্দোলন কর্মীবৃন্দ। দেশের নদ-নদী সুরক্ষায় তারা নদী সংরক্ষণ আইন প্রণয়নের জোরালো দাবি করেছেন।
এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), পানি অধিকার ফোরাম, রিভারাইন পিপল ও বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল যৌথ উদ্যোগে ২৫-২৬ মে ২০২৪, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (খামারবাড়ি, ফার্মগেইট, ঢাকা) মিলনায়তনে নদী রক্ষায় গড়ে ওঠা নাগরিক আন্দোলনকারী সংস্থাগুলোকে নিয়ে জাতীয় নদী সম্মেলনের আয়োজন করেছে। সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে অতিবিপন্ন নদীগুলোকে কিভাবে রক্ষা করা যেতে পারে সে বিষয়ে বিশদ নাগরিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার লক্ষ্যে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের ৮ বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ১ শত নদী আন্দোলনকর্মী যোগদান করেন।
সম্মেলনের সমাপনী দিবসে (২৬ মে) প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনাব খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এমপি, মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। তিনি বলেন, নদীর পাড়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান হবে, বড় বড় স্থাপত্য হবে। কিন্তু নদীকে রক্ষা করে সেসব প্রতিষ্ঠান করতে, নদীকে ধ্বংস করে নয়। সরকার নদী রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয় সেটা অংশীজনদের সাথে পরামর্শ করেই করা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় হতে পারে, কিছু ক্ষেত্রে সার্ভে ঠিকমত না করেই প্রকল্প নেয়ার নজীর আয়ে। তবে। প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অংশীজনদের মতামত ও সার্ভে সম্পন্ন করে যাতে প্রকল্পগুলো নেয়া হয়। সেটি আমি কেবিনেটে তুলছে।
বালুমহাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন যে হাইড্রোগ্রাফিক সমিক্ষা ছাড়া কোথাও কোন বালুমহাল করতে দেয়া যাবে না। এবং নদীতে কোনো সুইচগেট থাকবে না এটিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আছে। এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে আমাদের একসাথে কাজ করে যেতে হবে। কোনো ব্যত্যয় দেখলে আপনারা পরিচয় গোপন করে আমাদের জানাবেন, আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
নীতিমালা অনুযায়ী সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৪০ শতাংশ ড্রেজিং করবে। বাকি ৬০ শতাংশ নিয়মানুযায়ী টেন্ডারের মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে দেয়া হয়। বর্তমানে ১৫০ টি ড্রেজার মেশিন সরকারের কাছে আছে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে কাজ সম্পূর্ণ হচ্ছে না।
সম্মানীয় অতিথি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব সারোয়ার মাহমুদ বলেন, নদী কমিশনের দায়িত্ব মূলত সুপারিশ করা। আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেয়া হয় নি। নদীর নাব্যতা, নদী দূষণ, নদী দখল, দখল বা অপদখল এই তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কৌশলগত পরিকল্পনা মাফিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়। এক্ষেত্রে স্থানীয় মানুষদের অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
সিএস রেকর্ডে নদীর উল্লেখ থাকলেও পরবর্তীতে দেখা যায় সেটা স্বার্থন্বেষী মহলের প্রভাবে ব্যক্তিমালিকানার নামে রেকর্ড হয়ে আইনী জটিলতা তৈরি। আইনের অপ-প্রয়োগের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণকে আরও সচেতন করতে হবে। অবৈধ দখলকৃত জায়গা শুধু উদ্ধার করলেই হবে না, সরকারের পক্ষ থেকে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় দেখা যায় এক পক্ষকে উচ্ছেদ করলে আরেক পক্ষ এসে যেটি দখল করে বসবে কিংবা সেই পক্ষই পুনরায় দখলে চলে আসে।
বাংলাদেশের নদীর জীবন ও অধিকার বিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপনায় গবেষক ও নদী আন্দোলনকর্মী শেখ রোকন নদী রক্ষায় চারটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রস্তাবনা দেন। নদীকে মুক্তভাবে চলতে দেয়া, নদী নির্ভর জনগোষ্ঠীর সাথে নদীর অর্থনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করা, নদীর প্রতিবেশগত ঝুঁকি হ্রাস করা। এবং নদীর পুনরুজ্জীবনের জন্য আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়াও, আমাদের নদীগুলো কোথায় আছে, কেমন আছে তা আমাদের জানতে হবে। এ দৃষ্টিভঙ্গিতে এগোলে আমরা নদী বাঁচাতে পারবো বলে তিনি মনে করেন।
নদী সুরক্ষায় যুক্ত আন্দোলনকর্মীদের দুই বছরের (২০২৪-২৬) একটি রোডম্যাপ তুলে ধরে বেলার প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্বকে আমরা প্রায় শুন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে এসেছি নানাভাবে দখল-দূষণ, বালু-পাথর উত্তোলন করে। দখল-দূষণকারীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি করেছেন তিনি। এছাড়াও, বালু-পাথর উত্তোলনের রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর গবেষণা করা এবং নদীর উন্নয়নে জনসংযোগ বৃদ্ধি, নদী বিষয়ক ডাটাবেজ তৈরি, অ্যাডভোকেসী ও আইনী উদ্যোগ, নদীর “স্বাস্থ্য কার্ড”- এর রূপরেখা প্রণয়ন (শিল্প দূষণ, গৃহস্থালী বর্জ্য, এন্টিবায়োটিক পলি, রাসায়নিক কীটনাশক ও সারের প্রভাব)। নদী সংবাদকর্মী প্ল্যাটফর্ম গঠন সহ বেশ কিছু কর্মসূচী তিনি তার রোডম্যাপে উল্লেখ করেছেন।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, নদীর যত দখল, দূষণ এর সবকিছুর সাথে ব্যবসায়ীমহল এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা যুক্ত। নদী নিয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। এজন্য তিনি সরকারিভাবে নদী সপ্তাহ ঘোষণার আহবান জানান।
মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির বলেন, সবার মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি দায়িত্বশীলতা আনতে হবে। বর্তমানে সব জায়গায় দায়িত্বহীনতা চরমভাবে বিরাজ করছে।
নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ মো. শরীফ উদ্দিন এনডিসি বলেন, আমাদের অনেক ভৌত উন্নয়ন হয়েছে, এখন প্রয়োজন নৈতিক উন্নয়ন। আমাদের নৈতিক চরিত্র পথ দেখাবে আলোর দিকে। নৈতিক চরিত্র উন্নয়ন হলে কেউ আর অন্যায়ভাবে নদী দখল, দূষণ করবে না।
নদী সম্মেলনের সমাপনী দিনের সভাপতি ড. আইনুন নিশাত বলেন, আমাদের দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পলি পরিবাহিত হয়ে আসে বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে তা দীর্ঘকাল ধরে আর পরিমাপ করা হচ্ছে না। আমাদের বালু উত্তোলন প্রয়োজন কিন্তু তা পরিকল্পিতভাবে হতে হবে এবং যথাযথ মনিটরিং করতে হবে। নদী সম্পর্কে বেসিক ডাটা নেই। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম সম্মেলন হলে আরও বিস্তারিত আলোচনা হয়।
প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মো. এজাজ, নদী পরিব্রাজক দল এর মো. মনির হোসেন, এবং সিসিডিবি’র নির্বাহী পরিচালক জুলিয়েট কেয়া মালাকার বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও, দেশের ৮ টি বিভাগ থেকে ৮ জন নদী আন্দোলন এর সাথে যুক্ত প্রতিনিধিরা বক্তব্য রেখেছেন।
Leave a Reply