শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন

ইতালির রূপকথা (বুদ্ধিজীবী)

  • Update Time : সোমবার, ২৭ মে, ২০২৪, ৮.৩০ পিএম

মাক্সিম গোর্কি

তেলের মতো পুরু নীল জল। মসৃণভাবে ঘুরছে জাহাজের প্রপেলার। তা থেকে শব্দ প্রায় উঠছেই না। পায়ের নিচে পাটাতনে কোনো কাঁপন নেই, যেটুকু আছে তা ওই মাস্তলে, মেষশূন্য আকাশের দিকে যা উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠে গিয়ে তিরতির করে কাঁপছে। আর মৃদু স্পন্দিত হচ্ছে শুধু মাস্তলের দড়াদড়িগুলো, বেহালার তারের মতো তা টানটান। কিন্তু সে কাঁপন সকলের এত সয়ে গেছে যে প্রায় নজরেই পড়ে না। মনে হয় জাহাজটা যেন বা দাঁড়িয়েই আছে স্থির হয়ে, মসৃণ জলের ওপর শাদা সুন্দর একটি রাজহাঁসের মতো। জাহাজটা চলছে তা ঠাহর পেতে হলে তাকাতে হবে রেলিংএর ওপাশে, শাদা জাহাজখানার দুপাশ থেকে সেখানে সবুজ রঙের তরঙ্গ ভেঙে ভেঙে পড়ছে, তারপর উদ্বেল হয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কোমল চওড়া ঢেউ তুলে। ফুটে উঠছে পারার মতো একটা ঝিলিক আর নিদ্রাতুর একটু কল্লোল।

ভোর হয়েছে। সমুদ্র পুরোপুরি জেগে ওঠেনি তখনো, সূযোদয়ের অরুণাভা তখনো মিলিয়ে যায়নি আকাশে। গরগন দ্বীপটা পার হরে চলে এসেছে জাহাজ, বনে ছাওয়া দ্বীপটা নিসঙ্গ, গোনড়া পাথরের মতো তার মাথায় একটা ধুসর গোল মিনার আর সুনন্ত সাগরের তীরের কাছে গাদাগাদি করে আছে কয়েকটা শাদা শাদা ছোটো ছোটো বাড়ি। খানিক আগে তীরবেগে পেরিয়ে গেল করেকণ্ঠী ডিজি-নৌকো, ওই দ্বীপটা থেকে ওরা বেরিয়েছে সার্ডিন মাছ ধরতে। ওদের লম্বা লম্বা দাঁড় ফেলার ছপছপ শব্দ আর যেন সূর্যকে অভিবাদন করার ভঙ্গিতে নৌকোর ওপর দাঁড়ানো মাঝিদের পাতলা নূর্তিগুলোর দুলুনির একটু স্মৃতি পড়ে রইল শুধু।

সবুজ মতো ফেনার একটা চওড়া করে চলেছে, জাহাজটাকে, গাং-চিলের। স্রোতোধারা অনুসরণ তার ওপর চক্কর দিয়ে চলেছে আলস্যে। কখনো সখনো এক একটা সামুদ্রিক সাপ নিঃশব্দে ভেসে উঠছে জলের ওপর, তারপর হঠাৎ তীরবেগে ডুব মারছে অতলে।

দূরে ভেসে উঠল সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা লিগুরিয়ান উপকূলের নাইলাক পাহাড়গুলো। আর ঘণ্টা দুই তিনের মধ্যেই মর্মরনগরী জেনোয়ার ভীড়াক্রান্ত বন্দরে ঢুকবে জাহাজ।

ক্রমেই উঁচু হয়ে উঠতে লাগল সূর্য, বোঝা গেল দিনটা বেশ গরম হবে।

ডেকের ওপর ছুটে এল দুটি পরিচারক-একজন নে-এর লোক, অল্প বয়স, একহারা চেহারা, চটপটে স্বভাব, চঞ্চল মুখের ভাবখানা ঠিক কি ধরা যায় না- অনবরত তা পাল্টাচ্ছে। অন্যজন মাঝারি বয়সের লোক, পাকা মোচ, কালো ভুরু, গোল মাথার ওপর খোঁচা খোঁচা রুপোলী চুল, বাঁকা নাক আর গম্ভীর বুদ্ধিমান এক জোড়া চোখ। পরস্পর হাসি-তামাসা করতে করতে ওরা চটপট কফির জন্যে টেবিল সাজিয়ে চলে গেল। কিছু পরেই কেবিন থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসতে লাগল যাত্রীরা- এলো একটি মোটাসোটা বিষণ্ণ ভদ্রলোক, মাথাখানা ছোটো, ফোলা ফোলা মুখ, লালচে গাল, মোটাসোটা লাল ঠোঁট ক্লান্তিতে ঝুলে আছে। এল ধূসর জুলপিওয়ালা আর একজন, লম্বা, ফিটফাট, চোখ দুটো ফ্যাকাশে, আর পাতলা হলদে মুখের ওপর বোতামের মতো একটু নাক। তার পেছনে পেতলের বাঁধানো চৌকাটে ঠোকর খেয়ে এল একটি গোলগাল ভুঁড়িওয়ালা লোক, লালচে চুল, বাঁকান মোচ, গায়ে একটা পাহাড়ে পোষাক, টুপিতে সবুজ পালক গোঁজা। তিনজনেই চলে গেল জাহাজের রেলিংটার কাছে। মোটা লোকটা চোখ কুঁচকে চিন্তার ভাব করে বললে:

‘বেশ শান্ত, তাই না?’

জুলপিওয়াল। লোকটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা ফাঁক করে এমন ভাবে দাঁড়াল যে তাকে দেখাল একটা হাঁ-করা কাঁচির মতো। লালচুলো লোকটা বার করল একটা সোনার ঘড়ি – দেয়াল- ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো প্রকাণ্ড। ঘড়িটার দিকে চাইল একবার তারপর তাকাল আকাশের দিকে, ডেকের দিকে, এবং পায়ে তাল ঠুকে ঘড়িটা দোলাতে দোলাতে শিস দিতে লাগল।

কিছু পরে এলেন দুটি মহিলা, একটি কম বয়সী মোটাসোটা, মুখখানা চীনেমাটির পুতুলের মতো, দুধ-নীল নরম চোখ, কালো ভুরু দুটো মনে হয় যেন আঁকা, একটা ভুরু আর একটার চেয়ে একটু উঁচুতে। অন্য জন বরস্ক, তীক্ষ্ণ নাক, বিবর্ণ চুলগুলো ফ্যাশন করে সাজানো, বাঁ গালের ওপর একটা কালো তিল, গলায় দুটো সোনার চেন, ছাই রঙের গাউনের ওপর কোমরের কাছে কিছু অলঙ্কার আর একটা লরনেট্ ঝুলছে।

কফি পরিবেশন করা হল। কোনো কথা না বলে অল্প বয়সী মেয়েটি টেবিলে বসে কনুই পর্যন্ত নগ্ন হাত দুখানার একটা অদ্ভুত গোলালো ভঙ্গি করে ঢালতে শুরু করলে কালো রঙের পানীয়টা। পুরুষেরা টেবিলের কাছে এসে নীরবে আসন নিলে। একটা কাপ টেনে নিয়ে মোটা লোকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললে: ‘গরম পড়বে আজ…’

বয়স্ক মহিলাটি বললেন, ‘কোলের ওপর কফি পড়ছে তোমার।’ মাথা নিচু করলে লোকটা। তাতে ওর চোয়ালটা নিচু হয়ে থুতনিটা ঠেকল বুকের কাছে। টেবিলে কাপটা নামিয়ে রেখে রুমাল দিয়ে প্রথমে ধূসর ট্রাউজারের ওপর থেকে কফির ফোঁটাগুলো ঝেড়ে ফেললে, তারপর ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে নিল।

হঠাৎ কেমন একটা চড়া গলায় পা দুটো গুটিয়ে এনে লালচুলো । লোকটা বলে উঠল, ‘হ্যা! হ্যাঁ, হ্যাঁ, বামপন্থীরাও যখন গুণ্ডামির অভিযোগ করতে শুরু করেছে, তখন তার মানে…’

বয়স্ক মহিলাটি তাকে থামিয়ে দিলো, ‘আহ্, আর বোকো না, ইভান। লিজা আসবে না?’

‘লিজার শরীর ভালো নয়’, গাঢ় গলায় বললে তরুণীটি। ‘সমুদ্র কিন্তু একেবারে শান্ত…’

‘কিন্তু একটা মেয়ের পক্ষে ওই রকম অবস্থায়…’

মোটা লোকটা হেসে চোখ বন্ধ করলে আলস্যে।

জাহাজের কাছে মসৃণ জলের ওপর একদল শুশুকের হুটোপুটি একমনে দেখছিল জুলপিওয়ালা লোকটা। বললে:

‘শুশুকগুলো দেখতে ঠিক শুয়োরের মতো।’

জবাবে লালচুলো লোকটা বললে:

‘মোটের ওপর এখানে সবেতেই শুয়োরের ভাবটা বেশি।’

বিবর্ণ মহিলাটি নাকের কাছে কাপটা তুলে গন্ধ শুঁকে বিস্বাদের মুখভঙ্গি করল:

‘হ্যাঁ। আর দুধের কথা বলতে হলে…’ মোটা লোকটা আতঙ্কের ভাব করে চোখ মটকাল।

চীনেমাটির পুতুলের মতো মুখওয়ালা মেয়েটি ঘ্যানর ঘ্যানর করতে লাগল, ‘সব কিছুই নোংরা। কি নোংরা। লোকগুলোকেও দেখতে একেবারে ইহুদীদের মতো বিশ্রী…’

লাবচুলো লোকটা জুলপির কানের কাছে মুখ নিয়ে এক নাগাড়ে কি যেন বলে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন মুখস্থ করা একটা পাঠ আওড়াচ্ছে। অন্য জন শুনছিল একটা সরস ঔৎসুক্য নিয়ে, অগ্ন অয় মাথা নেড়ে। চ্যাপ্‌টা মুখের ওপর তার হাঁ-মুখটা দেখাচ্ছিল যেন শুকনো কাঠে একটা ফাটল। মাঝে মাঝে ওকে থামিয়ে দিয়ে একটা অদ্ভুত জড়িত স্বরে বলার চেষ্টা করছিল ও, ‘মানে, আমার নিজের সুবায়…’

কিন্তু তার বেশি কথা ওর আর বলা হয়ে উঠছিল না। মাথা হেলিয়ে ফের সে কান পেতে থাকছিল লালচুলো লোকটার মোচের দিকে।

মোটা লোকটা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললে:

‘কি বকতেই না পারো তুমি, ইভান…’

‘কিন্তু আমার কফিটা কই?’

শব্দ করে ও চেয়ারটা টেনে আনল টেবিলের কাছে আর তার সঙ্গী বেশ অর্থময়ভাবে ঘোষণা করলে:

‘ইভানের মাথা আছে।’

বয়স্ক মেয়েটি তার লরনেট্ চশমা দিয়ে জুলপির দিকে তাকিয়ে লে, ‘ভালো ঘুম হয়নি তোমার।’ লোকটা মুখের ওপর একবার হাত বুলিয়ে এনে হাতের দিকে তাকাল:

‘মনে হচ্ছে মুখের ওপর কে যেন পাউডার লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তোমার মনে হচ্ছে না?’

তরুণীটি চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ, কাকু। এ হল ইতালীর আবহাওয়ার জন্যে। কি বিচ্ছিরি চামড়া শুকিয়ে যায়!’

‘দেখেছিস লিদিয়া, এদের চিনিগুলো কি খারাপ।’ জিগ্যেস করলে বয়স্ক মহিলাটি।

এই সময় ডেকে এসে দাঁড়াল একটি বিপুলায়তন লোক, বন কোঁকড়া পাকা পাকা চুল, প্রকাও নাক, ফুতিবাজ চোখ, দাঁতের ফাঁকে চুরুট। রেলিঙের পাশে দাঁড়ানো পরিচারকগুলো সম্ভ্রমে মাথা নোয়ালে তার দিকে।

অমারিকভাবে তাদের দিকে মাথা দুলিয়ে ভাঙা ভাঙা গলার চিৎকার করে বললে লোকটা, ‘শুভদিন হে, শুভদিন।’

রুশেরা চুপ করে গিয়ে বাঁকা চোখে তাকালে ওর দিকে। ওপো ইভান নিচু গলায় সকলকে বললে:

‘দেখেই বোঝা যায় সৈন্যদলে ছিল, এখন অবসর নিয়েছে…’

ওরা তাকিয়ে আছে দেখে পাকাচুলো লোকটা মুখ থেকে চুরুট নামিয়ে রুশদের দিকে অমায়িকভাবে অভিবাদন করল। বয়স্ক মহিলাটি মাথা তুলে তার লরনেটের মধ্যে দিয়ে উদ্ধতভাবে তাকিরে রইল ওর দিকে। যে কোনো কারণেই হোক, গুঁাঁপো লোকটা বিঘ্নতভাবে দ্রুত অন্য দিকে মুখ ফেরালে এবং পকেট থেকে ঘড়িটা বার করে দোলাতে শুরু করল আবার। অভিবাদনের প্রতিঅভিবাদন দিলে শুধু মোটা লোকটা, থুতনিটা বুকের সঙ্গে ঠেকিয়ে। এতে ইতালিয়ানট। কেমন হকচকিয়ে গিয়ে ফের চুরুটটা তুলে নিন ঠোঁটের কোণে। বয়স্ক পরিচারকটিকে জিগ্যেস করলে নিচু গলায়:

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, একজন রাশিয়ান গভর্ণর আর তাঁর পরিবার পরিজন…’

‘রুশদের মুখগুলোয় সবসময়ই কেমন দয়ামায়ার একটা তাব থাকে…’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ভারি ভালো লোক…’

‘স্নাত জাতগুলোর মধ্যে ওরাই সবচেয়ে ভালো…’

‘তবে একটুখানি অবিবেচক গোছের আর কি…’

‘অবিবেচক? সত্যি?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়, অন্যদের সম্পর্কে তেমন বিবেচনা নেই।’

মোটকা রুশটা লাল হয়ে উঠল। আকর্ণ হাসি হেসে বললে:

‘ওরা আমাদের নিয়েই আলাপ করছে…’

বিরস ভঙ্গিতে বয়স্কা জিগ্যেস করলে, ‘কি বলছে?’

খুক খুক করে হেসে জবাব দিলে মুটকো, ‘বলছে স্নাভদের মধ্যে আমরাই সেরা।’

মহিলাটি ঘোষণা করলে, ‘ওটা বলেছে তোয়াজ করে।’ এবং লালচে চুলো ইভান তার ঘড়িটা পকেটে রেখে দুই হাতে মোচ পাকাতে পাকাতে অবজ্ঞাভরে জানাল:

‘আমাদের সম্পর্কে ওরা জানে কতটুকু…’

মুটকো বললে, ‘এই দ্যাখো, কোথায় ওরা প্রশংসা করছে, আর তুমি বলে বসলে, ওরা কিছুই জানে না বলেই…’

‘বাজে বোকো না! আমি কথাটা বলছিলাম সাধারণভাবে… আমরা যে সেরা সে তো সবাই জানে।’

জুলপি মন দিয়ে শুশুকের খেলা দেখেই যাচ্ছিল সারাটা সময়। বিশ্বোস ছেড়ে মাথা দুলিয়ে বললে।

‘কি বোকা মাছগুলো।’

পাকাচুলে। ইতালিয়ানটার সঙ্গে এযে জুটেছিল আরো দুজন, একজন বুড়ো, চোখে চশমা, গায়ে কালো কোট। অন্য জন তরুণ, লম্বা লম্বা চুল, ফ্যাকাশে মুখ, চওড়া কপাল আর মোটা তুরু। রুশদের কাছ থেকে কয়েক হাত দূরে ওরা তিনজনেই দাঁড়িয়ে রইল রেলিংটার কাছে।

কাঁচাপাকা চুলের লোকটা নিচু গলায় বললে:

‘রুশদের দেখলেই আমার মনে পড়ে মেসিন। শহরে ভূমিকম্পের কথা…’

‘মনে আছে, নে-এ সেই যে রুশ নাবিকেরা এসেছিল, তাদের কি রকম স্বাগত করা হয়েছিল?’ বললে তরুণ।

‘ঠিকই, নিজের দেশের জঙ্গলে ফিরে গেলেও সে অভ্যর্থনার কথাটা ওদের মনে থাকবে!’

‘ওদের সম্মানে যে পদকটা তৈরী হয়েছিল, দেখেছিলে?’

‘দেখেছিলাম। পদকের কারিগরি অবশ্য আমার ভালো লাগেনি।’

‘মেসিনা সম্পর্কে আলাপ করছে ওরা’, মুটকো জানাল তার সঙ্গীদের।

‘অথচ হাসছে! আশ্চর্য!’ বিস্ময় প্রকাশ করলে তরুণী। গাং-চিলগুলো উড়ে এসে নাগাল ধরল জাহাজের। বাঁকা বাঁকা ডানায় সজোরে ঝাপট মেরে একটা চিল উড়তে লাগল জাহাজের পাশে। তরুণীটি বিস্কুট ছুড়ে দিলে। ঠোঁট দিয়ে টুকরোগুলো লুফে নিয়ে পাখিগুলো জাহাজের পাশ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, তারপর তীক্ষ্ণ চীৎকার করতে করতে সমুদ্রের ওপরকার নীল শূন্যে পাক খেতে লাগল। ইতালিয়ানদের জন্যে কফি পরিবেশন করা হয়েছিল। তারাও

বিস্কুট ছুড়ে ছুড়ে দিতে লাগল পাখিগুলোকে। বয়স্কা ভ্রুকুটি করলে। অবজ্ঞাভরে বললে:

‘হনুমানের মতো।’

ইতালিয়ানদের উচ্ছল আলাপ-আলোচনা শুনছিল মুটকোটা। ফের সে জানাল:

‘লোকটা সৈনিক নয়, ব্যবসায়ী। আমাদের সঙ্গে ফসল নিয়ে ব্যবসা করার কথা কইছে। বলছে, আমাদের দেশ থেকে কেরোসিন কাঠ আর কয়লাও ওরা কিনতে পারে।’

‘আমি দেখেই বুঝেছিলাম ও সৈনিক হতে পারে না।’ ঘোষণা করলে বয়স্কা।

লালচে চুলো লোকটা জুলপির সঙ্গে সেই ফিসফিস কথা শুরু করেছিল আবার। অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মুখ টান করে শুনছিল জুলপি। তরুণ ইতালিয়ানটি রুশদের দিকে মাঝে মাঝে আড়চোখে চাইছিল আর বলছিল:

‘কি আফসোস, ফিকে নীল চোখ আর দশাসই চেহারার এই লোকগুলোর দেশ সম্পর্কে আমরা জানি কতো কম!’

ইতিমধ্যে সূর্য উঁচুতে উঠে গিয়েছিল অনেকখানি, গরম লাগছিল অসহ্য। সমুদ্র থেকে ঠিকরে পড়ছিল চোখ ধাঁধানো ঝিলিক। আর দূরে দেখা যাচ্ছিল সমুদ্র থেকে উঠেছে পাহাড় অথবা মেঘের সীমারেখা।

‘আন্নেত, শোনো, শোনো’, জুলপি বললে আকর্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে, ‘এই কিম্ভুত জিয়ানটা কি বলছে, শোনো। গাঁয়ের ঐ সব বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করার একটা ভারি বুদ্ধি বার করেছে ও।’

চেয়ারে দুলতে দুলতে ও টানা একঘেয়ে গলায় এমন ভাবে কথা বলছিল যেন মনে হবে কোনো একটা বিদেশী ভাষা থেকে ও বুঝি অনুবাদ করছে:

‘ও বলছে, গাঁয়ের মেলার আর পালাপার্বণের দিনে এলাকার ভূমি-দপ্তর থেকে সরকারী খরচায় প্রচুর লাঠিসোঁটা আর ইটপাথরের ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। তারপর সরকারী খরচার যেমন যেমন লোক সেই অনুসারে দশ, কুড়ি, কি পঞ্চাশ কলসী ভোদকা বিলোতে হবে মুঝিকদের মধ্যে। তাহলেই কাম ফতে।’

বয়স্কা বললে, ‘বুঝতে পারছি না, তামাসা করছ নাকি?’ ‘না না সত্যি করেই বলছি’, লালচে চুলো তাকে অবিলম্বে আশ্বস্ত করতে চাইল, ‘ভেবে দেখো…’

তরুণী তার চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে কাঁধ ঝাঁকালে। ‘কি আজগুবি কাণ্ড। ওরা ভোদকা গিলবে কি না সরকারী খরচে। অথচ এমনিতেই…’

চেয়ারের ওপর লাফিয়ে উঠে লালচে চুলো চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে না লিদিয়া, দেখো না কি হয়!’ জুলপি এপাশে ওপাশে দুলে মুখ হাঁ করে হেসেই চলল নিঃশব্দে।

‘ব্যাপারটা হল, গুণ্ডাদের মধ্যে যারা মদ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে না পড়বে, তারা ওই লাঠিসোঁটা আর ইটপাথর দিয়ে নিজেরা মারামারি করে মরবে, বুঝেছ?’ ‘নিজের। মারামারি করবে কেন?’ জিগ্যেস করলে মুটকো।

বয়স্কা ফের বললে, ‘এটা কিন্তু একটা রসিকতা করছ।’ লালচে চুলো তার খাটে। খাটো বাহু বিস্তার করে উত্তেজিতভাবে বলে চলল, ‘কর্তৃপক্ষ যখন ওদের দমন করে তখন বামপন্থীরা চিৎকার লাগায় অত্যাচার হচ্ছে। তাই ওরা নিজেরাই যাতে নিজেদের দমন করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ঠিক কি না?’

হঠাৎ দুলে উঠল জাহাজটা। আতঙ্কে টেবিল আঁকড়ে ধরল মুটকো মেয়েটা, ঝনঝন করে উঠল ডিশগুলো, আর বয়স্কা চেপে ধরল মুটকো লোকটার কাঁধ। কঠোর স্বরে বয়স্কা জিগ্যেস করলে: ‘কি ব্যাপার?’

জাহাজটা বাঁক নিচ্ছে…’

তটরেখা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল; স্পষ্ট হয়ে উঠতে মাখন টিয়া পাহাড় আর বাগিচায় ঢাকা কুয়াশাচ্ছন্ন পর্বত; আঙুর- বাগিচার মধ্যে মধ্যে দীল নীল পাথর, ঘন সবুজ গাছ পালার মধ্যে শাদা গাদা ঘরবাড়ি, রোদ্দুরে ঝিলিক দেওয়া জানলার শাসি। ইতিমধ্যেই বুটে উঠেছে ছোপ ছোপ রঙ- জলের ঠিক কিনারে পাথর রূপগুলোর মধ্যে দেখা গেল সমুদ্রের দিকে মুখ করা একটা ছোটে। বাড়ি, তার সামনেটা লালচে বেগুনি ফুলের যন আবরণে ঢাকা, ওপরে থাক থাক পাথর থেকে ফুটে উঠেছে রাশি রাশি রক্তিম জিরেনিয়াম। এই বর্ণসমারোহের ফলে উপকুলটা দেখাচ্ছিল উষ্ণ আর লোভনীয়, পর্বতের নরম ভৌল যেন বাগিচার শীতল ছায়ায় ডাক দিচ্ছে হাতছানি দিয়ে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুটকো বললে, ‘সব কিছুই এখানে কি ভীষণ ঘিজি।’ নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে বয়স্কা তাকিয়ে দেখল ওকে, তারপর ঠোঁট কুঁচকে মাথা হেলিয়ে লরনেট দিয়ে নজর করে দেখতে লাগল তটভূমি। ডেকে ইতিমধ্যে হালকা স্যুট-পরা গাঢ় রঙের অনেকগুলি মানুষ এসে হাজির হয়েছিল, কথা কইছিল উচ্চ স্বরে। রুশ মহিলারা তাদের দিকে উদ্ধত অবজ্ঞায় তাকিয়ে দেখলে যেন বাণী তাকিয়ে দেখছে প্রজাদের।

তরুণী মন্তব্য করলে, ‘কথা কইবার সময় কি রকম অঙ্গভঙ্গি করে ওরা।’ মুটকো বুঝিয়ে দিলে:

‘ওটা হল ওদের ভাষার একটা বৈশিষ্ট্য, সে ভাষায় এত দৈন্য যে অঙ্গভঙ্গি করে না বোঝালে চলে না…’

গভীর শ্বাস ফেলে বয়স্কা বললে, ‘মাগো!’ তারপর একটুখানি গেমে জিগ্যেস করলে:

‘জেনোয়াতেও কি অনেকগুলো যাদুঘর আছে?,

‘আমার ধারণা, মাত্র তিনটে যাদুঘর আছে।’ জবাব দিলে মুটকো।

‘আর সেই সমাধি ক্ষেত্র?’ জিগ্যেস করলে তরুণী।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাম্পো সান্টো। গির্জাও আছে অবিশ্যি।’

‘আর কোচোয়ানেরাও নিশ্চয়ই নে-এর কোচোয়ানদের মতোই হতচ্ছাড়া?’

লালচে চুলো আর জুলপি দুজনে উঠে চলে গেল রেলিংএর কাছে, গেল নিবিষ্ট মনে আলাপ করতে করতে। একই সঙ্গে কথা কইছিল ওরা দুজনেই।

সুচারু খোঁপায় হাত বুলোতে বুলোতে মহিলা জিগ্যেস করলে, ‘কি বলছে ‘ওই ইতালিয়ানটা?’ মহিলার কুনুইগুলো খোঁচা খোঁচা; বড়ো বড়ো কান দুটোকে মনে হয় গাছের দুটো শুকনো পাতার মতো। মুটকো তৎক্ষণাৎ বাধ্যের মতো কোঁকড়া চুল ইতালিয়ানটার উচ্ছল কথাবার্তা শুনতে লাগল কান পেতে।

‘ওদের একটা আইন আছে সিনোরি, আইনটা নিশ্চয়ই বহু আগেকার, তাতে ইহুদীদের মস্কো আসা নিষিদ্ধ-বোঝাই যায় আইনটা স্বৈরাচারী আমলের, সেই ভয়ঙ্কর ইভানের সময়কার জের আর কি! এমনি কি ইংল্যাণ্ডেও আজো পর্যন্ত অনেক সেকেলে আইন চালু আছে। কিন্তু এই বিশেষ ইহুদীটা হয়ত আমাকে মিছে করে বলছিল, যাই হোক, মোটের ওপর জারদের প্রাচীন নগর পুণ্যধাম মস্কো যাবার অধিকার যে কোনো কারণেই হোক তার ছিল না…’

‘আর এই রোমে, মস্কোর চেয়ে যা অনেক বেশি প্রাচীন, অনেক বেশি পুণ্যস্থান, এখানে মেয়র হল একজন ইহুদী’, হেসে খললে তরুণটি।

‘দদি পোপকে সে চালমাৎ করলই বা কি রকম।’ হাততালি দিয়ে ফোড়ন কাটিল এক চশমা পরা বুড়ো।

লরনেট নামিয়ে মহিলা জিগ্যেস করল, ‘বুড়ো মানুষটা চ্যাঁচাচ্ছে কেন?’

‘কোনো একটা বাজে কথা হচ্ছে নিশ্চয়ই। ওরা নো-এর উপভাষার কথা কইছে…’

‘ইহুদীটা মস্কো গিয়েছিল, কিন্তু থাকবে কোথায়? তাই একটা বেশ্যার ঘরে গিয়ে উঠেছিল, সিনোরি। বলছিল, আর কোথাও নাকি যাবার জায়গা ছিল না…’

‘স্রেফ গাঁজাখুরী গল্প।’ যে লোকটা গল্প বলছিল হাত দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ে ঘোষণা করলে বুড়োটা।

‘সত্যি বলতে কি, আমার নিজেরও তাই ধারণা।’

‘কিন্তু তারপর কি হল?’ জিগ্যেস করলে তরুণ।

‘বেশ্যাটা ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিল। তার আগে অবশ্য খরিদ্দারদের কাছ থেকে যা নেবার সে টাকাটা নিয়ে নিয়েছিল ঠিকই…’

বুড়োটা বললে, ‘যতো বদমাইসী! লোকটার কল্পনা-শক্তিটা বেশ নোংরা, এই হল কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু রুশের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। চমৎকার লোক তারা …’

ঘর্মাক্ত মুখটা রুমাল দিয়ে মুছে মুটকো রুশ ভদ্রলোক অলস নির্বিকার সুরে মহিলাদের বললে:

‘ও একটা ইহুদীর গল্প বলছে।’

‘তাই নিয়ে এতো উৎসাহ।’ তরুণী হাসল, আর বয়স্কা মন্তব্য

করলে:

কি জানিস, অঙ্গভঙ্গি করে চিৎকার করে কথা বলিরে এই সব এই লোকগুলো কিন্তু কেন জানি তারি একবেরে…

তটভূমিতে চোখের সামনে বড়ো হয়ে উঠছিল শহরটা; পাহাড়ের পেছন থেকে আয়প্রকাশ করল ঘরবাড়ি। প্রথমে ছাড়া ছাড়া ভাবে পরে তাদের মধ্যেকার দূরত্ব কমতে কমতে সারি বেঁধে নীরেট হয়ে এল সব দালান কোঠা। সূর্যের আলোয় মনে হচ্ছিল বুঝি যেন সব আইভরি থেকে খোদাই করে তোলা।উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘ঠিক ইয়ালটার মতো দেখতে। যাই, লিজার কাছে চলি।’

ডেকর ওপর দিয়ে অয় অর দুলতে দুলতে হেঁটে গেল সে, বিপুল দেহটা ফিকে নীল পোষাকে ঢাকা। ইতালিয়ানদের দঙ্গলটার পাশ দিয়ে যাবার সময় পাকাচুলো লোকটা তাদের আলাপ থামিয়ে নিচু গলায় বললে:

‘চোখ দুটো কি সুন্দর।’

‘হ্যাঁ।’ মাথা নেড়ে বললে চশমা-পরা বুড়ো, ‘বাসিলিদাও বোধ হয় এই রকমই দেখতে ছিল।’

‘কিন্তু বাসিলিদা তো বাইজানটাইন, তাই নয়?’

‘আমার কল্পনায় সে স্নাত…’

‘ওরা লিদিয়া সম্পর্কে কথা কইছে।’ বললে মুটকো।

‘কি বলছে?’ জিগ্যেস করল মহিলা, ‘নিশ্চয়ই অপমানকর কিছু?’

‘না, বলছে ওর চোখ সম্পর্কে। প্রশংসা করছে…’

মহিলা মুখ বাঁকাল।

পেতলের কাজগুলো ঝকমক করছিল স্টিমারের, তীরের দিকে দ্রুত এবং মসৃণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল স্টিমারটা। জাহাজঘাটীর কালো দেয়ালের ওপাশে মাস্তুলের অরণ্য। এখানে ওখানে উজ্জ্বল নিশান বালে আছে স্থির হয়ে। বাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে কালো কালো ধোঁয়া। তেল আর কয়লাগু ডোের গন্ধ আর বন্দরের ঝনঝন আর মহা নগরের ভাঙা ভাঙা গর্জন এসে পৌঁছল জাহাজে।

মুটকো লোকটা হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল। বিবর্ণ ধূসর চোখ কুঁচকে মহিলা জিগ্যেস করলে, ‘হাসির কি হল?’ ‘জার্মানরা ওদের দফা সারবে, ভগবানের দিব্যি, দেখে নিও!” ‘তাতে খুশির কি আছে তোমার?’

‘জানি না…’

জুলপি তার পায়ের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় নিখুঁত ব্যাকরণ সম্মত উচ্চারণ করে বললে:

‘তোমার পক্ষে সেটা বেশ একটা প্রীতিকর বিস্ময় হবে তাহলে, নাকি হবে না?’

অন্য জন দারুণভাবে মোচ পাকাল, উত্তর দিলে না। গতি থেমে এল স্টিমারের। মর্মর সৌধ, আর উন্নত মিনার অথবা জালি পাথরের কাজ করা গাড়ি বারান্দার কোনো ছায়া নেই সমুদ্রের ঘোলা সবুজ জলের ওপর। যে জল যেন অভিযোগে ফেটে পড়ে কাঁপতে কাঁপতে আছড়ে পড়ল জাহাজের গায়ে। নানা রকমের নৌকো-জাহাজে ঠেসে ভরা বন্দরের অন্ধকার উদর উন্মুক্ত হল ওদের গ্রহণ করবার জন্যে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024