শ্রী নিখিলনাথ রায়
ইহার পর ইংরেজদিগের সহিত সিরাজের ঘোরতর বিবাদ আরম্ভ হইলে, সিরাজ কলিকাতা আক্রমণ করিলেন। হলউয়েল সাহেব অন্ধকূপ হইতে বহির্গত হইয়া মুর্শিদাবাদে আনীত হইলেন। তথায় কিছুদিন বন্দি-ভাবে অবস্থানের পর, একদিন সিরাজের সহিত সাক্ষাৎ হইলে, সিরাজ, তাঁহাদিগকে নিষ্কৃতি দিবার অনুমতি দেন। হলওয়েল সাহেব বলেন যে, আলিবীন্দর বেগম নাকি তাঁহাদিগের মুক্তির জন্য সিরাজকে অনুরোধ করিয়াছিলেন। হলওয়েল লিখিয়াছেন যে, যখন তাঁহারা মুর্শিদাবাদে বন্দী-অবস্থায় ছিলেন, সেই সময়ে এক দিন প্রাতঃকালে আলিবন্দীর বেগমের এক জন পরিচারিকাকে তাঁহাদের প্রহরী শেখের সহিত এইরূপ বলাবলি করিতে শুনেন যে, পূর্ব্ব দিন খানার সময় বেগম ইংরেজদিগকে ছাড়িয়া দিবার জন্য নবাবুকে বলিয়াছেন।
তাহার পর তাঁহারা আবার অবগত হন যে, তাঁহাদিগকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হইয়া পুনর্ব্বার কলিকাতায় যাইতে হইবে। কিন্তু অবশেষে সিরাজউদ্দৌলার সহিত সাক্ষাৎ হইলে, তিনি তাঁহাদিগকে মুক্তি প্রদান করিতে আদেশ দেন। হলওয়েল আপনাদিগের প্রাণরক্ষার জন্ত বেগমকে বারংবার ধন্যবাদ প্রদান করিয়াছেন। হলওয়েল আরও এক স্কুলে বলিয়াছেন যে, নবাববেগম সিরাজকে তাঁহার অযথা অত্যাচার হইতে নিবৃত্ত হইতে নিষেধ করিতেন; কিন্তু সিরাজ তাঁহার সকল কথায় মনোযোগ দিতেন না। বেগম ইংরেজদিগের সহিত বিবাদ করিতে বারংবার নিষেধ করেন এবং উক্ত বিবাদে সিরাজের সর্ব্বনাশ হইবার কথাও বলেন।। পরন্তু হলওয়েল সাহেবের সমস্ত কথা আমরা স্বীকার করিতে পারি না।
প্রচলিত ইতিহাসে দেখা যায় যে, নবাব আলিবন্দী খাঁ সিরাজকে দুংরোজাদগের সহিত বিবাদ করিতে নিষেধ করিয়া যান। কিন্তু ফে কথা যথার্থ বলিয়া বোধ হয় না। তিনি ইংরেজদিগকে বিশেষ সে দমনের জন্ত মৃত্যুশয্যায়- সিরাজকে উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেপে আলিবদীর বেগম যে সে বিষয় জানিতেন না, ইহা আমাদের বিশ্বাস হয় না। বিশেষতঃ রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁহার-যতদূর দূরদর্শিতা ছিল, তাহাতে তিনি যে আলিবন্দীর মতের সম্পূর্ণ পক্ষপাতিনী ছিলেন, ইহাই আমাদের মনে উদয় হয়। সুতরাং ইংরেজদিগের সহিত সিরাজকে বিবাদ করিতে তাঁহার নিষেধ করা আমরা তাদৃশ সঙ্গত মনে করিতে পারি না। তবে সিরাজ যখন কোন নিষ্ঠুর বা গর্হিত পন্থা অবলম্বন করিতে যাইতেন, তখন তিনি তাঁহাকে সেই পন্থাবলম্বনে বাধা দিতেন বলিয়াই বোধ হয়।
আমাদিগের বিশ্বাস, সিরাজ ইংরেজদিগের সহিত কখনও অসদ্ব্যবহার করেন নাই; বরং তদানীন্তন ইংরেজেরাই সাধুজনের বিপরীত ব্যবহার করিয়া সভ্য ইউরোপখণ্ডের নামে কলঙ্কপ্রদান করিয়া- ছেন। এস্থলে উক্ত বিষয়ের অধিক আলোচনার প্রয়োজন নাই। ইংরেজদিগের সহিত বিবাদ গুরুতর হইয়া উঠিলে, সিরাজ কর্মচারি- গণের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর রণক্ষেত্রে পরাজিত হইয়া, অবশেষে মীরণের আদেশে নিহত হন এবং মীরজাফর বাঙ্গলা, বিহার ও উড়িষ্যার মসনদে উপবেশন করেন। এই সময় হইতে নবাব আলিবর্দী খাঁর পরিবারবর্গের প্রতি অত্যন্ত অত্যাচার আরম্ভ হয়।
Leave a Reply