শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:৪২ পূর্বাহ্ন

ইতালির রূপকথা (প্রতিহিংসা)

  • Update Time : বুধবার, ২৯ মে, ২০২৪, ৮.৩০ পিএম

মাক্সিম গোর্কি

পিতামহদের হাড় দিয়ে যে মাটি উর্বর হয়েছে, সেই মাটি থেকে মানুষ যখন এক টুকরো রুটিও না পায়, অভাবের তাড়নায় যদি মানুষকে স্বদেশ ছেড়ে চলে যেতে হয় দক্ষিণ আমেরিকায়, আর সে যাত্রাও আবার বাড়ি থেকে তিরিশ দিন ব্যাপী এক যাত্রা- জীবন যদি এমনি হয়ে ওঠে, তাহলে কি করার থাকে মানুষের?

সে যেই হোক না কেন, মানুষটা হয়ে দাঁড়ায় যেন মায়ের বুক থেকে ছিন্ন করে আনা এক শিশু। বিদেশ বিভুঁয়ের মদ তার কাছে লাগে তেতো, তাতে আনন্দ না জেগে, জেগে ওঠে যতো বাসনা, স্পঞ্জের মতো সে হয়ে ওঠে অস্থির আর স্কুল, আর মাতৃভূমির বুক থেকে ছিঁড়ে আনা তার হৃদয় সলোভে আকর্ষণ করে নেয় যতো কিছু কু, যতো কিছু মন্দ সব, ঠিক যেমন করে স্পঞ্জ আকর্ষণ করে নেয় জল।

ঘর ছেড়ে কালাপানি পার হবার আগে কালাব্রিয়ায় আমাদের জোয়ান ছেলেরা সাধারণত বিয়ে করে যায়। হয়ত তাদের ধারণা যে একটা মেয়ের জন্যে ভালোবাসা থাকলে দেশের জন্যে ভালোবাসাও বেড়ে যাবে-কেননা একটা মরদকে দেশ যেমন টানে, তেমনি টানে তার মেয়েমানুষ; সত্যিকারের প্রেমের টান ছাড়া বিদেশে বিভুঁয়ে তাকে বাঁচাবার মতো ভালো জিনিস যার কিছুই নেই: সত্যিকারের যে প্রেম তাকে ডাক দিয়ে আনবে তার আপন মাটির কোলে, তার প্রিয়তমার বুকে।

কিন্তু আসন্ন বিচ্ছেদ আর দারিদ্র্যের কালো ছায়ায় এই বিয়েগুলি প্রায়ই হয়ে দাঁড়ার নিয়তি আর প্রতিহিংসা আর রক্তপাতের এক ভয়ঙ্কর নাটকের প্রস্তাবনা মাত্র। সেই ব্যাপারই ঘটেছিল কিছু- দিন আগে সেনাকিয়ার, আপ্লেনাইন পর্বতের এলাকায় যে একটা সম্প্রদায় বাস করে, তাদের মধ্যে।

সে কাহিনী যেমন সরল তেমনি ভয়ঙ্কর, যেন বাইবেলের একটা ঘটনা। কিন্তু শুরু করতে হলে আমাদের পেছিয়ে যেতে হবে পাঁচ বছর আগে। পাঁচ বছর আগে পর্বতের ওপর দিকে ছোট গ্রাম সারাসেনা’য় বাস করত একটি রূপসী যুবতী, নাম তার এমিলিয়া ব্রাক্কো। স্বামী তার চলে গিয়েছিল আমেরিকায়, মেয়েটি থাকত শ্বশুর শাশুড়ীর সঙ্গে। বেশ স্বাস্থ্যময়ী সবলা মেয়ে ছিল সে, পরিশ্রমে পটু, মিষ্টি গলার স্বর, হাসিখুশি স্বভাব, সুরসিকা। নিজের রূপ সে একটু জাহির করতে ভালোবাসত, তাতে গাঁয়ের ছোকরাগুলো আর পাহাড়ী বন-রক্ষীদের মনে কামনা জেগে উঠত বটে, কিন্তু নিপুণ বাক্যবাণে সে তার মর্যাদা বাঁচিয়ে চলত ঠিকই। তার উচ্ছল হাসিতে যতো মধুর কামনাই আলোড়িত হয়ে উঠুক, তাকে পেয়েছে এমন বড়াই কেউ কখনো করতে পারেনি।

কিন্তু দুনিয়ায় শয়তান আর বুড়ি মেয়েদের বুক ঈর্ষায় বেসন জলে তেমন আর কারো নয়। এমিলিয়া থাকত তার শাশুড়ীর সঙ্গে আর কুকাজ করার সুযোগ পেলে শয়তান কি আর হাজির না হয়ে পারে? বুড়িটা কেবলি বলত, ‘যোয়ানী ঘরে নেই, কিন্তু তোমার বাছা হাসিখুশি যে আর ধরে না। ব্যাটার কাছে লিখে জানাবো। সামলে চলো বাছা, কি করো না করো সব আমি নজর রাখছি। মনে রেখো, তোমার মান সম্মানের ওপর এ বাড়ির মান সম্মান….

প্রথম প্রথন এমিলিয়া শান্তভাবে তার শাশুড়ীকে বোঝাত, স্বামীকে সে ভালোবাসে, দোষের কাজ সে কিছুই করেনি। কিন্তু ধুড়িটা তার কদর্য সন্দেহ নিয়ে বৌকে ক্রমাগত অপমান করে চলল, আর শয়তানের প্ররোচনায় গুজব ছড়াতে লাগল যে বৌ তার লাজ- লজ্জা সব খুইয়েছে।

এ কথা কানে যেতে মেয়েটি ভয় পেয়ে গেল। বুড়ি ডাইনীটাকে সে অনুনয়-বিনয় করে বললে, গুজব ছড়িয়ে সে যেন তার সর্বনাশ না করে; শপথ নিয়ে মেয়েটি জানাল, এতটুকু সতীত্ব নষ্ট সে কখনো করেনি, স্বপ্নেও কখনো স্বামীকে ঠকাবার কথা তার মনে হয়নি। বুড়ির কিন্তু বিশ্বাস হল না।

বিদ্রূপ করে বললে, ‘এ সব শপথের দাম কি তা আমার জানা আছে। বয়স এক কালে আমারও ছিল বাছা, জানি। ও চলবে না, আমি ওকে আগেই লিখে দিয়েছি, অবিলম্বে চলে এসে মান খোয়ানোর শোধ নিক!’

আতঙ্কে হ। হয়ে জিগ্যেস করলে এমিলিয়া, ‘চিঠি লিখে দিয়েছো তুমি?’

‘দিয়েছি।’

‘বেশ…’আমাদের এদিককার লোকগুলো ঠিক আরবদের মতোই প্রতিহিংসাপরায়ণ। স্বামী ফিরলে তার কপালে কি আছে এমিলিয়া জানত।

পরের দিন শুকনো কাঠ কুড়োতে শাশুড়ী বনে গেলে এমিলিয়া তার স্কার্টের নিচে একটা কুড়ুল লুকিয়ে নিয়ে শাশুড়ীর পেছু নিল। পরে সে সেপাইদের কাছে গিয়ে বললে, শাশুড়ীকে সে খুন করেছে।

বললে, ‘বিনা দোষে কুলটা বলে লোকে ছি ছি করবে, তার চেয়ে খুনী হওয়াও ভালো।’

বিচারে মেয়েটিরই জিত হচ্ছিল। সেনাকিয়া গাঁয়ের প্রায় সমস্ত লোকই গিয়ে ওর পক্ষে সাক্ষী দিয়ে এল, অনেকে কাঁদতে কাঁদতে জজের কাছে অনুনয় করে বললে:

‘মেয়েটি নির্দোষ, অন্যায় করে ওর সর্বনাশ করা হয়েছে।’ হতভাগিনী মেয়েটির বিরুদ্ধে কথা বললেন শুধু মহামান্য আর্কবিশপ কোজ্জি। মেয়েটির দোষ নেই সে কথা তিনি মানলেন না। প্রাচীন রীতি-নীতি মান্য করে চলার কি রকম প্রয়োজন সে কথা জানালেন। লোকদের হুঁশিয়ার করে তিনি বললেন, ফ্রিনের রূপে ভুলে তার গাইত স্বভাবের প্রতি চোখ বুজে থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে গ্রীকেরা যে তুল করেছিল এরাও সেই ভুলই করতে চলেছে। যা কিছু বলবার তা সবই তিনি বললেন এবং বোধ হয় তাঁর জন্যেই এমিলিয়ার সাজা হয়ে গেল চার বছর।

পাশের গাঁয়ের লোক দোনাতো সেও গিয়েছিল এমিলিয়ার স্বামীর মতো কালাপানির পারে, বাড়িতে রেখে গিয়েছিল তার তরুণী স্ত্রীকে- মেয়েটির অবস্থা হয়েছিল সেই বিষণ্ণ পেনিলোপির মতো, জীবন বাদ দিয়ে জীবনের স্বপ্ন নিয়ে সূতো বোনা।

তিন বছর আগে দোনাতো তার মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেলে, তার বৌ তেরেসা আয়দান করেছে তার বাপের কাছে, অর্থাৎ পত্রলেবিকার স্বামীর কাছে, এবং তার সঙ্গেই বাস করছে। আবার সেই বুড়ি মেয়ে আর শয়তানের ব্যাপার আর কি। নেলস্ যাবার পয়লা সিটমারের টিকিট কাটল দোনাতো ওয়ার্নাচিয়া এবং হঠাৎ যেন ভুঁই ফুঁড়ে উদয় হল তার বাড়িতে।

বৌ আর বাপ অবাক হবার ভান করলে। দোনাতো বেশ গোঁয়ার গোছের সন্দিগ্ধ ছোকরা, প্রথমে কিছুই না বলে যে খবর পেয়েছিল তা পরখ করে দেখবে ঠিক করলে, কেননা এমিলিয়া ব্র্যাক্টোর কাছিল তার শোনা ছিল। সে বৌয়ের সঙ্গে খুব দরদ দেখিয়ে গেল, মনে হল কিছু কালের জন্য ওদের দ্বিতীয় মধুযামিনী শুরু হয়েছে, শুরু হয়েছে যৌবনের কামনার বাসর।

মা তার কানে বিষ ঢালার চেষ্টা করত, কিন্তু ও থামিয়ে দিত। মাকে বলত:

‘হয়েছে। হয়েছে। নিজেই বিচার করে দেখব, আমাকে রেহাই দাও।’

ওর জানা ছিল, যে ঘা খেয়েছে আপন মা হলেও তাকে বিশ্বাস করতে নেই।

এমনি করে গ্রীষ্মের প্রায় অর্ধেক কেটে গেল সুখে শান্তিতে, বাকি জীবনও বোধ হয় তাই কাটত, কিন্তু অল্প কিছু দিনের জন্যে ছেলে বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগে বাপ তার পুত্রবধূর সঙ্গে ফের দহরম-মহরমের চেষ্টা করতে লাগল। বুড়ো কামুকটা এগুতে গেলে কিন্তু বৌ এবার প্রতিরোধ করতে শুরু করল। তাতে ক্ষেপে গেল বুড়োটা- একটা কাঁচা নারী দেহের উপভোগ থেকে হঠাৎ অমন বঞ্চিত হওয়া বুড়োটার সইছিল না। বুড়ো ঠিক করলে, প্রতিশোধ নেবে।

‘তোর কপালে মরণ আছে’, বলে বুড়োটা ভয় দেখালে বৌকে। বৌও জবাব দিল, ‘তোর কপালেও।’

আমরা হলাম অল্প কথার মানুষ।

পরের দিন বুড়ো তার ছেলেকে বললে:

‘তোর বউ যে অসতী তা তুই জানিস?’

ছেলে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে সোজা বাপের চোখের দিকে তাকিয়ে বিগ্যেস করলে:

‘তার প্রমাণ আছে কিছু?’

‘খারা তোর বউবের আদর পেয়েছে তারা আমায় বলেছে, ওর তলপেটের দিকে একটা মস্ত তিল আছে, ঠিক কি না?’

দোনাতো বললে, ‘বেশ, বাপ হয়ে তুমি যখন বলছ, ও অসতী, তাহলে ওকে মরতেই হবে।’

নির্লজ্জ বাপ মাখা নাড়লে।

‘নিশ্চয়ই, চরিত্রহীন মেয়ের জান নিতেই হবে।’

‘চরিত্রহীন পুরুষদেরও’, বলে চলে গেল দোনাতো।

বৌয়ের কাছে গিয়ে দোনাতো তার ভারি ভারি হাত দুখানা দিয়ে ওর কাঁধ চেপে ধরে বললে:

‘শোনো, আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে বেইমানি করেছিলে। বেইমানি করার আগে এবং পরে আমাদের মধ্যে যে ভালোবাসা ছিল,

তার দোহাই দিরে জিগ্যেস করছি, বলো, লোকটা কে?’

ও চেঁচিয়ে উঠল, ‘তোমার সর্বনাশা বাপই কেবল জানে। কেবল সেই…’

‘তাহলে, আমার বাপই?’ জিগ্যেস করলে চাষী, রক্তে লাল হয়ে উঠেছে ওর চোখ।

‘জোর করে, ভয় দেখিয়ে ও আমাকে নিয়েছিল। কিন্তু সব কথাটুকু আগে শোনো…’

দন নেবার জন্যে ও থামল। বৌকে ঝাঁকনি নিয়ে স্বামী চেঁচিয়ে উঠল:

‘বলো!’

হতাশায় ফিসফিস করে বৌ বললে, ‘হ্যাঁ, ও আর আমি- স্বামীস্ত্রীর মতো আমরা শুয়েছি প্রায় তিরিশ কি চল্লিশ বার…

দোনাতো বাড়ির ভেতর থেকে বন্দুক নিয়ে ছুটে গেল মাঠে, যেখানে গিয়েছিল ওর বাপ। তারপর এই রকম মুহূর্তে নরদর। পরস্পরকে যা বলে সেই সব কথা বলে দুটি গুলিতে ও বাপের জান শেষ করে দিল। লাসটার ওপর খুতু ফেললে ও, রাইফেলের কুঁদো দিয়ে চুরমার করে দিলে মাথার খুলি। লোকে বলে লাসটা নিয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে নাস্তানাবুদ করেছিল, পিঠের ওপর নাকি লাফিয়ে উঠে নাচতে শুরু করেছিল প্রতিশোধের নাচ।

তারপর বন্দুকে গুলি ভরে ও গেল তার বৌয়ের কাছে।

বললে:

‘চার পা পেছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে শেষ প্রার্থনা করে নাও…’ ও কাঁদতে কাঁদতে প্রাণভিক্ষা করলে।

স্বামী বললে, ‘না। যা ন্যায্য তা আমাকে করতেই হবে, আমি যদি তোমার ওপর বেইমানি করতাম, তাহলে তুমিও যা করতে, তাই আমি করব…’

পাখি মারার মতো করে ও বৌকে মেরে গিয়ে আত্মসমর্পণ করলে কর্তৃপক্ষের কাছে। গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে ও যখন হেঁটে গেল তখন লোকে ওর পথ করে দিলে। অনেকে বললে:

‘ইমানদার আদমীর মতো কাজ করেছো তুমি, দোনাতো…’ বিচারের সময় সে আত্মসমর্থন করলে এক ভয়ঙ্কর তেজে, আদিম এক প্রাণের যতো কিছু স্কুল বাগ্মিতার জোরে।

‘যদি আমি কোনো মেয়েকে নিই, তো নেবো এই জন্যে যে আমাদের প্রেম থেকে জন্য নেবে শিশু, তার মধ্যে সে আমি- আমরা দুজনেই বেঁচে থাকব। মানুষ যখন ভালোবাসে তখন কে তার বাপ কে তার মা? প্রেম ছাড়া আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব কাছে থাকে না। ভালোবাসা অমর হয়ে উঠুক। আর সে ভালোবাসার যারা অপমান করে, সে নারী হোক কি পুরুষ হোক, অভিশাপ লাগুক তাদের ওপর। বন্ধ্যা হোক তারা, নপুংসক হয়ে যাক, মড়ক এসে গ্রাস করুক তাদের, যন্ত্রণা পেয়ে পেয়ে তারা মরুক…’

ওর পক্ষের উকিল দাবি করেছিল, জুরি যেন এই রায় দেয় যে রাগের বশে খুন হয়ে গেছে। জুরি কিন্তু জনগণের তুমুল উল্লাসের মধ্যে দোনাতোকে একেবারেই খালাস দিয়ে দিলে। বিজয়ী বীরের মতো দোনাতো ফিরে এল সেনাকিয়ায়। ইজ্জত নষ্টের জবাবে রক্তাক্ত প্রতিহিংসার প্রাচীন জাতীয় ঐতিহ্যের কঠিন অনুগামী হিসাবে অভিনন্দিত হল দোনাতো।

দোনাতোর মুক্তির কিছু পরেই এমিলিয়া ব্রাক্কো জেল থেকে ছাড়া পেল। তখন শীতকাল- প্রকৃতি সে সময় শোকার্ত। খ্রীষ্ট জন্মের উৎসব এগিয়ে আসছিল, সে সময় লোকে সব চেয়ে বেশি করে চায় নিজেদের আয়পরিজনের মধ্যে, নিজেদের গরম ঘরের কোণে ফিরতে। কিন্তু এমিলিয়া আর দোনাতো রইল নিঃসঙ্গ, কেননা তাদের খ্যাতিটা এমন যে তাতে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রীতি মেলে না- যতই হোক না কেন, যে খুন করেছে সে খুনীই থেকে যায় চিরকাল। সে লোককে স্তম্ভিত করে দিতে পারে, তার কাজ উচিত হয়েছে এ সমর্থনলাভও সে করতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা পাবে কেমন করে? এদের দুজনের হাতই হল রক্তমাখা, দুজনের মনই ভাঙা। বিচারালয়ের রূঢ় নাটকের মধ্যে দিয়ে এরা এসেছে দুজনেই। তাই ভাগ্য বিড়ম্বিত এই দুটো মানুষ যে পরস্পরের কাছাকাছি হবে, দুজনের ভাঙা জীবন আলো করে তুলতে চাইবে দুজনে, তাতে সেনাকিয়ার লোকেদের কাছে অবাক লাগেনি, কেননা ওদের দুজনেরই বয়স কম- দুজনেরই এন কাঁদে আদরের জন্যে।

অতীতের এই সব কষ্টের স্মৃতির মাঝখানে থেকে এখানে কি করব আমরা?’ প্রথম চুম্বন বিনিময়ের পর দোনাতো বললে এমিলিয়ার কাছে।

এমিলিয়া বললে, ‘আমার স্বামী ফিরলে নির্ঘাৎ সে আমার প্রাণ দেবে, কেননা এখন আমার চিন্তায় সত্যি করেই আমি তার প্রতি অসতী হয়ে পড়েছি।’

ওরা ঠিক করলে যাবার মতো টাকা জমাতে পারা মাত্রই ওরা সমুদ্র পাড়ি দেবে, হয়ত পৃথিবীর কোথাও কিছু সুখ আর শাস্তি ঘের। একটু ঘর তারা পেয়েও যেতে পারে। কিন্তু যে লোকগুলোর মধ্যে তারা বাস করছিল, তারা বলাবলি করলে:

‘রাগের বশে খুন করে বসা আমরা ক্ষমা করতে পারি। ইজ্জত রক্ষার জন্যে যে অপরাধ, তা আমরা সোল্লাসে সমর্থন করেছি। কিন্তু এ দুটি লোক কি ঠিক সেই ঐতিহ্যকেই পায়ে দলছে না, যার নামে অত রক্ত ঝরল?’

এই রূঢ় নির্মম বিচার কঠোর কোন প্রাচীন যুগের এই প্রতিধ্বনি ক্রমেই উঁচু হতে হতে শেষ পর্যন্ত কানে গেল এমিলিয়ার না, সেরাফিনা আমাতোর। গর্বময়ী সবলা এক নারী ছিল আমাতো, পাহাড়ে মেয়ে সে, পঞ্চাশ বছর বয়স সত্ত্বেও রূপ তার নষ্ট হয়নি।

এই অসম্মানের গুজবটাকে প্রথম প্রথম সে বিশ্বাস করেনি। বললে: ‘নেহাৎ কুৎসা। মান বাঁচাবার জন্যে আমার মেয়ে কি কষ্ট পেয়েছিল তা কি তোমরা ভুলে গেছো?’

লোকে বললে, ‘আমরা ভুলিনি, ভুলেছে সেই।’

সেরাফিনা বাস করত অন্য খাঁয়ে। গাঁ থেকে একদিন সে তাই এল মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। বললে ‘লোকে তোর নামে নানা কথা বলতে শুরু করেছে। তোর নামে এ সব অপবাদ শুনতে আমি রাজী নই। অতীতে যা করেছিলি, রক্তারক্তি সয়েও সে ছিল এক নিষ্পাপ নারীর ইজ্জতের কাজ-সে কাজ চিরকাল সব লোকের কাছে একটা দৃষ্টান্ত করেই রাখতে হবে।’ মেয়ে তার কাঁদতে শুরু করলে।

‘মানুষের জন্যে পৃথিবী, কিন্তু কেমন সে মানুষ যদি নিজের জন্যে নিজে যে না বাঁচতে পারে?…’

না বলবে, ‘এর জবাব জানিস না এমন বোকাই যদি হোস তো পুরুতকে গিয়ে জিগ্যেস করগে।’

না তারপর গেল দোনাতোর কাছে, কড়া করে তাকে হুঁশিয়ার করে দিলে:

‘আমার মেয়েকে রেহাই দাও, নইলে পরে পস্তাবে।’

জোয়ান লোকটা মিনতি করে বললে, ‘কথা শোনো, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আমি তোমার মেয়েকে ভালোবাসি। যেমন হতভাগ্য আমি, তেমনি যে। অনুমতি দাও, ওকে নিয়ে অন্য দেশে চলে যাই, তাতে সব দিক থেকেই মঙ্গল।’

তাতে কিন্তু আগুনে যি পড়ল।

ক্রোবে হতাশায় চেঁচিয়ে উঠল সেরাফিনা, ‘পালিয়ে যেতে চাও তোমরা? কখনই তা চলবে না!’

যে যার ওরা চলে গেল জন্তর মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে, শত্রুর মতো আক্রোশ ভরা চোখে পরস্পরের দিকে তাকাতে তাকাতে।

পাকা কুকুর যেমন করে শিকারের পেছনে ঘাপটি মেরে থাকে। সেদিন থেকে সেরাফিনা তেমনি করে ঘাপটি মেরে থাকতে শুরু করল প্রেমিক যুগলের পেছনে। কিন্তু তাতে ওদের গোপন রাত্রির মিলানে বাধা হল না, কেননা প্রেমও হল জন্তর মতোই চতুর আর বদ্ধিমান। কিন্তু একদিন সেরাফিনার কানে গেল, ওয়ার্নাচিয়া আর তার মেয়ে পালাবার মতলব ভাঁজছে। শুনেই সেই অশুভ মুহর্তে ভয়ঙ্কর এক কাজ করার শপথ নিলে সেরাফিনা।

রবিবারে লোকেরা গেছে গির্জায় ‘মাহ্’ শোনবার জন্যে। সামনের দিকে দাঁড়িয়েছে মেয়েরা, পরনে তাদের পরবের দিনের রংচঙা স্কার্ট আর শাল। তাদের পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে পুরুষেরা। আমাদের প্রেমিক যুগলও এসেছিল মাডোনার কাছে সাহায্যের জন্যে প্রার্থনা করতে। সেরাফিনা আমাতো গির্জায় এলো অন্য সকলের চেয়ে দেরী করে। তারও পরনে পরব দিনের পোষাক। স্কার্টের ওপর চওড়া নক্সা তোলা একটা এপ্রণ, আর সেই এপ্রণের নীচে সে লুকিয়ে এনেছিল একটি কুড়ুল।

মুখে প্রার্থনা নিয়ে ধীরে ধীরে সে এগিয়ে গেল সেনাকিয়ার কুলদেবতা আর্ক এঞ্জেল মিখাইন্সের প্রতিমূর্তির দিকে। হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে স্পর্শ করলে প্রতিমূর্তির হাত আর নিজের ঠোঁট। তারপর চুপি চুপি এগিয়ে গেল তার মেয়ের প্ররোচকের কাছে- অন্য সকলের সঙ্গে সেও বসে ছিল হাঁটু গেড়ে। তারপর মাথার ওপর দুটি আঘাতে গর্ত করে প্রতিহিংসার প্রতীক হিসেবে এঁকে দিলে রোমান অক্ষর ১ অর্থাৎ ভেনদেত্তা।

আতঙ্কের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল ভিড়ের মধ্যে। চেঁচামেচি করে লোকে ছুটল বাইরে যাবার দরজার দিকে। টালি দিয়ে বাঁধানো মেঝের ওপর অনেকে পড়ল অজ্ঞান হয়ে, অনেক কাঁদতে লাগল ছেলেমানুষের মতো।

কিন্তু যেন এক ন্যায়ের দেবী, গ্রাম্য নেমেজিদার মতো সেরাফিনা দাঁড়িয়ে রইল বেচারী দোনাতো আর তার জ্ঞানহীন মেয়ের ওপর কুড় লখানা তুলে।

বহুক্ষণ অমনি ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর হতভম্ব ভাৰ কাটিয়ে লোকে যখন তাকে এসে ধরল, তখন সে তার বন্য আনন্দে জলে-ওঠা চোখ দুখানা স্বর্গের দিকে তুলে সজোরে প্রার্থনা করতে শুরু করলে:

‘নহায়া মিখাইল, আমার কৃতজ্ঞতা নাও! আমার মেয়ের সম্মান বাঁচাবার জন্যে প্রতিহিংসা নেবার শক্তি আমি তোমার দয়াতেই পেয়েছি!’

ও যখন শুনলে, ওয়ার্নাচিয়া বেঁচে আছে, তাকে বৈদ্যের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানে তার মারাত্মক জখমগুলো ব্যাণ্ডেজ করে দেওয়া হচ্ছে, তখন ভয়ানক কাঁপতে শুরু করলে সে; আতঙ্কিত উন্মাদ চোখ দুটো বিস্ফারিত করে সে বললে:

‘না, না, হতে পারে না, ভগবানে বিশ্বাস আছে ‘আমার। ও লোকটা মরতে বাধ্য। দু দুটো মারাত্মক জখম করেছি আমি-ত টের পেয়েছিলাম- ভগবান অন্যায় করেন না কখনো, ও মরবেই!…’

শীগগিরই অবশ্য বিচার হবে মেয়েটার। কঠিন সাজাও তার হবে, কিন্তু যে বিশ্বাস করে, অন্যকে জখম করার অধিকার তার আছে, সাজা দিয়ে কি শিক্ষা হবে তার? পিটিয়ে পিটিয়ে কি লোহাকে কখনে। নরম করা যায়?

বিচারক মানুষকে বলে: ‘তুমি দোষী।’

মানুষ জবাব দেয়, ‘দোখী হই, নির্দোষ হই, আগে যা ছিল সবই যে রয়ে গেল।’

আর শেষ কথা সিনোরি, সে হল এই যে ভগবান মানুষকে যে দেশে জন্ম দিয়ে পাঠিয়েছে, যে দেশের মাটি তাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে নারী, সেই দেশেই সে বাড়ুক, সেইখানেই তার বংশবৃদ্ধি হতে থাক..

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024