মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
পাখার বাতাস গরম হ’য়ে উঠেছে। বাইরের রোদ একটু একটু ক’রে বিকেলের দিকে গড়াচ্ছে। এক সময় শান্ত হ’য়ে এলো নীলাভাবী। বললে, ‘তোমার মনটাই আজ খারাপ ক’রে দিলাম। কি আর করবো। অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম তোমাকে বলবো এসব, সত্যিই ভিতরে ভিতরে দারুণ হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ভালোই হ’লো একরকম, বুকের ওপর থেকে পাথরটা খানিক স’রে গিয়েছে।
আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তোমার রাজীব ভাইয়ের; এস্রাজ ম্যাজিক গল্প সবই এখন অন্য এক গল্প হ’য়ে গিয়েছে, অথচ একদিন শুতে যাবার আগে হাত নিশপিশ করতো মানুষ- টার, কিছুতেই ঘুম আসতো না, এস্রাজে ছড় বুলানো চাই, মানুষ খুঁজে বেড়াতো গল্প জমাবে ব’লে। যে অভ্যেসগুলোকে ও সবচেয়ে বেশি ভালবাসতো অলক্ষ্যে সেইগুলোই ওকে ছেড়ে চ’লে গেছে। তবু বেঁচে আছে মানুষটা।
টিকে আছে। কিন্তু টিকে আছে কি ক’রে তা জানো? ভালবাসাটা ওর স্বভাব, এখনো মরেনি সেটা। সব ওকে ছেড়ে গেছে, কিসের একটা ভারে দিন দিন ও ন্যুজ হ’য়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওর ওই ভালবাসার স্বভাব এখনো ছেড়ে যায়নি ওকে।’
একটু থেমে খোকাকে একবার নিখুঁতভাবে জরিপ ক’রে নিলো নীলাভাবী; তারপর খুব আচ্ছন্নভাবে বললে, ‘তুমি আমার কথা বুঝতে পারছো তো?’
‘কিছু কিছু’ খোকার উত্তরে প্রচ্ছন্ন বিরাগ।
‘এতসব কথার পর তোমার ঠিক বিশ্বাস হবে কি না জানি না- এসাজের চেয়ে, গল্পের চেয়ে, গানের চেয়ে ও আমাকে আলাদা ক’রে কখনো ভালবাসতে পারেনি, বেশ কিছুদিন পরে আমি একথা বুঝতে পেরেছিলাম। তুমি বলবে তাহলে অন্য সবকিছুই যখন ছেড়ে দিলো মানু- ষটা, সেখানে তুমি টিকে গেলে কি ক’রে। আমি তো আর ছিটের খোলে মোড়া কঙ্কালের মতো একটা এস্রাজ কিংবা ম্যাজিক দেখানো জারিজুরি করা তাসের প্যাকেট নই, যে ছেড়ে দিলেই অমনি ল্যাঠা চুকে যাবে। ও ছাড়লেও আমি তো আর ওকে ছাড়ছিনে; এস্রাজ কিংবা তাসের প্যাকেটের সঙ্গে আমার তফাৎটা শুধু এইখানেই।
এখন যে ও সেই আগের মতো গল্প জমাতে পারে না, গান গাইতে পারে না, তার জন্যে ওর কিন্তু কোনো খেদ নেই। দেখলাম এই নিয়ে যা কিছু মাথাব্যথা সব একা আমার। রাজ্যির সব গ্রহরত্নের মধ্যে ডুবে আছে। ওই গ্রহরত্ন গ্রহরত্ন ক’রে ছেড়ে দিলো চাকরিটাও। তুমি শুনতে চাও আর না চাও পাথরের গল্প শোনাতে শোনাতে রাত ভোর ক’রে দিতে পারে ও এখন।
Leave a Reply