মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
সবকিছু একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার মনে হ’লো আমার। ভিতরের সব কষ্ট, সব খেদ, গ্লানি, যা এতদিন ঘৌট পাকাচ্ছিলো কেবলমাত্র স্বামীকে ঘিরে সহসা তা ঝলমল ক’রে ঝল্ল্সে উঠলো; এইবার নিজেকে নিয়ে পড়লাম আমি। এতদিন পর নিজের জন্যে স্বার্থপরের মতো ব্যাকুল হ’য়ে পড়লাম, নিরাকার ভূতুড়ে আয়নার সামনে মেলে ধরলাম নিজেকে। রীতিমতো উল্টো ব্যাপার। এতদিন স্বামীর কথা ভেবে যতো খেদ স্তূপাকার করেছি, তা কেবল নিজের জন্যে, নতুন ক’রে জীবনের দিকে তাকাবার জন্যে!
কি অবস্থায় এসে ঠেকেছি, আমি ভাবলাম, এ আমি কোথায়, দুর্দশার ভিতরে একেবারে গলা পর্যন্ত জুবড়ে প’ড়ে আছি; এমন কি অবশিষ্ট আছে আমার? উচ্ছিষ্ট! কারো পাতে দেবার মতো নয়, উল্টোপাল্টে দেখলাম যতো রকমে পারা যায়। পাগলের মতো অবস্থা আমার। হেঁশেলের কোণে প’ড়ে থাকা শিলনোড়া, কিংবা উঠোনের একপাশে ফেলে রাখা মুড়োঝাঁটা, আমিতো এই-ই!
নচেৎ একটা পুরানো আমলের সুখপাঠ্য বই, যা খুব যত্ন ক’রে ‘আর কোনোদিন পড়া হবে না’ এমন এক ভঙ্গিতে ঠেসে দেওয়া হয়েছে দেয়ালের নোনাধরা তাকে; বৃষ্টিতে ভিজে পচার কিংবা অক্ষরগুলো ধুয়েমুছে যাবার কোনো ভয় নেই ঠিকই, কিন্তু ভাঁজে ভাঁজে আস্তানা গাড়বে কীট, দিনের পর দিন কুরে কুরে খেয়ে খাস্তা ঝরঝরে ক’রে দেবে। এভাবে প’ড়ে থাকার চেয়ে ধ্বংস হ’য়ে যাওয়া ঢের ভালো; গরল ঘুলিয়ে উঠলো আমার ভিতরে।
হাঁসফাঁস করতে লাগলাম, এমন একটা সাইক্লোন কি টর্নেডো আসে না কেন যা বাড়িটাকে গুড়িয়ে দেবে, তাক থেকে উড়িয়ে দেবে বইটিকে, প্রতিটি অনুচ্ছেদ খসিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি ক’রে উড়িয়ে দেবে রাজ্যময়, হাততালি দিয়ে হো হো ক’রে হাসবে। তুমি এলে ঠিক এই সময়–‘ বাধা দিয়ে খোকা বললে, ‘সিকোয়েন্সগুলো একেবারে সিনেমার মতো!”
‘শুধু এলে বললে ছোট্টো ক’রে বলা হবে, তোমার আবির্ভাব হ’লো; আমার জীবনে একটা অসাধারণ অভ্যুদয় ঘটলো। অভ্যুদয় কেন বলছি জানো?”
‘নিছক ওজন বাড়াবার জন্যে।’ দাঁত দিয়ে কুটুস ক’রে একটা নখ কেটে খোকা উত্তর দিলো।
‘তার মানে?’
‘ওজন? ওজন এক ধরনের গ্যাস।’
Leave a Reply