মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
‘মানেটা এই, তুমি আমার কথা মোটেই ধরতে পারোনি?’ ‘না পারার কি আছে এতে–‘ খোকা বাধা দিয়ে বললে, ‘না পারার কি আছে এমন? সোজা কথা তোমরা যেমন দেবা, তেমনি দেবী; আমি তো কোনো ফারাক দেখতে পাইনে। রাজীব ভাই যেমন–গান থেকে গল্প, গল্প থেকে এস্রাজ, এস্রাজ থেকে তুমি, শেষে হীরা-জহরৎ, তুমিও তেমনি! প্রথমে শিলনোড়া, শিলনোড়া থেকে মুড়োঝাঁটা, মুড়ো- ঝাঁটা থেকে সুখপাঠ্য বই, শেষে এক্কেবারে মক্ষিরাণী।’
‘আমি বলছিলাম তোমার কথা। তোমার রাজীব ভাই যেমন ভাগ্যকে বদলে দেবার গ্রহরত্ন নিয়ে ঘরে ঢোকে, তেমনি ক’রে নিয়ে এলো তোমাকে। ঝলঝল ক’রে উঠলো বাড়িটা। কি বিশ্রী, স্তূপাকার ধুলো আর আবর্জনা ভরা ঘরের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলাম! সুব আবর্জনা দু’হাতে সরিয়ে ফেলতে লাগলাম, তুমি যেন এক অপ্রত্যাশিত দুর্লভ উপহার, এ উপহার যেন আমাকে মানায়, যেন বেমানান না হয় আমার ঘর–‘ ‘তবে যে এই কিছুক্ষণ মাত্র আগে বললে মাছমারা ছিপ?’ বাধা দিয়ে জিগ্যেশ করলো খোকা।
‘জ্বালিও না, কথা বলতে দাও! তোমাকে দেখে আমি বদলে গেলাম। সাজ সাজ রব প’ড়ে গেল ভিতরে। বাঁচবার জন্যে আমি হাবাগোবার মতো দৈব-দুর্বিপাককে আশ্রয় করতে চেয়েছিলাম; তার বদলে বিনা চেষ্টায় বিনা প্ররোচনায় তুমি আমাকে উৎসাহিত করলে ভিতরের প্রাণশক্তিকে যাচাই করার। আমি আমার স্বামীর কথা ভাবলাম। এই প্রশ্ন তুলে মনে মনে যাচ্ছেতাই ক্ষেপে উঠলাম, এখনো ওর যা আছে আমার তা থাকবে না কেন। ঠিক প্রতিযোগিতা কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, প্রশ্নটা একেবারে নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে।
এখনো কি অগাধ আমার ক্ষমতা, কি প্রচণ্ড আমার শক্তি। যতোই বুঝতে পারি ততই হাততালি দিয়ে উপচে পড়তে থাকি খুশিতে। ইচ্ছে করলেই আমি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারি তোমাকে, ডুবিয়ে দিতে পারি কাদায়; আমি চাই সানন্দে তুমি আমার ক্রীতদাস হবে। তোমাকে ঘুঙুরের মতো পায়ে বেঁধে রাজ্যময় নেচে বেড়াতে পারি এখনো। ও যেমন বেঁচে আছে, আমিও মরিনি, বেঁচে আছি আমিও। কি নির্লজ্জ সে উল্লাস, তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো নাঁ।’
হীরার মতো জ্বলজ্বল ক’রে জ্বলছিলো নীলাভাবী। খোকা হাবার মতো ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে থাকে। দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে নীলাভাবীর দু’চোখ দিয়ে। মাঝখানে দু’টি বিন্দুর মতো দু’জনকে বসিয়ে অকারণ আনন্দে চারটি দেয়াল যেন হাত ধরাধরি ক’রে শিশুর মতো নেচে নেচে ঘুরপাক খাচ্ছে; দেয়ালগুলো এখন জর্জিয়ান। লেসের কাজে মোড়া টিপয়ের ছাউনি দুলছে, দুলছে ফুলদানি, দুলছে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রজনীগন্ধাগুচ্ছ, ট্রানজিস্টার যেন বনবিড়াল, খাড়া ক’রে মৃদু মৃদু নাড়ছে এরিয়েললেজ; হাওয়া, এতো হাওয়া আসে কোথা থেকে, সমুদ্রের খুব কাছে তারা, কিংবা একটা জাহাজের ভিতর, হাওয়ায় মাছের ফিশ- ফিশানি, হাওয়ার গভীর গোপনে সুগোল শূন্যতাবোধ ওজনহীন এক চাঁদের মতো অবিরাম সাঁতার কাটছে।
Leave a Reply