মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
এখান থেকে বেরিয়ে সোজা কোনো একটা সেলুনে যাব, আধঘন্টা ধ’রে শিরমালিশ চালাবো, তারপর অন্য কথা, বাপস্!’
ঠিক এই সময় হুড়মুড় ক’রে অপ্রত্যাশিতভাবে ঘরে ঢুকলো রাজীব ভাই; পা থেকে মাথা ধূলায় ধূসর, দুশ্চিন্তাকাতর মুখাবয়ব। খোকা দেখলো, রাজীব ভাইয়ের চোখে জটিল চাঞ্চল্য; মনে হ’লো ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘ’টে গিয়েছে, তাড়া খেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ঘরে এসে পৌঁছেছে।
খোকাকে দেখে হাতের ব্যাগটা রাখতে রাখতে রাজীব ভাই বললে, ‘
কতোক্ষণ?’
‘তা অনেকক্ষণ, প্রায় সারাদুপুর-‘
‘বলো কি!’ কথাটা সংক্ষেপে শেষ ক’রে ব্যতিব্যস্ত হ’য়ে নীলাভাবীর দিকে তাকালো রাজীব ভাই, বললে, ‘তোয়ালে সাবান সব দাও, গোসলন করবো, গলার ভিতর পর্যন্ত ধুলোবালি কিচকিচ করছে।’
খোকা বিছানা থেকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জিগ্যেশ করলে, ‘ব্যাপার কি রাজীব ভাই, এমন হন্তদন্ত হ’য়ে কোথেকে?’
‘শহর খুব গরম।’
‘তার মানে ?
‘বাইরে তুমুল গণ্ডগোল।’
‘হঠাৎ?’
‘হঠাৎ নয়, আমি তো জানতাম-ই এই ধরনের একটা কিছু হবে। দুটোর সময় প্রেসিডেন্টের কি এক ছাতার স্পীচ ব্রডকাস্ট হয়েছে, ব্যাস্, সারা শহর ফেটে পড়েছে বারুদের মতো। স্টেডিয়ামে চেয়ার ভাঙাভাঙি, দোকানপাট সব দুদ্দাড় ক’রে বন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় কেবলি মানুষ আর মানুষ। লাঠিসোঁটা, লোহার রড, পাইপ, হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়ে ছেলে-বুড়ো-জোয়ান সব উন্মত্ত হ’য়ে বেরিয়ে পড়েছে। সব বন্ধ। গাড়ি-ঘোড়া থেকে হাওয়া-বাতাস, গাছের পাতা পর্যন্ত পড়া বন্ধ। কি বলবো, পথে-ঘাটে হাঁটার উপায় নেই, থৈথৈ করছে মানুষ। বাবারে বাবা, এতো মানুষ সব ছিলো কোথায়!’
খোকা রসিকতা ক’রে বললে, ‘এখন বুঝলেন তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং- এর মালকড়ি কিভাবেই না গুবলেট হয়।’
রাজীব ভাই সহজ গলায় বললে, ‘আসলে ওই সব দপ্তরে আমার মতো একজন কনফর্মড বিশেষজ্ঞ দরকার, কি বলো? সে যাক, তুমি কিন্তু আর মোটেও দেরি কোরো না, এখনই বেরিয়ে পড়ো। গাড়ি-ঘোড়া তো আর নেই, পায়দলই মারতে হবে। যেকোনো মুহূর্তে খুন-খারাবি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হ’য়ে যেতে পারে, শহরের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।’
অনেকক্ষণ পুর বাড়ির কথা মনে পড়লো খোকার, ছ্যাঁৎ ক’রে উঠলো বুকের ভিতর। অতোবড় বাড়িতে পুরুষ মানুষ বলতে কেউ নেই, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসে সে।
সামান্য একটু এগোলেই রাস্তা। কেবল ধুলো আর ধুলো, চারিদিক ধুলোয় অন্ধকার। অল্পক্ষণের মধ্যেই খোকা মিছিল দেখতে পায়, মহা আক্রোশে ফেটে পড়ছে মিছিলের মানুষ।
ঢল নেমেছে রাস্তায়। মানুষের এমন রুদ্রমূর্তি সে আর কখনো দেখেনি।
Leave a Reply