সুমন চট্টোপাধ্যায়
প্রশান্ত কিশোর ভারতের বেশ কিছু রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গকেও ভালোভাবে চেনেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপ্রত্যাশিত সাফল্যের তিনি অন্যতম নেপথ্য- কারিগর ছিলেন, দু’চারটি অসাধারণ স্লোগান ছিল (যেমন বাংলা তার মেয়েকেই চায়) তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো ভোট-জয়ী পরিকল্পনার প্রস্তাবও তাঁর। প্রশান্ত তখন ছিলেন নিজেরই হাতে গড়া সংস্থা আইপ্যাকের সর্বোময় কর্ণধার। সেই সংস্থা এখনও এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা সংগঠনের মতো কাজ করে কিন্তু প্রশান্ত কিশোর আর তার সঙ্গে যুক্ত নন। অন্তত তাঁর দাবি সেই রকম। ভোট-কুশলীর জোব্বা গা থেকে নামিয়ে এখন তিনি স্বরাজ্য বিহারে সুরাজ অভিযান নামক আধা রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করে রাজ্য পরিভ্রমণ করে চলেছেন। আগামী বছর বিহারের বিধানসভা ভোটে তাঁর দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে মনস্থ করেছে।
এহেন প্রশান্ত কিশোর যদি বারবার বলেন এবার পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি প্রাপ্ত আসনের নিরিখে প্রথম দল হবে তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তাহলে কি ধরে নেব তিনি তাঁর পুরোনো সংস্থার সহকর্মীদের কাছ থেকেই এই অঙ্ক সংগ্রহ করেছেন। কাগজে-কলমে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও আইপ্যাকের সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ আছে অবশ্যই। এই সংস্থার কর্তারা নিজেরাই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে কবুল করেছেন প্রশান্ত এখনও তাঁদের অভিভাবক, ঠেকায়-বেঠেকায় তাঁরা গুরুর পরামর্শ নিতে পাটনায় দৌড়ে যান। অন্য একটি সূত্রেও আমি এমন একটি ধারণার সমর্থন শুনেছি। তবে তথ্য প্রমাণ রেখে এ ধরণের বার্তালাপ হয়না, তাই আমিও অপারগ।
প্রশান্ত গত তিন মাসে অসংখ্য সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তাঁর কথায়- বার্তায় স্পষ্ট তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে তিনি কিছুটা বিরক্ত, তাঁর মোহগ্রস্ততা কেটেছে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি মমতার ভ্রাতুষ্পুত্রকে নস্যাৎ করে দিয়ে তাঁকে ফুলে গজানো টবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন,” আমার কাজ রোগীর রোগ চিহ্নিত করে তার হাতে সঠিক ওষুধের প্রেসক্রিপশন তুলে দেওয়া। কিন্তু রোগী যদি বেয়াড়া হয়, আমার কথামতো ওষুধ না খায়, আমার কী করার থাকতে পারে। আমি বললাম মিষ্টি খাবেননা, রোগী মনের সুখে তা অমান্য করে গেল, তখন ডাক্তার কী করবে?” প্রসঙ্গত প্রশান্তর বাবা ছিলেন পেশায় ডাক্তার।
ভোটের চরম উত্তেজক আবহে প্রশান্ত কিশোর বিজেপির দিকে বলটি গড়িয়ে দেওয়ার পরে যে যাঁর মতো করে তাতে লাথি মারছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গতকাল, মঙ্গলবার প্রচারে এসে গুগলি দিয়ে বলে গিয়েছেন তাঁর দল নাকি এবার বাংলায় সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফল করবে। বাকি ভোট সমীক্ষকেরাও কম বেশি প্রশান্তর কথারই প্রতিধ্বনি করছেন, এমনকী যোগেন্দ্র যাদবও বাংলা নিয়ে তেমন উচ্চবাচা করছেননা। সি-ভোটার সংস্থার কর্ণধার যশবন্ত দেশমুখও দেখলাম বরখা দাত্তর সঙ্গে আলাপচারিতায় অদ্ভুত মন্তব্য করলেন। তাঁর বিশ্লেষণে, পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি এবার খুব জটিল, কেননা ভোটারদের পছন্দ-অপছন্দে উল্লেখযোগ্য চড়াই-উতরাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন আগে দেখা যেত শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বিজেপির প্রভাব বুদ্ধির হার বেশি। এবার ঠিক উল্টো প্রবনতা লক্ষা করা যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের মোট লোকসভা আসন ৪২, বিজেপি তার মধ্যে ২০১৯ সালে একা ১৮টিতে জিতেছিল। বাংলার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সেটাই ছিল অপ্রত্যাশিত, ‘ধুয়াধার’ সাফল্য। সাধারণ বিচারে এই সাফল্য বিজেপি যদি ধরে রাখতে পারে সেটাই হবে যথেষ্ট। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই এবার বিজেপি আগের রেকর্ডকে ছাপিয়ে যাবে তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, ১৮-র উর্ধ্বে কয়টা বেশি? কোনও সমীক্ষক বুক ঠুকে তার হদিশ দিতে না পেরে গোলগোল ব্যাখ্যা শোনাচ্ছেন। তবে সব কথার শেষে এই মুহূর্তের সারকথাটি হোল পশ্চিমবঙ্গের ভোট এবার গোলকধাঁধার মতো, ভুলভুলাইয়ায় কিছুটা এগিয়ে সব পথিকই পথ হারাইতেছেন।
বাকি রইল উৎকলভূমি মানে ওডিশা যেখানে লোকসভার ২১টি আসনের সঙ্গে এবার বিধানসভার ভোটও হচ্ছে। নবীন পট্টনায়ক যতদিন জীবিত ও কর্মক্ষম আছেন ওড়িশায় রাজা সরকার পরিচালনার ভার অন্যের হাতে যাবে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনা। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নবীনবাবু ইতিমধ্যেই জ্যোতি বসু বা পবন চামলিংয়ের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন, এবারও জিতে তিনি এমন অলঙ্ঘ রেকর্ড গড়বেন যাকে ঈর্ষা করা ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বীদের কিছুই করার থাকবেনা।
প্রতিযোগিতা লোকসভায়। যে ওড়িয়ারা বিধানসভায় বিজু জনতা দলকে চেলে ভোট দেন তাঁদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ লোকসভায় বিজেপির পক্ষে চলে যান। ভোটারের এই দ্বৈত সত্ত্বা ওড়িশার হালফিলের রাজনীতির একটি চিত্তাকর্ষক দিক।
এবার লোকসভায় জোট করে ভোটে যাওয়ার কথা ছিল বিজেপি আর বিজেডির। আলোচনা বেশ কিছুটা এগোনোর পরে তা নানা কারণে ভেস্তে যায়, শুরু হয় পারস্পরিক দোষারোপের পালা। সম্পর্ক দৃশ্যতই কিছুটা তিক্ত হয়ে ওঠে। এন ডি এ-র শরিক না হলেও বিজেডি বরাবরই বিজেপির বন্ধু দল, লোকসভায় তাদের হাত বাড়ানোই থাকে। গত দশ বছরে মোদী অথবা অমিত শাহ যতবার ওড়িশা সফরে গিয়েছেন নবীনবাবুর বিরুদ্ধে কখনও একটি কথাও বলেননি। জোটের সম্ভাবনা ভেস্তে যাওয়ার পরে ওড়িশায় ভোটের প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বাক্তিগত আক্রমণ করে বসেন নবীনবাবুকে। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রীকেও এই প্রথম ভিডিও করে মোদীকে প্রত্যাঘাত করতে দেখা যায়। এমন অদৃষ্টপূর্ব তাল ঠোকাঠুকির মধ্যেই এবার হয়েছে সে রাজ্যের নির্বাচন।
একুশটি আসনের মধ্যে আটটি ইতিমধ্যেই আছে বিজেপির ঝুলিতে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের মতো এই প্রতিবেশী রাজ্যে উঠছে একই প্রশ্ন। বিজেপির আসন সংখ্যা বাড়লেও কতটা বাড়তে পারে? তার চেয়েও বড় কথা বাংলা আর ওড়িশার বৃদ্ধি কতটা মসৃন করতে পারে বিজেপির দিল্লি জয়ের পথ। এখানে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ রাখা ভাল, যদি বাড়ে।’ বিতর্কে এখানেই প্রবেশ যোগেন পন্ডিতের। কাল শোনার তাঁর পন্ডিতির কিছু ঝলক। (চলবে)
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক,সাবেক নির্বাহী সম্পাদক আনন্দবাজার পত্রিকা
Leave a Reply