মৃদুল আহমেদ
পৃথিবীতে প্রথম দেখা দৃশ্য কোনটি?
সেই দৃশ্যের মাহাত্ম্যই বা কী?
মাতৃগর্ভের কোনো স্মৃতি থাকে না। হামাগুড়ি দেওয়া বয়সেরও কোনো স্মৃতি থাকে না। ছোটবেলার স্মৃতি মনে করলে প্রথম যে-দৃশ্যটি ভেসে ওঠে চোখের সামনে, আদতে সেই দৃশ্য দিয়েই মানবজন্মের শুরু।
সেটিই মহাকাব্যিক জীবনের প্রথম বর্ণাঢ্য পাতা, যার পথ ধরেই একে একে যুক্ত হতে থাকে নতুন সব পাতা, আরো দৃশ্যপট।
পাঠক, চলুন আমরা বেছে নিই সত্তর দশকের মাঝামাঝি জন্ম নেয়া এক শিশুকে।
তার চোখ দিয়েই দেখতে শুরু করি মধ্যবিত্ত জীবনের কিছু পদচিহ্ন।
সেই আশির দশকে, যখন কমবেশি প্রতিটি মধ্যবিত্তই থাকত টিনের চালের ছাদের নিচে, একটু ঝুম বৃষ্টি হলেই যেখানে পানি উঠত সিমেন্ট বাঁধানো উঠোনে, সেই পানি নেমে গেলে উঠোনে জমাট বেঁধে থাকত পাতলা কাদার স্তর, বয়োজ্যেষ্ঠরা হেঁটে গেলেই কাদার ওপর একের পর এক পড়ত তাদের পায়ের ছাপ, ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দেওয়া শিশু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকত সেসব পায়ের ছাপের দিকে।
শিশু তখনো বুঝতে শেখেনি এই পদচিহ্ন একদিন হারিয়ে যাবে, পদচিহ্ন রেখে যাওয়া মানুষগুলোও হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে চিন্তাচেতনার এই ধরন, বদলে যাবে পৃথিবী। সাক্ষী হতে হবে জীবনের নতুন কিছু পদচিহ্নের, যা অকল্পনীয় হলেও অনিবার্য, অপ্রত্যাশিত হলেও অনপনেয়।
গয়নার বাক্সে পাউডারের যত্নে সাজিয়ে রাখা গৃহিণীর রুপার গয়নার রঙও একদিন জ্বলে যায়। পৃথিবীতে কিছুই অনিত্য নয়, কিন্তু নিত্যদিনের পরিবর্তনে একটু একটু করে আমূল বদলে যাওয়া পৃথিবী, সে আরো এক বিস্ময়।
শিশুটির জীবনের প্রথম দৃশ্য, একটি অকস্মাৎ জেগে ওঠা ভোর।
সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছিল, বাইরে নিকষ অন্ধকার অথচ বাড়ির
ভেতরে জ্বলছে প্রতিটি আলো। ভারি একটা হইচই আর উৎসবের পরিবেশ।
বাক্সপেটরার ভেতর কাপড় গোছানো চলছে, ঘরের এদিক-সেদিক পারফিউমের নানা ধরনের গন্ধ। উহু, ভুল বলা হলো। তখন পারফিউমকে পারফিউম বলা হতো না। বলা হতো সেন্ট।
এই তোর সেন্টটা একটু এদিকে দে তো, গায়ে মারি… নিত্য প্রচলিত বাক্যের এও ছিল একটা!
মা একটু আগেই স্নান সেরে এসেছেন এই ভোরেই। তাঁর ফর্সা মুখটা দেখাচ্ছে আরো তকতকে ও ফর্সা।
কাছে এসে বললেন, কী রে, তুই এখনো বিছানায় বসে?
বড় বোনটিকে ডেকে বললেন, যা তো, ওকে একটু বাথরুম করিয়ে নিয়ে আয়!
তখনকার সেসব টিনের চালের বাড়িতে ঘরের ভেতর বাথরুম ছিল না। ঘরের উঠোন পেরিয়ে, মাথা তুলে দাঁড়ানো ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো কিছু ভৌতিক অবয়বের গাছের নিচে ছিল বাথরুম।
তবে বাড়ির সাথে লাগোয়া যে-স্নানঘর, তার এক কোনায় শিশু হিসেবে জলবিয়োগের অধিকার তো ছিলই!
বোনের হাত ধরে উঠোন পেরিয়ে স্নানঘরের দিকে যেতে যেতেই শিশুটি একমুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। গায়ে এসে লাগছে ভোরের অদ্ভুত পবিত্র শিরশিরে বাতাস, চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মহাকাল যেন স্থির হয়ে গেল।
নীলাভ কালচে আকাশে জ্বলজ্বল করছে অজস্র সহস্র তারা, প্রতিটি নক্ষত্রই যেন স্বমহিমায় বিদ্যমান, কত লক্ষ-কোটি বছর আগের অজস্র অলীক সব গল্প তারা বয়ে নিয়ে চলছে অনন্তের উদ্দেশে, সেই রহস্যময় নক্ষত্রবাহিনীর মহাকাশযাত্রার বিস্ময় সেই এক মুহূর্তের মধ্যেই তার মনে ছাপ মেরে গেল!
এরপর একের পর এক ছবি যুক্ত হতে থাকল তার অভিজ্ঞতায়।
কারণ একটু পরেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল একটি ছুটন্ত ট্রেনে।
কেমন ছিল সেই আশির দশকের ট্রেন জার্নি? না, অনলাইন চেকিংয়ের তো প্রশ্নই ছিল না। সেকেন্ড ক্লাসের জন্য আগে থেকে টিকিট কাটা না থাকলে সাথে সাথে পাওয়া বোধহয় একটু মুশকিল ছিল। আর যাওয়া হচ্ছিল ময়মনসিংহ জামালপুরের ভেতরে শেরপুর নামে একটা জায়গায়। সেখানেই তাদের মামাবাড়ি।
যাত্রাটাও অদ্ভুত। কিছুটা ট্রেনে, কিছুটা বাসে, কিছুটা নৌকায়, বাকিটা রিকশাতে। এখন একবারে সেখানে বাসে চলে যাওয়া যায় অথবা ট্রেনে করে স্টেশনে নেমে বাকিটা রিকশায়।
এই ভ্রমণে নিশ্চয়ই ধকল কম, আরামটাই বেশি। কিন্তু ভ্রমণে আনন্দের কথা যদি বলতে হয় সেই উত্থান-পতনের ভ্রমণের মতো আনন্দ কিছুতেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। একটি ভ্রমণে চার রকমের বাহনে চেপে বসতে পারা, এ তো চাট্টিখানি কথা নয়।
এ যেন অনেকটা যাযাবরের সেই কথাটির মতোই, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ। এতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েস।
ট্রেন ভ্রমণের কথা উঠে এলো এই কারণে যে, তখনকার মধ্যবিত্ত জীবনে ট্রেনের একটা বিশাল ভূমিকা ছিল।
প্রতিটি বাঙালির ভেতরের এক কোণে অপু আর দুর্গার বসবাস ছিল।
মাঠের পারে দূরের দেশ পেরিয়ে সেই যে ট্রেন দেখতে যাওয়া, তার সেই যে সেই ট্রেনের পেছনে ছুটতে ছুটতে কাশবনের মাঝখান দিয়ে মাঠের এ-প্রান্ত থেকে ও- প্রান্তে ছুটে যাওয়া – এ দেখার মতো, বিস্ময় উপভোগের মতো মন তখন বাঙালির ছিল।
সময়ের সাথে সেই বিস্ময় স্তিমিত হয়ে এসেছে। বিস্ময়ের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে উষ্মা। সময়মতো ট্রেন সঠিক জায়গায় এসে পৌছাতে না পারার উষ্মা, টিকিট কাটতে গিয়ে চরম দুর্নীতির মুখোমুখি হবার জন্য উষ্মা, গা বাঁচিয়ে পরিচ্ছন্ন একটি ট্রেনের সিটে বসতে না পারার জন্য উষ্মা।
তৃতীয় শ্রেণীতে আগেভাগে এসে জায়গা করে নেয়ার আনন্দও তখন ভ্রমণের একটা অংশ ছিল।
শিশুটির সেদিনের ভ্রমণও তৃতীয় শ্রেণীতেই ছিল। ট্রেনের বাংকারে, সিটে বসে পা রাখার জায়গায়, হাঁটার জায়গায় মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি, কেউ খাচ্ছে, কেউ ঘুমুচ্ছে, কেউ গা চুলকোচ্ছে এর ভেতরে উকি দিয়ে জানালায় অবারিত সীমাহীন ধানক্ষেতের সারি দেখা, ধানক্ষেতে নিভৃতে বীজ বুনে চলেছে নিঃসঙ্গ কৃষক, ছোট বোনটিকে কোলে নিয়ে বিস্ময়াহত চোখে তাকিয়ে আছে অবোধ বালক, ছোট্ট কুটিরের সামনে পুকুরে টলটল পানিতে খেলা করছে হাঁসের দল … এই সমস্ত দৃশ্য দেখার আনন্দই ছিল আলাদা।
সেই তৃতীয় শ্রেণী কি এখন নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি আর কখনো সে-তৃতীয় শ্রেণীতে উঠতে চায় না। হাই কমোডের স্বাচ্ছন্দ্য এবং গিজারের গরম পানির উষ্ণতার সুখে অভ্যস্ত বাঙালির প্রাণ এখন ফার্স্ট ক্লাসেই তার ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। অথবা ভ্রূ কুঞ্চিত করে মেনে নিতে শিখেছে সেকেন্ড ক্লাসকে। ঘাম আর নানা ধরনের গন্ধভরা ঠাসাঠাসি দমবন্ধ তৃতীয় শ্রেণীতে মধ্যবিত্ত বাঙালিকে আর দেখা যায় না।
মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের যে একটি স্বচ্ছন্দ মেলামেশার পরিবেশ ছিল সেই আশির দশকে, সেখানে কোথায় যেন সুর কেটে গেছে!
সেই পারিবারিক ভ্রমণটির মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি বিয়েতে অংশগ্রহণ। গ্রামের মেঠোপথ ধরে রিকশার চাকায় ক্যাঁচ-ক্যাচ আওয়াজ তুলে বিয়েবাড়িতে উপস্থিত হওয়া, পালকিতে চেপে বউয়ের আগমন, দুই কাঁধে দাঁড় ঝুলিয়ে হাঁড়িভর্তি মিষ্টি আর দই নিয়ে ময়রার মিষ্টি চালান এই সমস্ত সুখস্মৃতি নিয়ে ছেলেটি আবার ফিরে এসেছিল শহরে, এই ঢাকায়।
এরপরে সেই অপু আর দুর্গার মতোই সে চাতকের মতো অপেক্ষা করে থাকত আবার কবে ট্রেনে চেপে কুঁ ঝিক ঝিক করতে করতে সেই অপূর্ব রমণীয় গ্রামটিতে উপস্থিত হওয়া যাবে।
অথবা পাড়ার কোনায় ঝিলের পানিতে সন্ধ্যায় যখন আশপাশের সমস্ত বাড়ির ঝলমলে প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠত তখন সেখানে দাঁড়িয়ে ঝিলের শেষ মাথায় তার তৃষ্ণার্ত চোখ তাকিয়ে থাকত সেই মাঠের পারের দূরের দেশের দিকে।
তার মনে হতো, ঝিলের পারে যেখানে আকাশের শেষ সীমানা সেখানেই হয়তো সেই গ্রামটি দাঁড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়।
দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত বাঙালি শিশুর সেই সুখস্বপ্নটিও বদলে গেছে। ট্রেনের সেই অপার মহিমা আর নেই। এখন শিশুরা ইউটিউব আর নেটফ্লিক্সের এমন এক ট্রেনে চেপে বসেছে যেখানে গন্তব্য অন্য কোনো জায়গায়।
কল্পনাকে মেলে দেয়ার বদলে ওরা তাদের কল্পনার নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে শিখে গেছে। ইউটিউব আর নেটফ্লিক্সের প্রসঙ্গে এসে যায় সেই সময়কার টেলিভিশন-দর্শনের কথা।
সপ্তাহে একটি-দুটি দিন ছিল টেলিভিশন-দর্শনের এক মহান সুযোগ, যা ওই শিশুটির কাছে ছিল অপার আনন্দের ও বিস্ময়ের উৎস।
সপ্তাহের বিশেষ কয়েকটি দিন পাড়ার বিশেষ কয়েকটি বাড়ির সামনে জমে উঠত অসংখ্য চটি জুতো। চটি জুতোর সংখ্যা বোধহয় কমই ছিল, সম্ভবত বেশিরভাগই স্পঞ্জের স্যান্ডেল।
ওই অল্প কয়েকটি বাড়িতেই ছিল টেলিভিশন। বিছানার কাঠের পায়ের মতোনই চারটি কাঠের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে সাদামাটা একটি সাদা-কালো বাক্স, যাকে ঘিরে বিস্ময় আর আনন্দের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
শিশু-কিশোররা সামনে জায়গা পেতে বসত মাটিতে, মাননীয়রা তাদের ঠিক পেছনেই চেয়ারে বা সোফায় বসতেন আর কিশোরের দল যাদের বয়স চোদ্দ- পনেরো – সত্যিকার অর্থে একটি হাভাতে বয়স, তাদের সবার পেছনে রামভক্ত হনুমানের মতো নিঃশব্দে জোড়হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো টেলিভিশন দেখার আনন্দের অপার সুযোগের জন্য।
দেখা হতো সপ্তাহের নাটক অথবা বিচিত্রানুষ্ঠান। হয়তো বা মোহাম্মদ আলীর বক্সিংয়ের ফাইনাল রাউন্ড। মাত্র তিরিশ বছর আগের ঘটনা, ভাবা যায়?
পিতামাতার হাতে নানা পদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করে বিভিন্ন পর্যায়ের শর্ত মেনে নিয়ে নানাভাবে সঙ্গী-সাথি জুটিয়ে অন্ধকার পথ ধরে টিভির মালিক বাড়ির কর্তার করুণাপ্রার্থী হয়ে সপ্তাহের একটি-দুটি দিন একটি-দুটি ঘণ্টা রুপোলি জগতের সেই অসম্ভব আলোকিত মূর্ছনার একটি-দুটি বুকের ভেতর সংগ্রহ করে তাই নিয়ে স্মৃতির জাবর কাটতে কাটতে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেয়ার যে করুণ কিন্তু স্বপ্নমুখর আনন্দ, অনেক পাওয়ার অথবা প্রচুর পাওয়ার তুলনা কি তার সঙ্গে হতে পারে?
এখন বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিটি শিশুই একটি না একটি আইপ্যাড বা সেলফোনের অপার স্বাধীনতা উপভোগ করে। লাঞ্ছনা-গঞ্জনার সেইদিন এখন শেষ।
কিন্তু খানিকটা পাওয়া আর অনেকটা না পাওয়ার ভেতরে আরো খানিকটা পাওয়ার জন্য যে-স্বপ্ন আর উত্তেজনা সেটি তার জীবনে এখন আর নেই।
এখন সে অতিভোজনে বেসামাল একটি মানুষ। সকালে রুটি আর ঝোল দিয়ে নাস্তা করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে যে-কোনো একদিন সুস্বাদু বিরিয়ানি খাওয়ার স্বপ্ন দেখে, সে-মানুষটি এখন হারিয়ে গেছে!
হারিয়ে যাওয়া বেদনার সুরে কথা বলতে সবাই পারে কিন্তু প্রাপ্তি স্বীকারের সুর তার কণ্ঠে সাজাতে পারে এমন মানুষ খুব কম। কিন্তু সমস্ত কিছুর পরও এ-কথা স্বীকার করতেই হয়, বিশেষত ঢাকায় বেড়ে উঠেছে যে মধ্যবিত্ত বাঙালি সে তার শৈশবের তেমন কিছুই আর ধরে রাখতে পারেনি।
সে হারিয়েছে তার রিকশায় চড়ে যত্রতত্র চলার স্বাধীনতা, যানবাহনের সংখ্যার ক্রমবর্ধমান স্ফীতি তাকে দিয়েছে ভিআইপি রোডের নির্বাসন।
গণযানবাহনের অপ্রতুলতা এবং যানবাহন সংকট তার সামনে তুলে ধরেছে এক বিশাল জটিল গোলকধাঁধা, যে-ধাঁধার সমাধান প্রতিদিন তাকে খুঁজে বের করতে হয় অফিসে পৌছাতে এবং অফিস থেকে আবার বাড়িতে ফিরে আসতে।
সারারাত ব্যানার লিখে যে বিপ্লবী তুমুল ক্লান্তিতে ঘুমন্তপ্রায়, তার পক্ষে বিপ্লব করা যতটা শক্ত, ঘামঝরানো রোদে একটি ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বাসের পেছনে, ট্যাক্সির পেছনে দৌড়ে নানান কায়দাকানুন করে কাজের জায়গায় পৌঁছানো মানুষটির পক্ষে তার দক্ষতার সূক্ষ্মতা মেলে ধরা আরো শক্ত।
কাজেই বাঙালি মধ্যবিত্ত যতই কর্মযোগী হতে চায়, বাসে ঝুলে ঘামে ভিজে তাকে চর্মরোগী হয়ে উঠতে হয়। কর্মক্লান্তির বদলে ঘর্মশ্রান্তিই তাকে আচ্ছন্ন করে বেশি।
ছোট্ট একটি হাতের মুঠোর মতো শহর মানসিকভাবে হয়ে ওঠে একটি দেশের সমান বড়, যেখানে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গাড়ি করে যেতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবার মতোই এক সুদীর্ঘ আন্তঃজেলা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়।
এমনসব কারণে মধ্যবিত্তের শ্রমকে ঘিরে গড়ে ওঠা সেই প্রতিষ্ঠানের অর্জন এবং সেবার মানও হয়ে দাঁড়ায় সেই পর্যায়ের।
ক্ষুব্ধ, হতক্লান্ত, রিক্ত বাঙালি যখন আর ক্লান্ত শরীর আর ব্যর্থ মনে কাজ দিয়ে পেরে ওঠে না, তখন শুরু করে রাজনীতি ও দলবাজি। প্রতিষ্ঠানে কাজের বদলে তার চেয়ে অর্ধেক শিক্ষা এবং সিকি পরিমাণ কর্মদক্ষতার যে-মানুষটি গলাবাজি ও রাজনীতির সুবাদে নেতা হয়ে বসে আছে, তার ছাতির নিচে দলদাস হয়ে দাঁড়াতে তার আর রুচিতে বাধে না। আশপাশের বড় ভাই, ছোট ভাই, মাইজ্যা ভাই, স্কুলফ্রেন্ড, পাড়ার কাকা সবাইকে একই কাজ করতে দেখে সে বিশ্বাস করতে শুরু করে, এটাই কালচার।
দলছুট কোকিল হয়ে না খেয়ে মরার ভয়ে সে দলের একটি কর্কশকণ্ঠী কাক হয়ে ওঠে।
আর যে একবার কা-কা বলে ডাকতে শুরু করে, ঘরে ফিরে বা বাগানের ধারে বসে কুহু বলা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঘরে, বাইরে, অফিসে, বাসায়, চায়ের আড্ডায়, সভা-সমিতিতে সে কা-কা করেই ডেকে যেতে থাকে। বজ্রকণ্ঠে ব্যক্তিত্বের প্রকাশের বদলে বর্জ্য মুখে নিয়ে জনগণের বিরক্তির উৎপাদন করাই তখন তার ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়ায়।
সেদিনের সেই শিশুটি তার শৈশব পার হয়ে কৈশোর অতঃপর তারুণ্য পার করতে করতে এসবেরই সাক্ষী হতে থাকে।
তারপর তরুণটি একসময় প্রৌঢ়ত্বের দিকে এগোতে শুরু করে। কিছুই তো ভোলেনি সে, সেই তারাভরা রহস্যখচিত আকাশ, রেললাইন ধরে ছুটে চলা বিস্ময়ট্রেন, ঝিলের ওপারে লুকিয়ে থাকা মাঠের পারে দূরের দেশ।
জীবনের পৃষ্ঠাগুলোকে উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করে সে। খুঁজে বের করার চেষ্টা করে কী আছে এই উপাখ্যানে। চোখের সামনে মায়াময় একটি সময় কী করে কর্কশ হয়ে উঠল, দক্ষিণের হাওয়া চলে গেল উত্তর পানে। পুবের মোলায়েম ঘুমভাঙা লালচে আলো মরুভূমির সর্বগ্রাসী নির্বিকার মধ্যগগনের রোদ হয়ে উঠল কোন পথ ধরে?
প্রৌঢ়টি আবিষ্কার করতে শুরু করে, অর্থনীতির উত্থান একটি বড় কারণ। টাকার শক্তি ও ক্ষমতার পেশি প্রদর্শনের সামনে আদর্শের বিশুষ্ক গল্পের পরাজয় অনিবার্য।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যখন একটি দেশ গড়ে উঠছে, তখন বেনিয়া বাহিনী ও সুযোগসন্ধানীদের বুঝতে দেরি হয়নি এই খনি থেকে কতটা হীরে তোলা সম্ভব।
পশ্চিম পাকিস্তানের মতো হিংস্র বাজপাখির লোলুপ নখরের নিচে এই বেনিয়াকুল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, যা পেরেছে যুদ্ধবিধস্ত, ক্লান্ত, শোকাহত একটি আস্ত দেশকে হাতের মধ্যে পেয়ে।
জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড দেশকে যতটা অভিভাবকহীন করেছে, ততটাই লুটেরাদের রঙ্গমঞ্চ করে তুলতে সহায়তা জুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে আর কেউ ছিল না যে দেশকে ভালোবেসে সেই ভালোবাসার প্রয়োগ ব্যক্তিত্বের সাথে ঘটিয়ে দেশের জন্য সত্যিকার অর্থে যথাযথ কিছু করতে পারে, যা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশকে ক্রমশই ওপরে নিয়ে যেতে পারে, নিচের দিকে নয়।
দেশকে অনেকেই ভালোবেসেছেন, কিন্তু দেশের অভিভাবক হবার মতো যোগ্যতা, দৃঢ়তা, নেতৃত্বশক্তির অধিকারী আর কাউকে পায়নি বাংলাদেশ, যা এই দেশের একান্তই দুর্ভাগ্য।
পঁচাত্তর-পরবর্তী লম্বা একটি সময় বাংলাদেশ কসাইয়ের ছুরির নিচে সিনার এক টুকরো রসালো মাংস হয়েই বেঁচে ছিল দীর্ঘকাল।
এই সময়ে লুটেরা শ্রেণী নানাবিধ ব্যবসা ফেঁদে বসে মুনাফার সাম্রাজ্যবিস্তার করে মূর্খ, গলাবাজ, দলবাজ মাস্তানদের দলে টেনে নেয়। এরাই হয়ে ওঠে উন্নতির সূচকচিহ্নিত নায়ক, সমাজের আইকন।
প্রৌঢ়ের মনে পড়ে যায় তাদের কৈশোরে একটি মানুষ পরিচিত ছিলেন ঘুষখোর হিসেবে। সরকারি চাকরি করতেন, বেশ উপরি কামাই ছিল এবং এটি ছিল পাড়ার ভেতরে ওপেন সিক্রেট।
মানুষটি রাস্তা দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁটতেন, তাঁকে নিয়ে মানুষের ফিসফাস, চোরা চাউনি অনুভব করতেন, লাজুক ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি পাড়ার রাস্তা পেরিয়ে যেতেন।
পাড়ায় যখন দশ-বারোটি টিভি বিভিন্ন বাড়ির অন্দরমহল আলোকিত করছে, তখন তার সাদাসিধে বাড়িটিতেও একদিন একটি টিভি এলো।
সবার প্রশ্নহীন মুখের সপ্রশ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি নিচু গলায় অধোবদনে বললেন, শ্বশুরবাড়ির উপহার, মানা করতে পারলাম না!
সবার চোখে চোখে কথা হয়ে গেল, সবাই মাথা নেড়ে বললেন, অ আচ্ছা!
তাতে ভদ্রলোক আরো অধোবদন হয়ে গেলেন।
কিন্তু এই চিত্রটিই বছর বিশের মধ্যে পুরোদস্তুর উল্টে গেল।
যিনি উপরি কামাই করেন, তিনি সগর্বে ঘোষণা দিতে শুরু করলেন। তার স্ত্রী- সন্তানরা দামি গাড়িতে-বাড়িতে রণক্ষেত্রের সমরসজ্জার মতোই যখন দামামা বাজিয়ে চলতে শুরু করল, তখন যিনি সৎভাবে কাজের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, তাঁর স্ত্রী মাথা কুটে বললেন, তোমার মতো অপদার্থকে বিয়ে করে কী পেলাম জীবনে?
এবার সৎমানুষটি লজ্জায় অধোবদন হয়ে গেলেন।
এখন তিনি রাস্তা দিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে হাঁটেন, আর সবাই ফিসফাস করে কনুই দিয়ে একজন আরেকজনকে গুঁতো মেরে বলে, ওই দ্যাখ, ওই যে হেঁটে যাচ্ছে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম গাধা, যে কি না ফন্দিফিকির কিছুই জানে না। কতজন কত কিছু করে ফেলল, আর এই ব্যাটা খালি সততার শুকনো গল্প দিয়ে চিড়ে ভেজাতে চায়!
এই সমস্ত দৃশ্য কিন্তু নীরবে অবলোকন করেনি মধ্যবিত্ত বাঙালি, বেঁচে থাকার তাগিদে তাকে এসবে অংশ নিতে হয়েছে। মুনাফাখোরের বখরার ছাতার নিচে তাকে আশ্রয় নিতেই হয়েছে, মেনে নিতে হয়েছে তার আদর্শের পরাজয়।
এই পরাজয় মেনেও মানতে পারেনি সে। সারাদিন কাকের দলে নাম লিখিয়ে কা-কা করেও দিনশেষে সে গানের আসরে বসে কুহুতানে গেয়ে উঠে বলতে চেয়েছে, দেখো, আমি এখনো শেষ হয়ে যাইনি!
কিন্তু তার গলায় সেই কুহুতান ফোটেনি, আহত বিস্ময়ে সে আবিষ্কার করেছে, তার গান আর জমছে না, কাকের কর্কশতা আর কোকিলের কুহুতানের ভেতরে কোথায় যেন জীবনের সুর কেটে গেছে!
প্রৌঢ়টি তার মানসিক আশ্রয় খুঁজতে আজো খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। সে অকাতরে চোখ খুলে তাকিয়ে খুঁজছে তার সেই শৈশবের আকাশকে। সব হারাতে পারে, আকাশের নক্ষত্ররাজি তো হারাতে পারে না। ছায়াপথ তো লক্ষ-কোটি বছর ধরে তার রহস্যে আঁকা মানচিত্র মেলে দিয়ে রাখবেই।
কিন্তু প্রৌঢ়টি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে, আকাশে তেমন কোনো নক্ষত্র উপস্থিত নেই। তার আশ্রয়খোঁজা সরল দাবিতে কেউ সাড়া দেয়নি।
যে সভ্য শহরে প্রৌঢ়টি বসবাস করে, সেখানকার আলোকসজ্জা কোনো নক্ষত্রকে দৃশ্যমান হতে দেয় না।
সভ্য শহরে বেঁচে থাকতে হলে এ-সত্যকেই মেনে নিতে হয়।
লেখক পরিচিতি: মৃদুল আহমেদ
শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য তিন পর্যায় কেটেছে ঢাকায়। এখন বাস দেশের বাইরে। প্রথম লেখা গল্প বেরোয় ১৯৯২-এ। পরবর্তীকালে গল্প-কবিতা-ছড়া ছাপা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায়। টিভি চ্যানেলে নিয়মিত উপস্থাপক ছিলেন। প্রবাসজীবনে কাজের ফাঁকে নতুন করে লিখছেন এখন।
Leave a Reply