শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:২৭ পূর্বাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( চতুর্থ কিস্তি )

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১২ মার্চ, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো।   ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’ বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না। 

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

 

দিবারাত্রির কাব্যে’ ভূমিকায় মানিক  বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

 

মানিক  বন্দোপাধ্যায়

 

 

সুপ্রিয়া বলল, ‘নাই বা করতেন কথাটা জিজ্ঞাসা?’

 

কিন্তু এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য তার সফল হল না। অনায়াসে প্রসঙ্গান্তর এনে হেরম্ব তার কথাটা চাপা দিয়ে দিল। অশোককে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘খুনী ধরতে গিয়েছিলে শুনলাম? কোথায় খুন হল?’

 

‘বরকাপাীতে।’ অশোক সংক্ষেপে জবাব দিল।

 

‘ধরলে?’

 

‘ধরেছি। বড় ভুগিয়েছে ব্যাটা। এ গাঁ থেকে সে গাঁ হয়রান করে মেরেছে! শেষে একটা ঝোপের মধ্যে কোণঠাসা করে ধরতে ধরা দিলে।’ অশোক একটু উৎসাহিত হয়ে উঠল। নিজের ব্যবসার কথা বলতে পেলে সকলেই খুশী হয়। ‘দা নিয়ে খুন করতে উঠেছিল। জমাদার জাপটে না ধরলে আজ একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড হয়ে যেত। ব্যাটা কি জোয়ান।’

 

সুপ্রিয়ার চোখের দিকে একবার স্পষ্টভাবে তাকিয়ে হেরম্ব বলল, ‘কাকে খুন করেছে?’

 

‘বৌকে। চিরকাল যা হয়ে থাকে’-অসময়ে স্বামী বাড়ি ফিরল, লাভার গেল পালিয়ে, বৌ হল খুন। গলাটা একেবারে দু’ফাঁক করেও ব্যাটার তৃপ্তি হয়নি। সমস্ত শরীর দা দিয়ে কুপিয়েছে!’

 

সুপ্রিয়া শিউরে উঠে বলল, ‘মাগো।’

 

খুনীটা তার স্বামীকে দা নিয়ে কাটতে উঠেছিল শুনে সুপ্রিয়া শব্দ করেনি স্মরণ করে হেরম্ব একটু ক্ষুব্ধ হল।

 

‘ফাসি হবে?’

 

অশোক বলল, ‘না! যথেষ্ট প্রোভোকশন ছিল।’

 

সুপ্রিয়া অস্থির হয়ে বলল, ‘কি আলোচনা আরম্ভ করলে? ওসব কথা

 

থাক বাপু, ভাল লাগে না। খুন, জখম, ফাঁসি-বলার কি আর কথা নেই?’ হেরম্ব হেসে বলল, ‘তুই দারোগার বৌ, খুন জখম ভাল না লাগলে তোর চলবে কেন সুপ্রিয়া?’

 

‘দারোগার বৌ হয়ে কি অপরাধ করেছি? আমি তো দারোগা নই।’

 

‘কি জানি কি অপরাধ করেছিস। আমি বলতে পারব না। অশোককে জিজ্ঞাসা কর। খুন জখম ভাল না লাগলে পাছে অশোককেও তোর ভাল না লাগে এই ভেবে বলছিলাম সংসারের রাহাজানির ব্যাপারগুলোকে ভালবাসতে শেখ। তুই দাড়িয়ে রইলি কেন বলতো, সুপ্রিয়া? অশোকের সামনে তুই দাঁড়িয়ে থাকিস নাকি? এতো ভাল কথা নয়। হেঁটে এসে তোর নিশ্চয় পা ব্যথা করছে। দাও হে অশোক, ওকে বসবার অনুমতি দাও। ভাল করে বসে একটা গল্প শোন, সুপ্রিয়া।’

 

‘শুনব না গল্প।’

 

‘আহা শোন না। অশোক ওকে শুনতে বল তো।’

 

‘শুনব না, শুনব না, শুনব না। হল? গল্প শুনবে-আমি কচি খুকী নই।’

 

হেরঙ্গ একটা চুরুট বার করে বলল, ‘তবে দেশলাই দে। চুরুট খাই।’ অশোক অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। সে যেন ঘুম ভেঙে উঠে বলল, ‘একি কাও! আপনারা যে রীতিমতো ঝগড়া করছেন।’

 

হেরম্ব হেসে বলল, ‘না। সুপ্রিয়াকে একটু রাগাচ্ছিলাম, ছেলেবেলা গল্প

 

বলুন, গল্প বলুন বলে এত বিরক্ত করত-কোথা যাচ্ছিস সুপ্রিয়া?’ ‘রান্নার ব্যবস্থা একটু দেখি?’ বলে সুপ্রিয়া চলে গেল।

 

হেরম্ব বলল, ‘চটেছে।’

 

অশোক বলল, ‘ঠাট্টা তামাশা একেবারে সইতে পারে না।’ একটু ইতস্তত করে যোগ দিল, ‘সেন্স অফ হিউমার বড় কম।’

 

হেরম্ব বলল, ‘তাই নাকি!’

 

‘ওকে আমি এত ভয় করি শুনলে আপনি হাসবেন।’

 

‘ওকে কে ভয় করে না, অশোক? এমন একগুঁয়ে জেদী মেয়ে সংসারে

 

নেই। একবার যা ধরবে শেষ না দেখে ছাড়বে না। ওকে বোধহয় মেরে ফেলা যায় কিন্তু জেদ ছাড়ানো যায় না।’

 

‘ঠিক। অবিকল মিলে যাচ্ছে।’

 

হেরম্ব শঙ্কিত হয়ে বলল, ‘মিলে যাচ্ছে কি রকম?’

 

‘আপনি জানেন না? বিয়ের পর একবছর ধরে চেষ্টা করেও ওকে কিছুতে এখানে আনতে পারিনি। শেষবার আনতে গেলে ওর কাকা বুঝি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, না যাস্ তো আমার বাড়িতে থাকতে পাবিনে। আমারও একটু অন্যায় হয়েছিল-রাগারাগি আরম্ভ করে দিয়েছিলাম। যাই হোক, আমার সঙ্গে সেই যে এল তারপর পাঁচ বছরের মধ্যে একদিনও ওর কাকা ওকে নিয়ে যেতে পারেনি। বলে, ‘যাব না বলে এসেছি, যাব কেন?’

 

‘প্রথমে এখানে আসতে চায়নি জানতাম। আমিও অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু আসবার সময় ফিরে যাবে না বলে এসেছিল এখবর তো পাইনি।’

 

‘ছেলেমানুষ রাগের মাথায় কি বলেছে না বলেছে কে খেয়াল করে রেখেছিল ও যে ফিরে যাবে না প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল, ও ছাড়া আর কারুর হয়তো সেকথা এখন মনেও নেই। ওর কাকা এথনো দুঃখ করে আমাকে চিঠি লেখেন। চিঠি পড়ে কাঁদে, কিন্তু একদিনের জন্য যেতে রাজী হয় না।’

 

হেরম্ব একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার ধারণা ছিল, তুমিই ওকে পাঠাও না।’

 

অশোক বিমর্ষভাবে হাসল। বলল, ‘কাকার চিঠির যে সব জবাব আমাকে দিয়ে লিখিয়েছে, তাতে আপনি কেন, সকলেরই ওরকম ধারণা হবে। কথাটা প্রকাশ করবেন না, দাদা। ওদিকে কাকা মনে ব্যথা পাবেন, এদিকে আপনাকে বলার জন্ত আমাকে টিকতে দেবে না। রাগের মাথায় মত বদলে, ‘কাকার কাছে চললাম, তোমার কাছে আর আসব না বলে বিদায় নিলে তো বিপদেই পড়ে যাব।’

 

অশোকের কাছে লুকিয়ে হেরম্ব গভীরভাবে চিন্তা করছিল। চারিদিক বিবেচনা করে ক্রমে ক্রমে তার ধারণা হচ্ছে, এতদিন পরে স্বপ্রিয়ার সংস্পর্শে না এলেই সে ভাল করত।

 

সুপ্রিয়ার কোন শিক্ষাটা বাকি আছে যে ওকে আজ নতুন কিছু শেখানো সম্ভব? জীবনে স্তরে স্তরে সুপ্রিয়া নিজেকে সঞ্চয় করেছে, কারো অনুমতির অপেক্ষা রাখেনি, কারো পরামর্শ নেয়নি। ওর সঙ্গে আজ পেরে উঠবে কে? খানিক পরে সুপ্রিয়া ফিরে এল। তার এক হাতে ব্রান্ডির বোতল অন্য হাতে কাচের গ্লাস।

 

‘তোমার ওষুধ থাবার সময় হয়েছে। সকালে খাওনি, বড় ডোজ দি, কেমন?’

 

অশোক কথা বলতে পারে না। একবার হেরম্বের মুখের দিকে তাকায়। একবার মদের বোতলটার দিকে, ভাবে কিসব কাণ্ড সুপ্রিয়ার।

 

হেরম্ব একটু হাসে। তার একেবারেই বিস্ময় নেই। সুপ্রিয়া যে নারী তার এই প্রমাণটা সে না দিলেই আশ্চর্য হত। এটুকু বিদ্রোহ না করলে ওতো

 

মরে গেছে!

 

‘আমায় একটু দিস তো সুপ্রিয়া।’

 

‘আপনি খাবেন? মদ কিন্তু, খেলে নেশা হয়। মদে শেষে আপনার আসক্তি জন্মে যাবে না তো?’

 

হেরম্ব তবু হাসে।

 

‘আসক্তি জন্মালে কি হবে? আমার জন্য মদ যোগাড় করে রাখবে কে সুপ্রিয়া? আমার তো বৌ নেই।’

 

এক মিনিটের জন্য হেরম্বকে সুপ্রিয়া ঘৃণা করল বই কি! রাগে তার মুখ লাল হয়ে গেছে।

 

‘না, আপনার বৌ নেই। আপনার বৌ গলায় দড়ি দিয়েছে।’

 

একথা হেরম্বর জানা ছিল যে, এরকম অসংযম সুপ্রিয়ার জীবনে আরও একবার যদি এসে থাকে তবে এই নিয়ে ছ’বার হল। এই সংখ্যাটি সুপ্রিয়ার বাকি জীবনে কখনো দুই থেকে তিনে পৌঁছবে কিনা সে বিষয়ে বাজি রাখতে হেরম্ব রাজী হবে না। তবু সুপ্রিয়াকে মারতে পারলে হেরম্ব খুশী হত।

 

অশোক অস্তিত হয়ে বলল, ‘এসব তুমি কি বলছ?’

 

কিন্তু সুপ্রিয়ার মুখে আর কথা নেই। কাচের গ্লাসে অশোককে নীরবে খানিকটা মদ ঢেলে দিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

 

রাত্রে তারা যখন খেতে বসেছে, খুনীকে সঙ্গে করে সিপাহীরা ফিরে এল। হেরম্ব বহুক্ষণ আত্মসংবরণ করেছে। সুপ্রিয়ার মুখ স্নান। আকাশ ঢেকে মেম্ব করে এসেছে। পৃথিবী বায়ুহীন। হেরম্ব বলল, ‘খুনীটার সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারি না, অশোক? কৌতূহল হচ্ছে।’

 

অশোক বলল, ‘বেশ তো।’

 

সুপ্রিয়া চেষ্টা করে বলল, ‘খুনীর সঙ্গে আলাপ করতে চান করবেন, সেজক্স তাড়াতাড়ি করবার কি। খুনী পালাবে না।’

 

হেরদ হেসে বলল, ‘না, খুনী পালাবে না। কোমরে দড়ি বাঁধা হয়েছে, না অশোক ?’

 

‘নিশ্চয়।’

 

সুপ্রিয়া অবাক্ হয়। হেরম্বের কথার মানে বুঝতে চেষ্টা করে হঠাৎ তার মনে হয়, হেরম্ব নার্ভাস হয়ে পড়েছে, চাল দিচ্ছে, ওর কথার কোন মানে নেই।

 

খেয়ে উঠে তারা বাইরের বারান্দায় গেল। একটা কালিপড়া লণ্ঠন জ্বলছে। থামে ঠেস দিয়ে ধূলিধূসরিত দেহে খুনী বসে আছে। যুদ্ধ না করে সে যে পুলিসের কাছে হার মানেনি সর্বাঙ্গে তার অনেকগুলি চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। কোমরে বাঁধা দড়িটা ধরে একজন কনস্টেবল উবু হয়ে বসে ছিল, হেরম্ব ও অশোকের আবির্ভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।

 

হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর নাম কিরে ?’

 

‘বিরসা।’ ছ’দিন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে বুনো জন্তুর মতো। কিন্তু বুনো জন্তু সে নয়, মানুষ। প্রশ্নের জবাব দিয়ে বিরসা আবার ঝিমিয়ে পড়ল।

 

কনস্টেবল বলল, ‘আত্মান করনে মাংতা, হুজুর।’

 

অশোক বলল, ‘এক বালতি পানি, ব্যস্।’

 

হেরম্বের চিন্তার ধারা অন্যরকম।

 

‘এমন কাজ করলি কেন বিরসা? বৌকে তাড়িয়ে দিলেই পারতিস।’ বিরসা কিছুই বলল না। বৌ-এর নামোল্লেখে লাল টকটকে চোখ মেলে হেরম্বের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ঝিমোতে শুরু করল। অশোক শান্তভাবে বলল, ‘ওকে ওসব বলে লাভ কি হেরম্ববাবু?’

 

‘লাভ? লাভ কিছু নেই।’ হেরম্ব একটু ভীরু হাসি হাসল, ‘আমি শুধু

জানতে চাইছিলাম ফেখলেস ওয়াইফকে খুন করে মানুষের অনুতাপ হয় কিনা।’

 

অশোক আরও শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি জানলেন ?’

 

‘জানলাম? অনেক কিছু জানলাম, অশোক। আমার বারবার সন্দেহ ছিল যে ঈর্ষার বশে যদি কোন স্বামী স্ত্রীকে খুন করে ফেলতে পারে, তাতে আর যাই হোক, স্বামীটির চরম ভালবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়, এই থিয়োরি হয়তো সত্য নয়। আজ বুঝলাম আমার সন্দেহ সত্যি! ওর তাকাবার রকম দেখলে, অশোক? স্ত্রীকে খুন করে তার দাম দেবার ভয়ে ও একেবারে মরে গেছে! এটা ভালবাসার লক্ষণ নয়। ও শুধু খুনী, স্রেফ খুনী, প্রেমিক ওকে বলব না। না, স্ত্রীকে ও ভালবাসত না। স্ত্রী আর একজনকে ভালবাসে বলে যে তাকে খুন করে অথবা কষ্ট দেয়, অবহেলা করে, স্ত্রীকে সে ভালবাসে না। তুমি বুঝতে পার না অশোক, ভালবাসার বাড়া-কমা নেই? ভালবাসা ধৈর্য আর তিতিক্ষা? একটা একটানা উগ্র অনুভূতি হল ভালবাসা, তুমি তাকে তাড়াতে পার না কমাতে পার না? স্ত্রীকে খুন করে ফেলতে চাও কর, কিন্তু তারপর একদিনের জন্য যদি তোমার ভালবাসায় ভাঁটা পড়ে, মনে হয় খুন না করলেই হত ভাল, সেইদিন জানবে, ভালবেসে স্ত্রীকে তুমি খুন করনি, করেছিলে অন্য কারণে। স্ত্রীকে যে ভালবাসে সে অপেক্ষা করে। ভাবে, এখন ও ছেলেমানুষ, আর একজনের স্বপ্ন দেখছে। দেখুক, যৌবনে ওর প্রেম পাব। ভাবে, যৌবন ওকে অন্ধ করে রেখেছে, ও তাই অতীতের অন্ধকারটাই দেখছে। দেখুক, যৌবন চলে গেলে আমি ওকে ভালবাসব। আচ্ছা অশোক, তোমার কি কখনো মনে হয় না যে প্রিয়া আর একজনকে ভালবাসছে এই অবস্থাটাকে মৃত্যু দিয়ে অপরিবর্তনীয় করে দেওয়া বোকামি? কষ্ট দিয়ে আর একজনের প্রতি এই ভালবাসাকে, মোহকে প্রবল আর স্থায়ী করে দেওয়া মূর্খামি? একি স্ত্রীকে ভাল না বাসার প্রমাণ নয়? এর চেয়ে স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রেখে, তাকে সুখী করে-‘

 

সুপ্রিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিল। হেরম্বের বক্তৃতার ঠিক এইখানে তার ফিট হল। গোলমাল শুনে দু’জনে গিয়ে দেখে, সুপ্রিয়া বুকের নিচে ছটি হাত জড়ো করে উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।

 

অশোক চেঁচিয়ে বলল, ‘ওকে শুনিয়ে এসব কথা কি আমায় না বললেই হত না? রাস্কেল!’

 

রাতদুপুরে সুপ্রিয়া হেরম্বের ঘরে এল।

 

‘জেগে আছেন?’

 

‘জেগেই আছি সুপ্রিয়া।’

 

‘বিছানায় উঠব না! শরীরটা এত দুর্বল লাগছে, দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে।’

শুয়ে থাকলি না কেন, স্বপ্রিয়া? কেন উঠে এলি?’

 

 

‘সকালে চলে যাবেন, কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই। দাড়াতে কষ্ট হচ্ছে, হেরম্ববাবু।’

 

হেরম্ব চুপ করে থাকে।

 

‘মাথা ঘুরে হয়তো আবার আমি ফিট হয়ে পড়ে যাব। সবাই উঠে আসবে। বলুন কিছু, বলুন যাহোক কিছু।’

 

‘তুই তো চিরদিন লক্ষ্মী মেয়ে ছিলি স্বপ্রিয়া। এত অবাধ্য এত দুরন্ত কবে থেকে হলি?’

 

সুপ্রিয়াকে অন্ধকারেও দেখা যায়। কারণ, অন্ধকারে সে গাঢ়তর অন্ধকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 

‘আমার সত্যি দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে।’

 

হেরম্ব এবারও চুপ করে থাকে।

 

‘আপনি আমাকে ডাকলেই পারেন। আপনি বললেই বিছানায় উঠে বসতে পারি।’

 

হেরম্ব তবু চুপ করে থাকে। কথা বলবার আগে সুপ্রিয়া এবার অপেক্ষা করে অনেকক্ষণ।

 

‘আজ টের পেলাম, বৌ কেন গলায় দড়ি দিয়েছিল। আপনি মেয়েমানুষের সর্বনাশ করেন কিন্তু তাদের ভার ঘাড়ে নেবার সময় হলেই যান এড়িয়ে। কাল আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে বলে বিছানায় উঠে বসতে দিচ্ছেন না। আমি দাঁড়াতে পারছি না, তবু!’

 

হেরম্ব বলে, ‘শোন সুপ্রিয়া। আজ তোর শরীর ভাল নেই, তাছাড়া নানা কারণে উত্তেজিত হয়ে আছিস। ধরতে গেলে আজ তুই রোগী, অসুস্থ মানুষ। আজ তুই যা চাইবি তাই কি তোকে দেওয়া যায়? তবে আর জ্বরের সময় রোগীকে কুপথ্য দিলে দোষ কি ছিল? বেশী ঝাল হয়েছিল বলে অশোককে তুই আজ মাছের ঝোল খেতে দিসনি মনে আছে? তুই আজ ঘুমিয়ে থাকবি যা সুপ্রিয়া। ছ’মাসের মধ্যে তোর সঙ্গে আমার দেখা হবে। ‘তখন দু’জনে মিলে পরামর্শ করে যা হয় করব।’

 

‘আরও ছ’মাস!’

 

‘ছ’ মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে।’

 

‘যদি দেখা না হয়? আমি যদি মরে যাই?’

 

জীবনের দিগন্তে তাকে অস্তমিত রেখে স্বপ্রিয়া মরতেও রাজী নয়? হেরম্বের দ্বিধা হয়, সংশয় হয়। জীবনকে কোনমতে পরিপূর্ণ করবার উপায় নেই। তবু সুপ্রিয়াকে জীবনের সঙ্গে গেঁথে ফেললে হয়তো চিরদিনের জন্য জীবন এত বেশী অপূর্ণ থাকবে যে, একদিন আপসোস করতে হবে হেরম্বের এই আশঙ্কা কমে আসে। তার মনে হয়, আজ একদিনে সুপ্রিয়া ক্ষণে ক্ষণে

 

নিজের যে নব নব পরিচয় দিয়েছে হয়তো তা বহু সংযম সাবধানতা ও কার্পণ্যের বাধা ঠেলেই বাইরে এসেছে। হয়তো পাঁচবছর ধরে সুপ্রিয়া যে ঐশ্বর্য সংগ্রহ করেছে তা অতুলনীয়, কল্পনাতীত। কিন্তু তবু হেরম্ব সাহস পায়নি। নিজেকে দান করবার চেয়ে কঠিন কাজ জগতে কি আছে? অত বড় দাতা হবার সাহস হেরম্ব সহসা সংগ্রহ করে উঠতে পারে না।

 

বলে, ‘মরবি কেন, সুপ্রিয়া? লক্ষ্মী মেয়ের মতো তুই বেঁচে থাকবি।’

 

সুপ্রিয়া চলে গেলে হেরম্ব শয্যা ত্যাগ করে। দরজা খুলে বাইরে যায়! থানার পাহারাদার বলে-‘কিধার জাতা বাবু?’

 

‘ঘুমনে জাতা। নিদ হোতা নেহি।’

 

আকাশ মেঘে ঢাকা। ওদিকে বিদ্যুৎ চমকায়। শুকনো ঘাসে-ঢাকা মাঠে হেরম্ব আস্তে আস্তে পায়চারি করে। আজ রাত্রে যদি বৃষ্টি হয় কাল হয়তো মাঠের বিবর্ণ বিশীর্ণ তৃণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024