শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১০:২৯ পূর্বাহ্ন

ইতালির রূপকথা (বুড়ো চেক্কো)

  • Update Time : শুক্রবার, ৩১ মে, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মাক্সিম গোর্কি

পূত-স্তব্ধ সূর্য ওঠে, পাথর-ভরা দ্বীপটা থেকে সোনালী ফার্জের সুগন্ধে ভারাক্রান্ত একটা নীলাত কুয়াশা। উঠে ভেসে যায় আকাশের দিকে।

ঘুমন্ত কালো জল চারিদিকে, ওপরে আকাশের বিষর্ণ গম্বুজ- দ্বীপটাকে মনে হয় যেন সূর্যদেবের বেদী।

সবে মিলিয়ে গেছে তারা, তুলোর মতো সুকুমার স্বচ্ছ এক মেঘরেখার ওপরে নিষ্প্রভ আকাশের তুহিন বিপুলতার মধ্যে নিঃসঙ্গ শাদা শুকতারা তখনো জ্বলছে। আবছা গোলাপী রঙ লেগেছে মেঘে, প্রথম কিরণের কোমল আভায় ওরা দীপ্ত। সমুদ্রের শান্ত বুকের ওপর তার যে ছায়া পড়েছে, তা দেখে মনে হয় যেন অতল নীল থেকে ভেসে উঠেছে শুক্তি।

রুপোলী শিশির ছোঁয়া ঘাসের শীষ আর ফুলের পাপড়িগুলো টান টান হয়ে আছে সূর্যের দিকে। মদির মুনের মধ্যে যাবে নেরে উঠেছে মাটি, ঘাস পাতার ডগায় এসে জমা ঝাকমকে শিশির বিন্দুগুলো বড়ো হতে হতে সেই মাটির ওপর ঝরে ঝরে পড়ছে। ননে হয় যেন এই ঝরে পড়ার কোমল একটা নিরুণ এই বুঝি শোনা যাবে। আর তা যখন শোনা যায় না, তখন কষ্ট হয়।

পাখিরা জেগে উঠে জলপাই গাছের পাতার ফাঁকে লাফালাফি করে, গায় ভোর বেলার গান, আর ঘুম-ভাঙা সমুদ্রের ভারি ভারি নিঃশ্বাস। নিচে থেকে আসে রোদ্দুরে তবু, সব কিছুই স্তব্ধ, কেননা লোকজন এখনো জাগেনি। ভোরের তাজা হাওয়ায় যাস আর ফুলের গন্ধ শব্দের চেয়েও জোরালো।

শাদা ছোট বাড়িখান। আঙুরলতার এমন ছাওয়া যেন মনে হয় সবুজ চেউয়ের কোলে একটি নৌকো। সে বাড়ির দরজা থেকে বুড়ো এত্তোরে চেকো বেরিয়ে আসে সূর্য দেখবার জন্যে। নিঃসঙ্গ ছোটোখাটো চেহারার এক বুড়ো যে, হনুমানের মতো লম্বা লম্বা হাত, মহাত্মাদের মতো নগ্ন টাক পড়া মাথা, বয়সের ছাপে মুখখানা এমন তোবড়ানো, যে চোখ দুখানা তার কোঁচকানো চামড়ার তলে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে।

কালো মতো রোমশ হাতখানা ধীরে ধীরে কপালের কাছে তুলে বুড়ো তাকায় গোলাপী আকাশের দিকে, তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তার চারিপাশের দৃশ্য: শ্যাম সোনালীর সমারোহ, ধূসর-বেগুনি পাথরের পৃষ্ঠপটে লাল গোলাপী আর হলুদরঙা ফুল। গাঢ় রঙের মুখখানা তার কেঁপে ওঠে এক কোমল হাসিতে, ভারাক্রান্ত গোল মাথাখানা সে দোলায় যেন তারিফ করে।

দাঁড়ায় এমন ভাবে যেন ভারি একটা বোঝা বইতে হচ্ছে ওকে – পিঠটা বেঁকে থাকে একটু, পা দুটো অনেকখানি ফাঁক করে দাঁড়ানো, আর তখন তার চারপাশে ফোটে অরুণ দিনের সানন্দ লীলা, আঙুরগাছের সবুজ জ্বলে প্রখরতর দীপ্তিতে, আরো জোরে বেজে ওঠে হলুদমণি পাখির কাকলী; কালজাম, আর স্পার্জ ঝাড়ের মধ্যে ঝটপট করে ওঠে ভারুই পাখি, আর ফুলবাবুর মতো কোথায় এক বুলবুলি ওঠে শীস দিয়ে, নেপুলের লোকগুলোর মতোই পাখিটার চিন্তাভাবনার বালাই নেই।

মাখার ওপর অবসন্ন লম্বা হাত দুটো উঁচু করে এমন ভাবে আড়িমুড়ি ভাঙে যেন এক্ষুণি সে উড়ে নেমে আসবে সমুদ্রের ওপর- পাত্রে রাখা মদের মতোই সে সমুদ্র শান্ত।

বুড়ো হাড়গুলোর জড়তা ভেঙে দরজার পাশে এক পাথরের ওপর বসে চেক্কো, জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা পোস্ট কার্ড যার করে আনে, তারপর দূরে ধরে চোখ কুঁচকে বহুক্ষণ চেয়ে থাকে পোস্ট কার্ডটার দিকে, ঠোঁট দুটো নড়তে থাকে নিঃশব্দে। খোঁচা খোঁচা রুপোলী দাড়ি-ভরা ওর মস্ত মুখখানা নতুন করে হাসিতে ঝলমলিয়ে ওঠে-সে হাসিতে ভালোবাসা আর কষ্ট আর গর্ব মিশেছে বিচিত্রভাবে।

সামনে ওর এক টুকরো পেস্ট বোর্ডের ওপর নীল রঙে চওড়া কাঁধ দুটো ছোঁড়ার ছবি আঁকা- দুই তরুণ জোয়ান, পাশাপাশি বসে খুশিতে হাসছে, বুড়ো চেক্কোর মতোই মাথা দুটো তাদের বড়ো বড়ো, কোঁকড়া চুল। কার্ডখানার ওপরে পরিষ্কার বড় বড় হরফে ছাপা আছেঃ

‘আরতুরো এবং এরিকো চেক্কো, শ্রেণী স্বার্থের দুই বীর যোদ্ধা। হপ্তায় ছ ডলার মজুরির প্রতিবাদে ২৫০০০ সূতাকল শ্রমিকদের সংগঠিত করার অপরাধে তাদের কারাদণ্ড হয়েছে।

‘সামাজিক ন্যায় ব্যবস্থার যোদ্ধারা দীর্ঘজীবী হোক!’

বুড়ো চেঙো পড়তে জানে না, তাছাড়া কথাগুলো আবার লেখা আছে এক বিদেশী ভাষায়; কিন্তু সে জানে এই কথাই লেখা আছে আছে, এর প্রত্যেকটি শব্দই তার জন্য, প্রত্যেকটা শব্দই তার কাছে রামশিঙার স্বরগ্রামের মতো শব্দিত।

জোন পোস্ট কার্ডখানা পেয়ে বুড়োর দুশ্চিন্তা আর কষ্টের শেষ ছিল না। দু’মাস আগে চিঠিট। এসেছিল; বাপের মন তখুনি টের পেয়েছিল কিছু একটা গোলমাল হয়েছে; আইন না ভাঙলে তো আর গরিব মানুষের ছবি ছাপা হয় না।

কাগজখানা সে লুকিয়ে রেখেছিল পকেটের মধ্যে কিন্তু বোঝার নতো সেটা ভারি হয়ে বসল তার বুকে, দিন দিন সে বোঝা বাড়তেই থাকল। অনেকবার তার ইচ্ছে হয়েছিল চিঠিটা গিয়ে পুরুতকে দেখায়, কিন্তু দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা থেকে তার জানা ছিল, লোকে যা বলে সেটা সত্যি: ‘মানুষ সম্পর্কে সত্যি কথা পুরুত বললেও বলতে পারে ভগবানের কাছে, মানুষের কাছে কদাচ নয়।’

প্রথম যে লোকটার কাছে চেকো জিগ্যেস করেছিল ঐ রহস্যময় পোস্ট কার্ডটার তাৎপর্য কি, সে লোকটা ছিল একজন বিদেশী শিল্পী, লালচে চুল, চেঙা মতো দেখতে, চেক্কোর বাড়িতে সে আসত প্রায়ই। ছবি আঁকার ইজেলখানাকে সে সুবিধা মতো ঘুরিয়ে রেখে পাশে শুয়ে পড়ে ঘুমত, অসমাপ্ত ছবিটার চৌকো ছায়ার মধ্যে মাথা দিয়ে। চেক্কো ওকে জিগ্যেস করলে, ‘সিনোর, এই লোক দুটো কি করেছে, দেখুন তো।’

ছেলে দুটোর হাসিখুশি মুখের দিকে তাকিয়ে শিল্পী বলেছিল: ‘নিশ্চয়ই খুব একটা ফুতির কাজ করেছে…’

‘কিন্তু ওদের সম্পর্কে কি লেখা আছে এখানে?’

‘লেখাটা ইংরেজিতে। ইংরেজ ছাড়া এ ভাষা বোঝা আর কারো এই নয়- হয়ত ভগবান বোঝেন আর বোঝে আমার স্ত্রী, যদি অবিশ্যি যে মিছে কথা না বলে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যদিও সে মিছে কথাই বলে…’

ছাতার পাখির মতো বকবক করে গেল শিরীটা। বোঝাই যাচ্ছিল যে কোনো কিছু গুরুত্ব দিয়ে বলার ক্ষমতা ওর নেই, বুড়ো ওর কাছ থেকে চলে এসেছিল বিতৃষ্ণায়। পরের দিন গিয়েছিল শিল্পীর স্ত্র স্থূলকায়া মহিলাটির কাছে। উনি তখন বাগানে ছিলেন, স্বাচ্ছ শাদা কি একটা কাপড়ের তৈরি একটা ঢালাও গাউন পরে মহিলাটি দোলনায় গা এলিয়ে গরমে খামছিলেন, আর নীল আকাশের দিকে দীন চোখ দুটো তুলে রেখেছিলেন সরোষে।

ভাঙা ভাঙা ইতালিয়ানে তিনি জানালেন, ‘এদের জেল হয়েছে।’ চেক্কোর পা দুটো কেঁপে উঠল যেন যা খেয়ে নড়ে উঠেছে গোটা দ্বীপটা। তবু শক্তি সাহস সঞ্চয় করে জিগ্যেস করলে চেক্কো:

‘ওরা কি চুরি করেছে কিছু, কিংবা খুন খারাপি করেছে কাউকে?’ ‘না, ও সব কিছু না। ওরা হল গিয়ে সোশ্যালিস্ট।’ ‘সোশ্যালিস্ট সে কি ব্যাপার?’

‘ও সব হল গিয়ে রাজনীতি, বুঝেছ।’ ক্ষীয়মাণ গলায় কথা কয়টি বলে মহিলাটি চোখ বুঁজলেন।

চেকো জানত, বিদেশী লোকগুলো ভারি বোকা, কালাব্রিয়ানদের চাইতেও বোকা, কিন্তু তার ছেলে দুটির কি হল সে কথাটা তাকে যে জানতেই হবে। তাই মহিলাটির পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করলে, কখন উনি তাঁর আলস্যে ভরা বড়ো বড়ো চোখ দুটি মেলে তাকাবেন। এবং অবশেষে যখন তিনি চোখ খুললেন, তখন আঙুল দিয়ে পোস্ট কার্ডটা দেখিয়ে চেক্কো জিগ্যেস করলে:

‘জিনিসটা কি সাঁচ্চা?”

বিরাতে উনি বললেন, ‘জানি না। বললামই তো ও হল গে রাজনীতি, বুঝতে পারলে না?’

মা, বুঝতে সে পারেনি। রাজনীতি হল এমন একটা জিনিস বা দিয়ে রোমের মন্ত্রী আর ধনী ব্যক্তিরা গরিবদের, বেশি টাকা ট্যাকল দিতে বাধ্য করে। কিন্তু তার ব্যাট। দুটি যে মজুর, থাকে আমেরিকায়, ছেলে হিসেবেও খাসা। রাজনীতির কি দায় পড়ল তাদের?

হাতের মধ্যে ছেলে দুটির ছবিটা নিয়ে সারা রাত বসে রইল যে-চাঁদের আলোয় ছবি দুটো দেখাচ্ছিল কালো কালো, আর তার চেয়েও কালো হয়ে উঠেছিল বুড়ো মানুষটার ভাবনা।

সকালে সে ঠিক করলে পুরুতকেই জিগ্যেস করবে। কালো আলখাল্লা-পরা লোকটা কড়া করে ‘সংক্ষেপে বললে:

‘ঈশ্বরের ইচ্ছা যারা অমান্য করে, তারাই হল সোশ্যালিস্ট। এইটুকু জানলেই তোমার যথেষ্ট।’

তারপর বুড়ো যেতে না যেতেই পুরুত আরো কড়া করে বললে: ‘এতখানা বয়স হল, এখন এই সব জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে যাওয়া তোমার পক্ষে লজ্জারই কথা!….’

চেক্কো ভাবলে, ‘ভাগ্যিস ছবিখানা ওকে দেখাইনি।’

গেল আরো কয়েকদিন। বুড়ো গেল একদিন নাপিতের কাছে – লোকটা বাবু গোছের, মাথায় কিছু নেই, জোয়ান গাধার মতো তাগড়াই। লোকে বলত, বয়স হয়ে যাওয়া যে সব মার্কিনী মেয়েরা মুখে বলত সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখতে এসেছে অথচ আসলে চাইত গরিব ঘরের ছোকরাদের সঙ্গে মজা লুটতে, তাদের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে ও ভালোবাসা বিলোয়।

ছবির ওপরকার লেখাগুলো পড়ে বদ লোকটা চেঁচিরে উঠল, ‘ছার ভগবান।’ খুশিতে লাল হয়ে উঠল ওর গাল দুটো। বললে, ‘আরত্বরে। আর এনরিকো হল আমার কমরেড। তোমায় অভিনন্দন এন্ডোরে বাবা, দিল খুলে তোমার অভিনন্দন, তোমাকে আর আমাকে। এ দেশের আরো দুটো ছেলে নাম করলে তাহলে। কি রকম গর্বের কথা বলো।’

“বুড়ো ধমক দিলে, ‘বোকার মতো আজেবাজে বোকো না তো বাপু।’

কিন্তু নাপিত তার হাত নেড়ে চেঁচাতে লাগল: ‘তোফা। খাসা!’

‘লিখেছে কি এখানে?’ বুড়ো জানতে চাইল।

‘কি লিখেছে তা পড়তে পারছি না, কিন্তু দেখে নিয়ো, সত্যি কথাই লিখেছে। গরিবদের সম্পর্কে যখন সত্যি কথা লিখেছে, তখন, নিশ্চয় তারা খুব একটা বীরত্বের কাজ করেছে।’

‘দোহাই বাপু, বকবকানি থামাও তো।’ বলে পাথরের ওপর কাঠের জুতোর প্রচণ্ড শব্দ করতে করতে চলে গেল চেক্কো।

গেল সেই রুশ ভদ্রলোকের কাছে। লোকে বলে মানুষটা নাকি সৎ আর দয়ালু। যে খাটিয়ার ওপর মানুষটা শুয়ে শুয়ে মরণ গুণছিল, সেই পাটিয়ার কাছে এসে বসল চেক্কো। জিগ্যেস করলে:

‘এই লোক দুটো সম্পর্কে, কি লিখেছে এখানে?’

রুশ ভদ্রলোক তার রোগপাণ্ডুর বিষণ্ণ চোখ দুটো কুঁচকে কাহিল গলায় লেখাটা পড়ল, একটা প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠল তার মুখচোখ। বুড়ো চেক্কো বললে, ‘দেখুন সিনোর, ঢের বয়স হয়েছে আমার, শীগগিরই ওপারে যেতে হবে। মাডোনা যখন জিগ্যেস করবেন, ছেলেদের নিয়ে তুই কি করেছিস, তখন সত্যি কথা সব খুলে বলতে হবে তো। কিন্তু এই আমার দুটি ছেলে- তারা কি করল কেনই বা জেনে গেল তার কিছুই যে আমি জানি না?’ রুশ ভদ্রলোক তাকে অকপট পরামর্শ দিলে:

‘মাডোনাকে বলো, মাডোনার নিজেরই পুত্র যে প্রধান উপদেশ দিয়েছিলেন, সেইটে তারা খুব ভালো করেই মেনেছে: সত্যি করেই ওরা তাদের প্রতিবেশীদের ভালোবেসেছে…’

বুড়ো লোকটা বিশ্বাস করলে রুশ ভদ্রলোকের কথা, কেননা সহজ ভাষায় কখনো মিছে কথা বলা সম্ভব নয়, নিছে কথা বলতে হলে চাই ভালো ভালো শব্দ, ফলাও ফলাও বুলি। রুগ্ন লোকটার ছোটো ছোটো যে হাতে কখনো কড়া পড়েনি সেই হাত নিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে বুড়ো বললে:

‘তাহলে জেলে যাওয়া ওদের পক্ষে সরমের কথা কিছু নয়?’

রুশ বললে, ‘না। জানো তো, বড়োলোকেরা জেলে যায় শুধু তখনই যখন এত বেশি অপরাধ জমেছে যে আর লুকনো সম্ভব নয়। আর গরিবেরা জেলে যায় যেই তারা একটুখানি মঙ্গলের জন্যে চেষ্টা করে। আমি বলছি শোনো, ছেলের দিক থেকে তুমি ভাগ্যবান।’ চেক্কোর সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে সে কথা কইলে, ক্ষীণ দুর্বল কণ্ঠে বললে, গরিবি আর বোকামি দূর করার জন্যে, গরিবি আর বোকামি থেকে যে সব অমঙ্গল আর জঘন্য জিনিস জন্মায় তা দূর করার জন্যে দুনিয়ার ভালো মানুষেরা কি কি করছে…

আগুনের ফুলের মতো আকাশে অলে সূর্য, ধূসর পাথরগুলোর ওপরে ঝরে ঝরে পড়ে সূর্যকিরণের সোনালী স্বর্ণ ধূলি কণিকা, আর পাথরের প্রত্যেকটা ফাটল থেকে সূর্যের দিকে মাথা তোলে সতৃষ্ণ জীবন – মাথা তোলে সবুজ সবুজ ঘাস আর আকাশের মতোই নীল নীল ফুল। স্ফটিকের মতো ফেঁপে ওঠা শিশির বিশুর ওপর রোদ্দুরের সোনালী ফুলকি ঝিলিক দিয়ে উঠেই ফুরিয়ে যায়।

সঞ্জীবনী সূর্যকিরণ পান করে চলেছে সব প্রাণী, তাড়াহুড়ো করে বাসা বানাতে বানাতে গান গাইছে পাখিগুলো- চারিপাশের এই সব কিন্তু দেখে মুড়োটা, এই সবকিছু শোনে, আর ভাবে তার ছেলেদের কথা, কালাপানির ওপারে মস্ত এক শহরের গরাদের পেছনে তারা বসে আছে। বুড়ো ভাবে, বেচারা ছেলে দুটোর স্বাস্থ্য ভেঙে যাবে। জেলের মধ্যে…

কিন্তু তারপর বুড়ো ভাবে, ওদের জেলে যেতে হয়েছে, কেননা গাঁচ্চ। জোয়ান হয়ে উঠেছে তারা, সারা জীবন ধরে যেমন সাঁচ্চা থেকেছে তাদের বাপ- আর তা ভেবে তৃপ্তি পায় সে, ব্রোঞ্জ রঙের মুখখানা তার নরম হয়ে আসে এক গর্বের হাসিতে।

‘দুনিয়ায় সম্পদের অভাব নেই, কিন্তু মানুষগুলো গরিব, সূর্য দেয় কিন্তু মানুষ হল নিষ্ঠুর। এই সব কথা আমি ভেবে মরেছি সারা জীবন, আর সে কথা ওদের না বললেও ওরা টের পেয়েছে বাপের ভাবনা। হপ্তায় ছ ডলার, তার মানে চল্লিশ লিরা। বাপরে! কিন্তু ওরা ভাবল, ভারি কম মজুরি, আর ওদের মতো পঁচিশ হাজার আরো লোক, তারাও সেই কথা ভাবল- মানুষের পক্ষে ভালো করে বাঁচতে হলে এ মজুরিতে চলে না…’

ওর দৃঢ় বিশ্বাস, যে সব ভাবনা ছিল ওর নিজের মনের মধ্যে, তাই ফুলের মতো ফুটে উঠেছে ওর ছেলেদের ভেতরে, আর সে কথা জেনে ওর গর্বের সীমা নেই। কিন্তু এও জানে ও, দিনের পর দিন লোকেরা নিজেরা যে সব রূপকথা বুনেছে নিজেরাই তা বিশ্বাস করতে চায় না। তাই নিজের ভাবনা সে চেপে রাখে নিজের মধ্যে।

তবু মাঝে মাঝে ওর বিপুল প্রাচীন হৃদর উপছে ওঠে তার ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে, জীর্ণ শিরদাঁড়াটাকে সে তখন সোজা করে দাঁড়ায়, নিঃশ্বাস নেয় গভীর করে, শরীরের শেষ হয়ে যাওয়া শক্তির সবখানি জড়ো করে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে সমুদ্রের দিকে চেয়ে, সেই দিকে চেয়ে যেদিকে আছে তার ছেলেরা:

‘ভালু-ও-ও!…’

আর সমুদ্রের ধন মসৃণ জলের ওপর উঁচু থেকে আরো উঁচুতে ওঠে সূর্য, আর হাসে, আর আঙুর-বাগিচার লোকজনদের কাছ থেকে ফিরে আসে বুড়ো লোকটার ডাকের জবাব:

‘ও-ও!…’

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024