তানহা তাসনিম
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে চালু হওয়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বিশেষ ট্রেনটি পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্তের ১০ দিন আগেই বন্ধ ঘোষণার পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে এই রুটে ট্রেন বাড়ানোর দাবির বিপরীতে চালু থাকা ট্রেনটিও বন্ধের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যাত্রী অধিকার সংগঠনগুলো।
কর্তৃপক্ষ বলছে, ইঞ্জিন ও জনবল সংকটের কারণেই এমন সিদ্ধান্ত। তবে পরবর্তীতে যোগাযোগ করা হলে বিবিসি বাংলাকে রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আসন্ন ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে রেলের প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই বিশেষ ট্রেনটি বন্ধ রাখা হয়েছে।
ট্রেন বন্ধের পক্ষে দেয়া যুক্তি নিয়ে ‘মিশ্র প্রতিক্রিয়া’ জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কারও মতে, উৎসব উপলক্ষে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের’ অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে, আবার কেউ বলছেন ট্রেন বন্ধের কারণ হিসেবে জনবল ও ইঞ্জিন সংকটের বিষয়টি একেবারেই ‘গ্রহণযোগ্য নয়’।
আঠারো হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত হয় ১০২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের রেললাইন।
গত বছর ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন রেল লাইনটির উদ্বোধনের পর পয়লা ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কক্সাবাজার রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়, যেটির নাম রাখা হয় কক্সাবাজার এক্সপ্রেস।
পরে এ বছর জানুয়ারিতে ঢাকা থেকে একই রুটে পর্যটক এক্সপ্রেস নামের আরও একটি ট্রেন চালু করা হয়।
এই দুটি ট্রেনই চট্টগ্রাম স্টেশনে বিরতি দিলেও শুধুমাত্র চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাতায়াতের কোনো পৃথক ট্রেন চালু করা হয়নি।
এনিয়ে সেখানকার মানুষ প্রতিক্রিয়া জানায় এবং বিভিন্ন নাগরিক প্ল্যাটফর্ম থেকে এই রুটে ট্রেন চলাচলের দাবি ওঠে।
এমন পরিস্থিতিতে ঈদুল ফিতর উপলক্ষে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে আটই এপ্রিল ‘কক্সবাজার স্পেশাল’ নামে একটি বিশেষ ট্রেন চালু করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
‘ঈদ স্পেশাল’ এই ট্রেনটি ঈদের আগে পাঁচ দিন ও পরে পাঁচ দিন মিলিয়ে মোট ১০ দিন চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে বিবিসি বাংলাকে জানান পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম।
পরবর্তী সময়ে যাত্রীদের চাহিদা ও রেলওয়ের সক্ষমতা বিবেচনায় রেখে দফায় দফায় এই ট্রেন চালু রাখার মেয়াদ বাড়ানো হয়।
সবশেষ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী জুনের ১০ তারিখ পর্যন্ত এই ট্রেন চালু রাখার কথা ছিল।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত আটই মে বিশেষ ট্রেনটি স্থায়ী করাসহ এই রুটে নতুন আরও একটি ট্রেন চালুর জন্য রেল কর্তৃপক্ষকে স্মারক প্রদান করে চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলওয়ে যাত্রী কল্যাণ পরিষদ।
কিন্তু নির্ধারিত তারিখের ১০ দিন আগেই অর্থাৎ ৩০ই মে ট্রেনটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কর্তৃপক্ষ বলছে, কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন বন্ধ রাখতে বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে (ডিআরএম) চিঠি দেয় রেলওয়ের যান্ত্রিক বিভাগ।
এতে রেলওয়ের মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে কক্সবাজার স্পেশাল-৩ ও ৪ ট্রেনটি আগামী ১০ জুন পর্যন্ত চলাচলের যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ইঞ্জিন ও লোকোমাস্টারের সংকটের কারণে ৩০ই মে থেকে তা বাতিলের কথা উল্লেখ করা হয়।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে ট্রেন বন্ধের খবরটি গণমাধ্যমে আসার পর এনিয়ে দেখা যায় তীব্র প্রতিক্রিয়া।
বিশেষ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে দেয়া এক বিবৃতিকে কেন্দ্র করে সামাজিক মাধ্যমে এই আলোচনা আরও ঘনীভূত হয়।
বিবৃতিতে ‘বাস মালিকদের প্রেসক্রিপশনে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের জনপ্রিয় ট্রেন সার্ভিস কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেন বন্ধ করা হচ্ছে’ বলে অভিযোগ করেন সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
এমনকি বাস মালিকদের স্বার্থরক্ষায় রেল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
এ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হবার পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তা শেয়ার করে প্রতিক্রিয়া জানান।
খবরটি শেয়ার করে নারায়ণগঞ্জের কাজী শাহজাহান মিয়া লেখেন, “বিশ্বে এমন ‘বাংলাদেশ’ আর কয়টা আছে? মিশন ১ এর পর এখন অপেক্ষার পালা মিশন ২ ঢাকা টু কক্সবাজার রেল বন্ধ করা। এরপর মিশন ৩, মিশন ৪, কেবল সাকসেস আর সাকসেস (জনগণের না, সিন্ডিকেটের)।”
মো. আরিফুল মোস্তাফা আরিফ নামের একজন লেখেন, “রেল অলাভজনক, কিন্ত ঢাকা-কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অতি লাভজনক হওয়ার পরেও মাত্র দেড় মাসের মাথায় বন্ধ হলো চট্ট-কক্স বিশেষ ট্রেন, কার চাপে, কার স্বার্থে, থলের কালো বিড়ালটা কোথায়??
উত্তর নেই!! বাস সিন্ডিকেটের কাছে জনগণ উপেক্ষিত। এভাবে চলছে দেশটা আল্লাহর ওয়াস্তে।”
ওয়াহিদ সারোয়ার নামে আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “চট্রগ্রাম- কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণে ১৮-২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে পারলো আর সামান্য এক-দুইজন ট্রেন চালক নিয়োগ করতে না পারার অজুহাতে এই রুটের রেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করলো।”
ফাহিম মোর্শেদ নামে একজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, “বাস মালিকদের উৎকোচে লাল হয়ে গেছে রেলের বড় বাবুরা, তাই জনবল সংকট দেখিয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রোডের বিশেষ ট্রেনটি বন্ধ করেছেন।”
বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেন সার্ভিস নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপের এডমিন প্রণয় কুমার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মিটারগেজের লোকোমোটিভের ইঞ্জিন সংকট থাকলেও এমন কোনো সংকট হয়ে দাঁড়ায়নি যে এতদিন ধরে চলে আসা একটি ট্রেনকে বন্ধ করে দিতে হবে।”
নাম প্রকাশে না করার শর্তে রেল সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি বিবিসিকে বলেছেন, ‘বাস মালিকদের প্রভাবে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির আনা অভিযোগের প্রেক্ষাপট বহু পুরানো। বিভিন্ন বিষয়ে রেলের সিদ্ধান্তের দীর্ঘসূত্রতার কারণে আগেও এমন অভিযোগ এসেছে বারবার।’
তাদের মতে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে আগে বাস মালিকদের যে একচেটিয়া ব্যবসা ছিল, রেল আসার কারণে তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব পড়ছে। আবার সময়ের দিক থেকে ট্রেন যেমন বাসের আগে পৌঁছায়, তেমনি দুর্ঘটনাও ঘটে তুলনামূলক কম।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রেল চালু হবার পর যাত্রী আকর্ষণের জন্য বাস ভাড়া আগের চেয়ে কমিয়েও আনা হয়েছে।
কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় ‘বিহাইন্ড দ্য সিন কোনো ম্যানিপুলেশন’ হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
ইঞ্জিন ও লোকবল সংকটের পাশাপাশি আসন্ন ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে রেলের পূর্ব প্রস্তুতির চিন্তা থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের বিশেষ ট্রেন বন্ধের কথা জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, “নিয়মিত ট্রেন না হওয়া সত্ত্বেও দেড় মাসের ওপরে ট্রেনটি চলছে। আর রেলের ইঞ্জিন ‘লিংকে’ বা পালাক্রমে কাজ করে। ফলে একটি ইঞ্জিন চলমান থাকলে, আরেকটি থাকে সার্ভিসিংয়ে।”
দীর্ঘ সময় ধরে স্পেশাল ট্রেন চলমান থাকায় অন্যান্য ট্রেনের ওপরও প্রভাব পড়ছে বলে জানান তিনি।
এছাড়াও আসন্ন ঈদুল-উল আজহায় আরও ১০ জোড়া ‘ঈদ স্পেশাল’ ট্রেন চলবে। যার কারণে ইঞ্জিনের সংকট এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধতার মধ্যেই ‘রিসোর্সের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটটিতে ট্রেন চলাচলের জন্য কী পরিমাণ ইঞ্জিনের প্রয়োজন এবং কতটা ঘাটতি আছে সে বিষয়ে জানতে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী তাপস কুমার দাসের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ট্রেন বন্ধ হবার কারণ হিসেবে রেল কর্তৃপক্ষের জনবল ও ইঞ্জিন সংকটের যুক্তি মানতে একবারেই নারাজ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলন।
তার মতে, বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরেই জনবলের ঘাটতি আছে। সেখানে রেল একটি বিরাট সেক্টর। আর যদি সংকট থাকতোও, তবে অন্য আরও রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হতে পারতো।
কিন্তু জনবল ও ইঞ্জিন সংকটের অজুহাতে ট্রেন বন্ধ করার বিষয়টি ‘কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে উৎসবের আগে চাহিদা অনুযায়ী রুট বণ্টনের জায়গা থেকে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের’ জন্য এমন সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলেই মত বুয়েটের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশ্লেষক ড. মো. সামছুল হকের।
“রেলের সীমাবদ্ধতা আছে। রোলিং স্টক, লোকোমাস্টারে টানাপোড়েন আছে। ফলে ঈদের সময় উৎসব উপলক্ষে নির্দিষ্ট চাহিদা মেটাতে রিসোর্স পুনর্বণ্টন করতে পারে,” বলেন তিনি।
কিন্তু ঈদের পরেও জনপ্রিয় ও চলমান এই সার্ভিসটি ফেরত না আসলে ‘সন্দেহের সুযোগ থাকবে’ বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।
তবে ‘বাস মালিকদের স্বার্থে রেল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে চলমান আলোচনার’ কোনো ‘যৌক্তিকতা দেখেন না’ ড. হক।
তার মতে, রেল স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। সেক্ষেত্রে বাস মালিকদের বাড়তি আয়ের জন্য অন্য পরিবহনের এত বড় সিদ্ধান্ত আসার বিষয়টি ‘বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না’।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের বিশেষ ট্রেন বন্ধ হবার সিদ্ধান্ত ঘিরে আলোচনার-সমালোচনার মধ্যেই ১২ জুন থেকে আবারও স্পেশাল ট্রেন চালুর কথা জানায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
আগেরবারের মতো এবারও কেবল ঈদুল-উল আযহাকে উপলক্ষ করেই ট্রেনটি চালু করা হবে বলে জানান মি. ইসলাম।
“আবার ১২ তারিখ থেকে ঈদ স্পেশাল নাম নিয়ে ট্রেনটি ১০-১২ দিন চলবে,” বলেন তিনি।
তবে নিয়মিত ট্রেন না হওয়ায় ঈদের পর এটি বন্ধ হয়ে যাবে।
“স্পেশাল মানে যেকোনো সময় চলবে, তারপর বন্ধ হয়ে যাবে,” বলেন তিনি।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply