শ্রী নিখিলনাথ রায়
মোতিঝিল
অতীতস্মৃতি যখন নবপরিণীতা বধূর ন্যায় ধীরে ধীরে মন্যেমন্দির অধিকার করিয়া বসে, তখন তাহার পাদস্পর্শে চারিদিকে ভাবের পারিজাত-কুসুম ফুটিয়া উঠে, জীবনের শুষ্ক মরুভূমি কোমলতার মধুর ধারায় অভিষিক্ত হইয়া যায়, হৃদয়-তন্ত্রীর তারগুলি মৃদু নিরূণে ধ্বনিত হইতে থাকে। আমরা বর্তমানের নীরস ও বিশুষ্ক রাজ্যের অধিবাসী; প্রতিদিন একই রূপের, একই ভাবের ছবি আমাদের দৃষ্টি-সমক্ষে ‘ঘুরিয়া বেড়াইতেছে! আমরা সেই অবিকার, অবিশেষ দৃশ্যে ক্লান্ত হইয়া পড়িতেছি।
তাই মধ্যে মধ্যে আমাদিগের ক্লিষ্ট প্রাণকে শান্ত করিবার জন্য অতীতস্মৃতি সোহাগিনী প্রণয়িনীর ন্যায় হৃদয়ে অমৃত- ধারা ঢালিয়া দেয়। যখন কোন পুরাতন স্থান দৃষ্টিপথের পথিক হয়, অথবা কোন পুরাণ কাহিনী কর্ণকুহরে প্রবেশ করে, তখনই যেন কি এক প্রফুল্লতায় আমাদের চিত্ত পরিপূর্ণ হইয়া যায়! তখন আমরা বর্তমান ভুলিয়া অতীতের সঙ্গে মিশিয়া যাই এবং তাহার মাধুরীতে আপনাদিগকে সিক্ত করিয়া ফেলি। কোন কবি অতীতকে চির- সমাহিত করিতে উপদেশ দিয়া কেবল বর্তমানের উপর নির্ভর করিতে বলিয়াছেন।
অবশ্য, কাৰ্য্যশীল মাত্রেই বর্তমান ব্যতীত আর কোন দিকে দৃষ্টিপাত করিবেন না সত্য, কিন্তু তাহা হইলেও, অতীতের মধুর স্বতি জীবনে যে কোমলতার ফুল ফুটাইয়া দেয়, তাহার পবিত্র সৌরভ হইতে একবারে বঞ্চিত হইতে আমরা সকল সময়ে ইচ্ছা করি না। পূরাণ স্থান ও পুরাণ কথা অতীতস্মৃতির উদ্বোধন করিয়া থাকে। সেই জন্য এমন কি, যখন কোনও ভগ্নস্তূপ বা বিধ্বস্তপ্রায় স্থান আমাদের দৃষ্টিপথে পতিত হয়, অথবা আমরা কিয়ৎকালের জন্য কোন অসংলগ্ন প্রাচীন উপকথায় মনোনিবেশ করি, তখন আমরা যেন তাহাদেরও মধ্যে অতীতের মনোমোহন ছবি দেখিতে পাই।
সে ছবি অস্পষ্ট হইলেও মধুরতাময়। প্রায় সার্দ্ধশত বৎসর অতীত হইল, মোতিঝিলের গৌববকাহিনী মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে স্থান পাইয়াছে। তাহার তীরস্থিত প্রাসাদ মুসল্মানরাজত্বের শেষ ভাগে ও ইংরেজ- রাজত্বের প্রারম্ভে অনেক অভিনয়ের রঙ্গভূমিরূপে পরিগণিত হইয়াছিল। অনেক দিন হইল, সে প্রাসাদ ধূলিরাশিতে পরিণত হইয়াছে; কেবল তাহার ভিত্তিভূমি তৃণাচ্ছাদিত হইয়া অতীতের কথা স্মৃতিপটে বিকাশ করিয়া দিতেছে।
Leave a Reply