শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:১৩ পূর্বাহ্ন

ইতালির রূপকথা (খ্রীষ্টের জন্ম)

  • Update Time : শনিবার, ১ জুন, ২০২৪, ৮.০৩ পিএম

মাক্সিম গোর্কি

রাত বারোটা বাজল বলে।

কাপ্রির ছোট স্কোয়ারটার ওপরে নীল আকাশে ভেসে যায় নিচু নিচু মেঘ। থেকে থেকে ফুটে ওঠে, তারার উজ্জ্বল আলপনা। নীল লুব্ধক নক্ষত্র এক একবার জ্বলে ওঠে, এক একবার নেভে। গির্জার খোলা দরজা থেকে বেরিয়ে আসে অর্গানের জলদমন্দ্র সুর। আর এই ছুটন্ত মেঘ, কাঁপন লাগা তারা, দালান কোঠার দেয়াল আর স্কোয়ারের পাথরের ওপর ছায়ার ঝিলিমিলি এই সব কিছুই লাগে এক কোমল সঙ্গীতের মতো।

ভাবগম্ভীর ছন্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে সারা স্কোয়ারটা মনে হয় যেন নাটকের এক মঞ্চ, কখনো তা অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে, দেখাচ্ছে অপরিসর, কখন বিস্তীর্ণ হয়ে ভরে উঠছে আলোয়।

মন্টে-যোলিমারো’র ওপরে জেগে আছে অপরূপ কালপুরুষ। উজ্জ্বল এক মুকুটের মতো শাদা মেঘ দিয়ে পাহাড়ের চূড়ে। ঢাকা। পাহাড়ের খাড়া গায়ে সারি সারি ফাটল দিয়ে খাঁজকাটা। মনে হয় যেন এক প্রাচীন মুখচ্ছবি, পৃথিবী আর মানুষ সম্পর্কে উদ্বুদ ভাবনায় বলিরেখাঙ্কিত।

ছয়শো মিটার ওপরে পাহাড়ের গায়ে আছে একটা পরিত্যক্ত ছোটো মঠ আর কবরখানা, ফুল-বাগিচার ছোটো ছোটো কেয়ারির মতো সারি সারি কবর। যে সাধুরা এখানে একদিন ছিল তাদের দেহশেষ আছে তার তলায়। এ মঠ এখন মেঘে ঢাকা। মেঘের ফাঁকে মাঝে যাবো দেখা যায় মঠের ধুসর দেয়াল উকি দিচ্ছে, যেন শুনতে চাইছে কি চলেছে নিচে।

ভিড়ের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে কোলাহলমুখর বাচ্চার দল ছুটে বেড়ায় স্কোয়াবের মধ্যে, বাজি পোড়ায়। আগুনের সাপগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে বাতাসে, পাথরের ওপর ছড়িয়ে পড়ে রাশি রাশি লাল ফুলকি। মাঝে মাবো সাহস করে বাজিতে আগুন দিয়ে কেউ কেউ ছুড়ে দেয় উঁচুতে, ভয় পাওয়া বাদুড়ের মতো বাজিটা হিস্ হিস্ করে পাক খেতে থাকে বাতাসে। ছোটো ছোটো কালো কালো চতুর যতো মুর্তি হাসিহল্লায় ছুটে বেড়ায় চারিদিকে, সজোরে একটা বাজি ফাটে কোথায়, ঝলসানির আলোয় মুহূর্তের জন্যে আলো হয়ে ওঠে ছেলেগুলোর কোণে কোণে গুঁড়ি মেরে থাকা মূর্তিগুলো, অন্ধকারের মধ্যে ফুর্তিতে চকচক করে তাদের উজ্জ্বল চোখগুলো।

বাজি ফাটার শব্দে যেন ছেদ নেই। হাসিহল্লা, ভয়-পাওয়া চিৎকার আর শব্দিত লাভার ওপর কাঠের জুতোর ঠকঠক আওয়াজ সব কিছু ডুবে যায় তাতে। ছায়া নাচে, কাঁপে, আপ্রকৃত আলোর ছটায় জলে ওঠে নেষ, আর ঘরবাড়ির প্রাচীন দেয়ালগুলো বুঝি হাসে – আজ

হারা বুড়ো, এ দেয়ালগুলো তাদের দেখেছে বাচ্চা বয়সে, মনে পড়ে যায়, প্রাক-বড়োদিনের এই রাতে ছেলেদের এই ঈষৎ বিপজ্জনক ভুতির খেলা তারা দেখেছে কতোবার।

এর মধ্যে যদি মুহূর্তের জন্যেও কখনো একটু গোলমাল থামে অমনি শোনা যায় অর্গানের ভাবগম্ভীর লহরী আর নিচু থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের সঙ্গত-শিলাতটের ওপর ভেঙে পড়া তরঙ্গের অস্পষ্ট গর্জন আর নুড়িপাথরের নরম ফিফাস।

উপসাগরটা যেন এক পানপাত্র, ভরে উঠেছে ফেনিল গাঢ় সুরায় আর সে সুরার পাত্রের গলদেশ যিরে ঝিকমিকিয়ে আছে শহরের আলোগুলো- উপসাগরের গলায় এক দামী জড়োয়া হারের মতো।

নেসের ওপরকার আকাশে জেগেছে বহুবর্ণ আভা, কাঁপছে উত্তর নেরুজ্যোতির মতো, গণ্ডা গণ্ডা হাউই আর আতসবাজি ফুঁসে উঠে রঙীন আলোর তোড়া হয়ে ফুটে উঠছে, থরো থরো আলোর মেঘে মুহূর্তের জন্যে ভেসে থাকছে স্থির হয়ে, তারপর ভারাক্রান্ত বিলাপে ঝরে পড়ছে নিঃশেষ হয়ে।

আলোর এই শোভন লীলায় জেগে উঠেছে উপসাগরের অর্ধবৃত্তের সবখানি। নিষ্প্রাণ চোখে সমুদ্রের দিকে চেয়ে আছে শুধু নেন্সের বন্দরের শাদা আলোকস্তম্ভটা, ঝিকিয়ে উঠছে কাপো-দি-মিসেনার লাল চোখ। কিন্তু ইস্কিয়ার পাদদেশ আর প্রোচিদায় আলোর মালা দেখে মনে হয় যেন ‘রাত্রির মসৃণ মখমলের ওপর মস্ত মস্ত হীরের পাঁতি গাঁথা।

উপসাগর ঘিরে শ্বেতশীর্ষ উর্মির আলোড়ন। বিস্ফোরণের সুদূর শব্দগুলোকে আচ্ছন্ন করে জাগে তাদের তরঙ্গভঙ্গের সুর। অর্গানে চলতেই থাকে ঝঙ্কার, হাসতেই থাকে ছেলেরা। হঠাৎ সাড়ম্বরে মিনারের ওপরকার গড়িতে চউ বেজে ওঠে। চণ্ড করে প্রথমে চারটে পরে বারোটা শেষ হয়ে যায় উপাসনা। রঙীন এক স্রোতের মতো গির্জার দরজা দিয়ে ভিড় করে বেরিয়ে আসে লোকজন, চওড়া চওড়া সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নিচে যেখানে লাল লাল আতসবাজির লাফ ঝাঁপ চলেছে, মেয়েরা আঁৎকে ওঠে আর খুশিতে হাসে বাচ্চাগুলো; আজ তাদের পরবের দিন, লাল আগুন নিয়ে আজ তাদের খেলায় মানা করবে কে?

পরবের পোষাক-পরা ধীরস্থির গোছের বড়ো মানুষ কাউকে খানিকটা ভয় পাইয়ে দিয়ে কি মজাই না জমে। গোমড়ামুখোটা লাফালাফি শুরু করে দেবে স্কোয়ারের মধ্যে, সজোরে হিস্ হিস্ শব্দ করতে করতে যে বাজিটা তাড়া করে আসছে তাকে এড়াবার জন্যে হুটোপুটি করবে এদিক ওদিক, ছিটকে এসে জুতোর উপর পড়বে ফুলকি! আর এ মজা তো শুধু বছরে একবার…

যে শিশু ওদের ভালোবেসেছিল সেই শিশুর জন্মের এই পূর্বলগ্নে ছেলেদের মনে হয় তারা রাজা, জীবনের তারা মালিক, বছর ধরে বড়োদের একটানা প্রভুত্বের শোধ তোলে তারা এই কয়েক মিনিটের ফুর্তির চূড়ান্ত করে। কি মজাই না লাগে যখন বড়োরা আনাড়ীর মতো ছটফট করে আগুন থেকে পালাবার চেষ্টা করবে, রাগ না করে অনুনয়-বিনয় করে পরিত্রাণ খুঁজবে:

‘খুব হয়েছে। আরে এই, এই পাজিগুলো, খুব হয়েছে!’ এর পর আসে জাম্পোনিয়ারির দল, আব্রুজ্জির পাহাড়ী মেষপালক ওরা, গায়ে খাটো নীল পোষাক, চওড়া কানাওয়ালা টুপি, সুগঠিত পা ঢেকে পশমের শাদা মোজা, তার ওপর কালো কালো কাটাকুটি ডোরা টানা। ওদের দুজনের কাছে দুটো ব্যাগ-পাইপ, চার জনের হাতে কাঠের শিঙা-চড়া সরু আওয়াজ বেরয় তা থেকে।

প্রতি বছর লোকগুলো এখানে আসে, থাকে গোটা মাসটা, ওদের আশ্চর্য সুন্দর সুন্দর সুর বাদিয়ে বাজিয়ে জয়গান করে প্রভু আয় মেরি মায়ের।

তোর বেলায় ওরা যখন মাথার টুপিগুলো পায়ের কাছে ফেলে মাডোনার মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ভক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হায়ের কোমল মুখের দিকে, বাজায় সেই অনির্বচনীয় সুর, একদা যথার্থই যার নামকরণ হয়েছিল, ‘ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ তন্ময় দশা’- তখন ওদের দেখে বুকু দুলে ওঠে।

মেষপালকের দলটা এখন চলেছে বুড়ো ছুতোর পাওলিনোর বাড়িতে, সেখান থেকে ঘোড়ার দানা দেবার ডাবার মধ্যে থেকে শিশুকে তুলে নিয়ে যাবে সেপ্ট তেরেসা গির্জায়।

ছেলেরা ছোটে ওদের পেছন পেছন। কালে। কালো মুতিগুলোকে গ্লাস করে নেয় সঙ্কীর্ণ রাস্তাটা, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায় স্কোয়ার, শুধু অল্প কিছু লোক দাঁড়িয়ে থাকে গির্জার সিঁড়ির ওপর, অপেক্ষা করে শোভাযাত্রার জন্যে; আর থাকে শুধু মেঘের উষ্ণ ছায়াগুলো, ঘরবাড়ির দেয়াল আর লোকজনের মাথায় ওপর দিয়ে নিঃশব্দে সে ছায়া সরে যায় যেন আদর জানিয়ে।

নিঃশ্বাস ফেলে সমুদ্র। অনেক দূরে দ্বীপের যোজক-ভূমির ওপর অন্ধকারে দেখা যায় একটা পাইন গাছ, মনে হয় যেন সরু পায়ার ওপর একটা মস্ত ফুলদানি। দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কালপুরুষ মন্টে-সোলিয়ারো’র মাথার ওপরকার মেঘটা অদৃশ্য হয়ে গেছে কখন। খাড়াইয়ের ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ ছোটো মঠখানা আর মঠের সামনে প্রহরীর মতো নিঃসঙ্গ গাছটা পরিষ্কার দেখা যায় এখন।

রামশিঙার মতো রাস্তার খিলানটা থেকে ভাস্বর ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে আসে মেষপালকদের সানন্দ গান। খোলা মাথা, বাঁকা নাক, আর কালো আলখাল্লায় ওদের দেখায় কতকগুলো অতিকায় পাখির মতো-ওরা আগে বাজাতে যাজাতে, আর ওদের ধিরে লম্বা লম্বা ভাণ্ডার ডগায় লণ্ঠন ঝুলিয়ে ঝাঁক বেঁধে আসে বাচ্চারা। বাতাসে দোলে লণ্ঠনের শিখাগুলো, বুড়ো পাওলিনোর বেঁটে গোলগাল শরীর আর রূপোলী মাথাখানার ওপর আলো এসে পড়ে, আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার দু’বাহুর মধ্যে ধরা ফুলে ভরা ভাবাটা, আর ডাবার মধ্যে হাস্যময় শিশু খ্রীষ্টের গোলাপী দেহখানা, আশীর্বাদ দেবার জন্যে ছোটো ছোট্টো হাত দুখানা উঁচুতে তোলা।

মাটির এই মূর্তিটার দিকে বুড়ো মানুষটা এমন ভক্তি ভরে তাকিয়ে থাকে যেন সত্যিই ও শিশু জীবন্ত, যেন নিঃশ্বাস পড়ছে ওর, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই যেন ও ‘শান্তি এনে দেবে পৃথিবীতে, মানুষকে এনে দেবে বরাভয়।’

ডাবাটার দিকে চারিদিক থেকে ঝুঁকে আসে যতো টুপি খোলা, চুলপাকা মাথা, গম্ভীর গম্ভীর মুখ, স্নেহকোমল চোখ। আতসবাজি ছোটে বাতাসে, স্কোয়ার থেকে অন্ধকার পালায় যেন হঠাৎ ভোর হয়ে গেছে। গান গায় ছেলেরা, চেঁচায় আর হাসে, আস্তে করে হাঁসে বড়োরাও, আর মনে হয়, ছেলেদের কাছে মর্যাদা খাটো হয়ে যাবার ভয় না থাকলে ওরাও নিশ্চয় লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠত আনন্দে।

ভিড়ের মাথার ওপর সোনালী দেয়ালী পোকার মতো কাঁপে মোমবাতির হলুদ শিখা। আর তারও ওপরে আকাশের নীল-কৃষ্ণে জ্বলে বিচিত্র ‘তারাগুলো। অন্য একটা রাস্তা থেকে এসে পড়ে আর একটা শোভাযাত্রা, মাডোনার মূর্তি বয়ে আনছে ছোটো ছোটো মেয়েরা। সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশি করে বেজে ওঠে সুর, জ্বলে ওঠে আলো, শুরু হয় আনপের চিৎকার, ছেলেদের হাস্যরোল। উৎসবের উদ্দীপনার আকণ্ঠ ভরপুর হয়ে ওঠে সবাই।

শিশু খ্রীষ্টকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পুরনো গির্জায়। বহুকাল হল উপাসনা বন্ধ হয়ে গেছে এখানে, সারা বছর গির্জাটা খাঁ খাঁ করে। আজ কিন্তু এর প্রাচীন দেয়াল সাজিয়ে তোলা হয়েছে ফুল আর পায় ধাতা, সোনালী লেবু আর তানুগারিন দিয়ে, আর ভেতরের সবখানি জুড়ে টাঙানো হয়েছে নিপুণ একখানা পট-খ্রীষ্টের জন্য।

বড়ো বড়ো শোলার টুকরো দিয়ে বানানো হয়েছে পাহাড়-পর্বত, ওহা, বেখেলহেম্, আর পাহাড়ের চূড়োর অদ্ভুত দর্শন সব কেল্লা। সাপের মতো এঁকেবেঁকে নেমেছে একটা রাস্তা; ছাগল ছেঁড়া চরছে মাঠে। কাচের টুকরো দিয়ে বানানো হয়েছে ঝলমলে জলপ্রপাত, একদল মেষপালক তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে, সেখানে জ্বলছে একটি সোনালী তারা; স্বর্গে ভেসে বেড়াচ্ছে দেবদূতেরা, এক হাত দিয়ে তারা দেখাচ্ছে বেথেলহেমের তারা, অন্য হাতে ওহাটার দিকে- দিব্য মাতা, জোসেফ, আর আকাশের দিকে হাত উঁচু করা শিশুর মূর্তি দেখা যাচ্ছে সেখানে। জ্ঞানীপুরুষ আর রাজন্য বর্গের এক নানা রঙা শোভাযাত্রা চলেছে ওহাটার দিকে, তাদের ওপরে রুপোলী সুতোয় কাঁপছে দেবদূতেরা, হাতে পান পাতা আর গোলাপ। চলেছে উটের পিঠের চাপ। মাগীর দল-লম্বা দাড়ি, পরনে ঝকমকে রেশমী পোষাক, ঘোড়ার পিঠে চাপা রাজন্য বর্গ, কটা রঙের এক রাশ চুল, দামী কিংখাপের পোষাক, কোঁকড়া চুল নুমিদিয়ান, আর আরব, আর ইহুদী, আর হরেক রকমের সব রঙ চঙে, উদ্ভট পোষাক-পর। মাটির পুতুল।

ভাবার চারপাশে শাদা আলখাল্লা-পরা আরব সদাগররা কিন্তু ইতিমধ্যে দোকান খুলে বসে গেছে। হাতিয়ারপত্র, রেশমী কাপড় আর মোনের তৈরি মিষ্টি খাবার বিক্রি করছে তারা; এখানেও কোন এক অজানা জাতের লোকে বিক্রি করছে নদ, কাঁধের ওপর কলস নিয়ে মেয়েরা চলেছে কুয়োর দিকে, আলানি-কাঠ বোঝাই এক গাধাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে চাষী, আর একদল লোক হাঁটু গেড়ে বসেছে শিশুর চারপাশে। আর চারিদিকে শুধু ছেলে আর ছেলে।

খুঁটিনাটি এই সব কিছুই এমন নিপুণ করে গড়ে তোলা ও রম্ভ করা হয়েছে যে মনে হয় যেন সমস্ত ছবিটা জীবন্তের মতো নড়ে চড়ে কোলাহল করে উঠবে বুঝি।

এই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে বাচ্চারা দেখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, ওদের ছোটো ছোটো সতর্ক তীক্ষ্ণ চোখে ঠিক ধরা পড়ে যায় গত বছর থেকে এ বছর নতুন কতোটুকু কি যোগ হয়েছে। যা যা আবিষ্কার করে, তৎক্ষণাৎ তা জানিয়ে দেয় পরস্পরকে, তর্ক বাঁধায়, হাসে, আর চেঁচায়। এক কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুশি হয়েই কচি কচি এই সব শিল্প- বিচারকদের প্রশংসা শোনে পরিতৃপ্ত শিল্পীরা।

সন্দেহ নেই, তারা বয়স্ক লোক, পরিবারের ভার ভারিক্কি কর্তা, খেলনাপাতি নিয়ে মেতে ওঠার কথা নয় তাদের। ভাব দেখায় যেন এ সব কিছুতে কিছুই তাদের এসে যায় না। কিন্তু বড়োদের চেয়ে ছেলেরা প্রায়ই বেশি বোঝে, অনেক বেশি তারা অকপট। তারা জানে, বুড়ো হলেও প্রশংসা শুনতে চায় মানুষ, তাই ঢালাও তারিফ করে চলে তারা, আর তৃপ্তি ও খুশির হাসিটুকু চাপা দেবার জন্যে দাড়ি মোচে হাত বুলোতে থাকে শিল্পীরা।

তারপর এখানে ওখানে গোল হয়ে উৎসুক জটলা শুরু হয়ে যায় ছেলেদের মধ্যে। ‘দল’ বাঁধছে তারা, নববর্ষের পূর্ণসায়াহ্নে ওরা সারা দ্বীপটা ঘুরবে খৃষ্টমাস গাছ আর তারা নিয়ে, এখানকার স্থানীয় কবিয়ালেরা এই উপলক্ষে যে এক অখ্রীষ্টীয় ছড়া বাঁধে, সেই আনলের হড়া ওরা গাইবে এক আদ্যিকালের যন্ত্র থেকে বান বান ঝঙ্কারের সঙ্গে গণ্য বিলিয়ে:

সুখের বছর আইল

শোনোগো পুরবাসী

সুখের কথা কইতে

ছেলেরা মোরা আসি।

 

মনের কপাট খোলো

খোলো টাকার খলি

আজকে প্রভুর পরব

আনন্দে আজ চলি!

 

মুক্তি দাতা গরিব

কি দিয়ে ঢাকি ছেলে?

শীত তাড়াল বৃষ

গরম শ্বাস ফেলে।

 

মরণ মেনে মোদের

দুঃখ করেন ত্রাণ

দুখীর তরে প্রভু

দিলেন জীবন দান।

 

জয় জয় দাও প্রভুর

নামগানে তাঁর মাতি,

আনন্দে দাও ভরে

তাঁর এই জন্মতিথি!…

 

আর, এক ‘দল’ যখন এই পৌত্তলিক ছড়ার তালে নাচে আর গায়, তখন অন্য দল সব শব্দ ডুবিয়ে দিয়ে সোল্লাসে গেয়ে ওঠে:

 

ভুলো না সেই কথা

রাজা, রাখাল, ডান্‌

প্রভুর ডাবাখানা

প্রণাম করে যান!

 

গম্ গম্ করে বেজে ওঠে ঢাক, আর ছেলেদের গানের সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে নলখাগড়ার কোন একটা বাঁশি হাস্যকরভাবে বেজে ওঠে বিলাপের সুরে…

 

দুষ্ট রাজা হেরড

শিশুরে ভয় পায়,

রাজ্যের সব শিশুর

প্রাণ হরিলেন হায়।

 

কবেকার সে কথা

আমরা আছি বেঁচে, আজ হেরড গেছে মারা

প্রাণ যায় না কারো

হাঁস মুরগী ছাড়া।

 

গানের সোল্লাস ছন্দে আর চুপ করে থাকতে পারে না বড়োরাও; নোটা গাড়োয়ান কার্লো বাম্বোলা হেলেদুলে এগিয়ে যায় ছেলেদের দিকে, তারপর সকলের গলা ডুবিয়ে গেয়ে ওঠে গলা ছেড়ে; আর টক্টকে হয়ে ওঠে ওর মুখখানা:

 

দু:খে ভোলো সবে

ভাবনা আর নাই

মারী মড়ক কিছু

আর হবে না ভাই!

দেখো আকাশখানা

চাঁদের আলোয় ভরা

হোক আমাদের জীবন

উষ্ণ, উজল করা!…

 

ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেয়েদের গাঢ় চোখগুলো ঝিকঝিক করে স্বপ্নাতুরের মতো। বেড়ে ওঠে উল্লাস, অল জল করে মুখ চোখ। পরবের দিনের সেরা পোষাক-পরা তরুণীরা তরুণদের দিকে চেয়ে লাস্য ভরে হাসে। আকাশে মিলিয়ে আসে তারা। আর ওপরের কোন একটা জায়গা থেকে, ছাত কি কোনো একটা জানলা থেকে ভেসে আসে এক সপ্তমে ধরা অদৃশ্য সুরের ঝঙ্কার:

চাই আনন্দ, স্বাস্থ্য

তা হলেই সব ভালো।

পৃথিবীর সেরা গান হল শিশুর হাসি। সেই হাসিতে ক্রমেই ধ্বনিত হয়ে ওঠে ওই প্রাচীন গির্জাটা। ফিকে হয়ে আসে দ্বীপের ওপরকার আকাশ। ভোর হয়-হয়। আকাশের নীল অতলে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে তারা।

দ্বীপটার শ্যাম-কৃষ্ণ বাগিচার মধ্যে বালক দিয়ে ওঠে সোনালী কমলা, অতিকায় এক পেচকের চোখের মত অন্ধকার থেকে উঁকি দিতে থাকে হলুদ লেবুগুলো। কমলা গাছের শিখরে শিখরে হলদে-সবুজ কচি কচি কোরকগুলো আলো হয়ে ওঠে। রুপোর মতো ঝকঝক করে জলপাই গাছের পাতা, আর আঙুরলতার নগ্ন ঝালরগুলো কাঁপে।

উেজ্জ্বল গোলাপী কর্ণেশন ফুল আর সেজের লাল লাল শাখাগুচ্ছ হেসে ওঠে উঘার দিকে চেয়ে। প্রত্যুষের তাজা হাওয়ার সমুদ্রে লোনা ঝাপটার সঙ্গে মিশে ভেসে যায় নার্সিসাস ফুলের মদির সৌরভ।

দেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ বেড়ে ওঠে ক্রমশ; এ ঢেউ এখন স্বচ্ছ, তুষারের মতো শাদা তাদের ফেনা।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024