মরিয়ম সুলতানা
বাংলাদেশের সিলেট জেলায় যে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সেটি পুরোপুরি কাটতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগতে পারে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট জেলার সাত উপজেলায় আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমে আসায় নতুন করে পাহাড়ি ঢল আসছে না। যদি ফের অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হয়, তাহলে সিলেটের বন্যা কবলিত স্থানগুলোর পানি নামতে থাকবে।
“আরও তিনদিন ধরে যদি বৃষ্টিপাত কমে আসার ধারাবাহিকতা থাকে, তাহলে আশা করা যায়, আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মাঝে সিলেটের পানিগুলো নিম্নাঞ্চলে নেমে যাবে,” বলেন পানি উন্নয়ন বোর্ড-এর সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ।
মি. দাশ বিবিসিকে বলেন, এই বন্যার মূল কারণ চেরাপুঞ্জির টানা বৃষ্টি। তবে গত তিনদিন ধরে সিলেটের ও ভারতের চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাতের হার কমে আসছে।
সিলেট জেলা প্রশাসন বলছে, আকস্মিক বন্যার কারণে কয়েক হাজার বানভাসি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বিবিসিকে জানান, বন্যার শুরুতে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এখন তারা ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
তবে তারপরও বর্তমানে জেলার মোট ৫৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে তিন হাজার ৩৪২ জন আছেন।
এমনিতে এই বন্যায় প্রায় ছয় লাখ ১০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে বলে জানায় জেলা প্রশাসন।
২৯শে মে রাতে উজানের ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো প্লাবিত হয়ে যায়। তবে ৩০শে মে সকাল থেকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসায় নদীগুলোর পানি কমতে শুরু করেছে।
পাউবো’র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সুরমা নদীর কানাইঘাট ও সিলেট স্টেশন এবং কুশিয়ারা নদীর আমালশিদ ও শেউলা স্টেশনের পানি বিপদসীমার উপদ দিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, “বৃষ্টিপাত না হলে এটাও দ্রুত চলে যাবে। বন্যার শুরুতে প্রত্যেকটা নদীর পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছিলো।”
“এখন অধিকাংশ পয়েন্টের পানি বিপদসীমার নিচে নেমে এসেছে। শুধু সুরমাও কুশিয়ারার যে চারটি পয়েন্ট থেকে পানি বের হচ্ছে, সেখানে বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি বইছে।”
“তবে সেটাও খুব বেশি না। এক-দুই ইঞ্চি বা হাফ ইঞ্চি,” তিনি যোগ করেন।
বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বিবিসি’র সাথে কথা হয় সিলেটের স্থানীয় সাংবাদিক মঞ্জুর আহমেদের সঙ্গে। তিনিও বলেন যে সিলেটে এখন বৃষ্টি হচ্ছে না। সেখানের আকাশে এখন ঝকঝকে রোদ।
“কালকে সিলেটে বৃষ্টি হয় নাই। আজকেও হালকা থেমে বৃষ্টি হয়েছে। সবমিলিয়ে ধীরে ধীরে পানি নামছে। আর ওদিকেও (চেরাপুঞ্জিতে) যেহেতু বৃষ্টি হচ্ছে না, তাই নতুন করে আবার পাহাড়ি ঢল নামার এবং পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা নাই এখন,” তিনি বলেন।
সিলেট জেলার আরেকজন সাংবাদিক আজহার উদ্দিন শিমুলও বিবিসিকে জানান যে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। “আকাশে রোদ আছে, বৃষ্টি নাই। রাস্তাঘাটের পানি নেমে যাচ্ছে, মানুষ বাড়ি ফিরছে।”
তবে যেসব বানভাসি মানুষ এখনও বাড়ি ফিরতে পারেননি, বা যারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরকে সরকারি ও বেসরকারিভাবে শুকনা খাবার, রান্না করা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
সিলেটের যে সাতটি উপজেলা বন্যা কবলিত পড়েছে, সেগুলো হল- জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিয়ানিবাজার, জকিগঞ্জ, সিলেট সদর এবং ফেঞ্চুগঞ্জ। এসব উপজেলার কিছু কিছু এলাকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও পানি পুরোপুরি নামেনি এখনও।
শনিবার বেলা ১১টার দিকে মি. দাশ বলেন, “সিলেট সদরের পানিও বিপদসীমা থেকে সাত সেন্টিমিটার উপরে আছে। যে সব অঞ্চল আরও বেশি প্লাবিত হয়েছে, সেখানে এটি আরও বেশি।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড, আবহাওয়া অফিস, জেলা প্রশাসন এবং স্থানীয়রা, অন্যান্যবারের মতো এবারও সবাই বলছেন যে এই আকস্মিক বন্যার কারণ অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল।
মূলত, গত সপ্তাহের সোমবার, অর্থাৎ ২৭শে মে থেকে সিলেটে বৃষ্টি শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকে বৃহস্পতিবার, মানে ৩০শে মে পর্যন্ত। মে’র শেষ সপ্তাহেই আঘাত হেনেছিলো ঘূর্ণিঝড় রিমাল।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি বছরের মে মাসে শুধুমাত্র সিলেট জেলায় ৭৭৫ মিলিমিটার এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৭০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
সেইসাথে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৫৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তার আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৯৩ মিলিমিটার এবং তারও আগের ২৪ ঘণ্টায় হয়েছিলো ৬৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে চেরাপুঞ্জিতে।
এছাড়া, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌসুমী বায়ু আগে সেট হয়ে গেছে।
সাধারণত মৌসুমী বায়ু সেট হতে জুনের প্রথম সপ্তাহ, কখনও কখনও দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যায়।
আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বাতাসে জলীয় বাষ্প এমনিতেই বেশি ছিল। পাশাপাশি মৌসুমী বায়ুও সেট হয়ে গেছে। এ কারণে ওখানে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।”
“বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রি-মনসুন থেকে মনসুনে যাওয়ার সময়টা যদি আগে এসে যায়, তখন এমন ঘটনা বেশি ঘটে,” তিনি যোগ করেন।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সিলেট ও ভারতের মেঘালয়, এই দুই এলাকায় অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় সাধারণত।
এটিকে মি. ফারুক ব্যাখ্যা করেন এভাবে, “বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প গিয়ে ওখানে বাঁধা পায়। তারপর সেটি উপরে উঠে গিয়ে বজ্রমেঘ তৈরি করে এবং ওই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টি হয়।”
বাংলাদেশের বেশিরভাগ এলাকার তাপমাত্রা এখন ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে বিরাজ করছে। “কিন্তু তারপরও সবার একটা ভ্যাপসা গরম লাগছে। এর কারণ, জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি খুবই বেশি।”
আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতবছর সিলেটে মে মাসে মট ৩২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিলো। মৌলভীবাজারে হয়েছিলো ১৮৪ মিলিমিটার।
আর, ২০২২ সালের মে মাসে সিলেট জেলায় ৮৩৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিলো। শুধুমাত্র শ্রীমঙ্গলে হয়েছিলো ৬২৫ মিলিমিটার। ওই বছর চেরাপুঞ্জিতে ১০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিলো।
সাধারণত মে, জুন ও অগাস্ট মাসে সিলেটে বছরে তিন থেকে চারবার ছোট-বড় বন্যা হয়ে থাকে।
কিন্তু মে’র শেষভাবে এরকম বন্যা সিলেটে কখনও হয়নি। পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মি. দাশ বলেন, “২০২২ সালে এবং এবছরের এই সময়ে যেটা হয়েছে, তা রেকর্ডব্রেকিং। এরকম কখনও হয়নি।”
এবারের এই আকস্মিক বন্যাকে তিনি ‘আর্লি ফ্লাড’ হিসেবে সঙ্গায়িত করেছেন।
তিনি মনে করেন, ২০২২ সালে সিলেটে যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো, এবারের বন্যার ভবাবহতাও সেবারের থেকে বেশি বৈ কম না।
কারণ, “সুরমা নদীর যে স্থানে আমরা ওয়াটার লেভেল মাপি, তা কানাইঘাট। সেখানে ওয়াটার লেভেল ২০২২ সালে ছিল ১৭ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার। এবার সর্বোচ্চ হয়েছে ১৭ দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটার। অর্থাৎ, ২০২২ সালের বন্যার চেয়ে ৪২ সেন্টিমিটার উপরে,” তিনি ব্যাখ্যা করেন।
“পানির সমতলের কথা চিন্তা করলে অবশ্যই ২০২২ সালের চেয়ে এবার বেশি পানি এসেছে।”
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে্র জুনের মাঝামাঝি সময়ে সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে যে বন্যা হয়েছিলো, তাতে ওই দুই জেলায় প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো।
বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে প্রায় প্রতিবছর যে বন্যা হয়, তার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরও কয়েকটি কারণ দেখছেন গবেষকরা।
নদী গবেষকরা মনে করেন, এআকস্মিক বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদান কাজ করেছে।
তার মাঝে একটি হল নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। ওই অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারে না।
সেইসাথে, সিলেটসহ হাওর এলাকার অপরিকল্পিত উন্নয়নও এর পেছনে দায়ী।
২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বিবিসিকে বলেছিলেন, ”সিলেট বা সুনামগঞ্জ এলাকায় আগে ভূমি যেরকম ছিল, নদীতে নাব্যতা ছিল, এতো রাস্তাঘাট ছিল না বা স্থাপনা তৈরি হয়নি।”
“ফলে বন্যার পানি এখন নেমে যেতেও সময় লাগে। আগে হয়তো জলাভূমি, ডোবা থাকায় অনেক স্থানে বন্যার পানি থেকে যেতে পারতো। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেছিলেন, ”হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে।”
বিবিসি
Leave a Reply