প্রতীক মুখার্জ্জী
২০শে জুন ১৯৪৭।এখন যেটি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভবন,কলকাতার ইডেন উদ্যানের অদূরে অবস্থিত সেই ভবনে চলমান বঙ্গীয় আইনসভার অধিবেশনের দিকে সেইদিন তাকিয়ে ছিলেন বাংলা সহ গোটা ভারতের মানুষ।সেইদিনই স্বাধীন ভারতে বাংলার পথচলা কেমন হবে তা নির্ধারণ হতে যাচ্ছিল।তবে ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গের পরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব সহ সমগ্র বাংলার প্রতিবাদ,প্রচেষ্টার কারণে ১৯১১ সালে যে বিভক্ত বাংলা পুনরায় জোড়া লেগেছিল,বহু চেষ্টার পরেও ওইদিন সেই বাংলাকে অবিভক্ত রাখার শর্ত কিছুতেই পূরণ করা সম্ভব হলনা। যৌথ অধিবেশনের শুরুতেই ১২৬-৯০ ভোটে খারিজ হয়ে যায় অবিভক্ত বাংলার ভারত ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব।একইসঙ্গে নির্মূল হয়ে যায় বাংলার অবিভক্ত থাকার সমস্ত সম্ভাবনাও।বাংলার পশ্চিম অংশের বিধায়কদের ভোটের দ্বারা ৫৮-২১ ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে জন্ম নেয় স্বতন্ত্র পশ্চিমবঙ্গ।অপরদিকে বাংলার পূর্ব দিকের বিধায়কদের ভোটে পূর্ববঙ্গ এক নতুন সংবিধান সভার বা বলা ভালো পাকিস্তানের অংশ হয়।সেইসময় দীর্ঘ ও নিরবিচ্ছিন্ন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে জর্জরিত বাংলার পরিস্থিতি কিন্তু ১৯৪৬ সালের আগস্টে কলকাতার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস শুরু হবার আগে ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।আজাদ হিন্দ ফৌজের এক ক্যাপ্টেন রশিদ আলীর সাত বছরের কারাদণ্ডের সাজা ঘোষিত হবার পর সকলেই প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠেন।১৯৪৬ সালের কলকাতাই দেখেছে ফেব্রুয়ারি মাসে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রশিদ আলী দিবস পালন করতে।উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের সেই মিলনে আশঙ্কিত হয়েছিল কুচক্রীরা।রচিত হল এই মিলন ভেঙে দেওয়ার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।১৯৪৬ সালের ১৬ই আগস্ট থেকে কলকাতায় শুরু হল পাকিস্তানের দাবিতে,প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস নামে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা।কলকাতার পর রক্তলোভীদের নজর যায় বাংলারই নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের আবহে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই তখন তৈরি হয়েছে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের কালো মেঘ।তবে একে অপরের হরিহর আত্মা এই দুই সম্প্রদায়,বিদ্রোহী কবির ভাষায় একই বৃন্তের এই দুটি কুসুমকে অবিশ্বাসের মেঘ কি পুরোপুরি দূরে সরিয়ে দিতে পারে?সেইজন্যই শত দাঙ্গা-সংঘর্ষের মধ্যেও কোন কোন সময় দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই মিলেছে মনুষ্যত্বের পরিচয়।’৪৬ এর আগস্টে কলকাতায় হিন্দু মহল্লায় অবস্থিত মুসলমান পরিবারগুলিকে যেমন আগলে রেখেছিল হিন্দুরা তেমনই মুসলমান মহল্লায় অকস্মাৎ আটকে পড়া হিন্দু পথচারীকে পাহারা দিয়ে সুরক্ষিত জায়গায় পৌঁছে দিয়ে এসেছে জনৈক মুসলমান ব্যক্তি এমন নজিরও রয়েছে।কলকাতা দাঙ্গা চলাকালীন কলকাতাকে সমাজবিরোধীদের হাত থেকে রক্ষাকারীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব শ্রী গোপাল চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন কোনমতেই এই দাঙ্গাকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেবেন না তিনি তাঁর পক্ষ থেকে।তিনি এটিকে সৎ ও সমাজবিরোধীদের মধ্যেকার লড়াই হিসেবেই দেখেছিলেন।তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যাই ঘটুক না কেন, অন্য সম্প্রদায়ের অস্ত্রবিহীন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ,মহিলা ও শিশুদের গায়ে দাঙ্গার আঁচ পড়তে দেওয়া যাবে না।দেশভাগের পরেও একাধিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় এরকম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ দেখা গিয়েছে বহুবার।১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর গঙ্গা,পদ্মা উভয় নদী দিয়েই বয়ে গেছে অনেক জল।কালক্রমে পূর্ববঙ্গ হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। তবে ভারত ও পূর্ববঙ্গের অন্তরাত্মার মধ্যেকার বিভাজন বোধহয় কোনদিনও সম্ভব নয়।তাই তো আয়ুব খানের কুখ্যাত সামরিক শাসন চলাকালীন যখন পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করে বসলো তখনও ভারত পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ সম্প্রসারণ করতে ইচ্ছুক ছিল না।মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেই যুদ্ধকে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল।আবার পূর্ব পাকিস্তান থেকেও বিবৃত জারি করা হয় যে ঢাকার সঙ্গে নয়া দিল্লির কোন বিরোধ নেই।পূর্ব পাকিস্তানের নিপীড়িত বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের দ্বারা সংঘটিত নানান অত্যাচার সহ্য করে,গণ অভ্যুত্থান পেরিয়ে,নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা দেখে নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে জন্ম দিয়েছে আজকের বাংলাদেশের।দেশভাগ,পাকিস্তান আমলও দুই বাংলার আত্মিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হবার পর ভারত ও বাংলাদেশের সেই আত্মিক সম্পর্কই নিল এক নতুন মোড়।রক্তের অক্ষরে রচিত হল ভারত ও বাংলাদেশের অমলিন বন্ধুত্বের,সংগ্রামের বিজয়গাথা।দশকের পর দশক কেটে গেছে।একসময়ে আশঙ্কা করা হয়েছিল পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানকে ছাড়া কতদিন পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে?সেই আশঙ্কাকে অবান্তর প্রমান করে,একসময়ের দারিদ্রপীড়িত বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে।হয়ে উঠেছে সারা বিশ্বের অনুন্নত,অভাবের সঙ্গে সংগ্রামরত দেশগুলির কাছে রোলমডেল।বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে যা শুধু বাংলাদেশের নয়,অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে ভারতের কাছেও এক সুখকর বিষয়।তবে ‘৪৬ এ যে বিষাক্ত মানসিকতা দুই সম্প্রদায়কে পরস্পরের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল,সেই মানসিকতাবিশিষ্ট ষড়যন্ত্রীরা আজও হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে।তারা আজ ধরেছে নতুন ভেক।
দুই সম্প্রদায়কে লড়িয়ে দেওয়ার বদলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার স্বাভাবিক সম্পর্ককে নষ্ট করাতে এখন উদ্যোগী হয়েছে তারা।আর বরাবরের মত তাদের এই কুকর্মের অন্যতম একটি প্রধান হাতিয়ার হল গুজব ছড়ানো।আমরা দেখেছি পাকিস্তান আমলে ‘কলকাতায় ফজলুল হককে হত্যা করা হয়েছে’এই গুজবে পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক হত্যালীলা চালানো হয়েছিল।চিরকাল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঊর্ধে থাকা এক সিংহ হৃদয় ব্যক্তিত্ব ফজলুল হক কলকাতার কাজ অসমাপ্ত রেখেই ছুটে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে,এই হত্যালীলা বন্ধ করার অভিপ্রায়ে।আবার ১৯৭১ সালেও মহান মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করতে দেখা গেছে কুচক্রীদের।অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ সম্পর্কে রটানো হয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দা হওয়ার মিথ্যা গুজব।অথচ বাস্তবে দেখা গেল ভারতের কোনরকম আগ্রাসনের ইচ্ছা বিন্দুমাত্র নেই।ভারত তাদের উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে।তবে বাংলাদেশের উপর সেদেশের মুক্তিকামী জনগণেরই অধিকার রয়েছে বলে মনে করেছিল তারা। আবার বর্তমানে ভিত্তিহীন কিছু তথ্য সামনে এনে পুনরায় ভারত-বিরোধিতায় বাংলাদেশের জনগণকে ব্যস্ত রাখতে চাইছেন জনৈক।কিন্তু কেউ যেন এটা মনে না করে যে ভুলের পর ভুল ব্যাখ্যা দিলেই ভারত সম্পর্কে বাংলাদেশের সরল,সৎ মানুষদের মনে দীর্ঘদিন ধরে ভুল ধারণা পোষণ করানো সম্ভব হবে।বাংলাদেশের মানুষ কার হাতে বাংলাদেশের শাসনভার তুলে দিতে চান সেটি একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।অন্য কোন দেশের এই বিষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করার অধিকারই নেই।যদি এরকম কোন কাল্পনিক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে কোন দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে ‘গোঁসা’দেখাচ্ছে,তার জন্য ভারতকে দায়ী করা হবে ভীষণই হাস্যকর।কেননা কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা ভারতের অভিরুচি নয়।উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে মালদ্বীপের কথা।মালদ্বীপে যে সরকার বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে তারা যে খুব ‘ভারত-বন্ধু’এমনটা নয়।তবে সেইদেশে কারা নির্বাচিত হবেন সেক্ষেত্রে ভারতের কোন ভুমিকা ছিল না।অন্য রাষ্ট্রের নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ যেমন হাস্যকর ঠিক তেমনই হাস্যকর ‘বাংলাদেশের ভুখন্ড থেকে খুলনা ও যশোর জেলা ভারত দখল করে নেবে’ এই ধরনের কাল্পনিক অভিযোগ।সামাজিক মাধ্যমে কোন লেখার অংশবিশেষ তুলে ধরে সেটিকে নিজের মনোমত ব্যাখ্যা করার দুরভিসন্ধি অত্যন্ত নিন্দাজনক।
শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের কাছাকাছি চীনের উপস্থিতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য যতই চিন্তার হোক না কেন তার জন্য যদি পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপে কোন পরিবর্তন আসে তা হবে একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়।বাংলাদেশ বা অন্য কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের এই বিষয়ে যোগসূত্র খুঁজে বের করা অর্থহীন।১৯৪৭ সালের ১৭ই আগস্ট সীমানা কমিশনের যে চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল তাকে আমরা মেনে নিয়েছি।তাই এই ধরণের অভিযোগ যে শুধুমাত্র ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বে চির ধরানোর উদ্দেশ্যেই করা তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।ভারত মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা করে।আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষও বন্ধুত্ব এখনকার মত অটুটই রেখে যাবে।সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে আলোচিত ভারতীয় পণ্য বয়কটের আন্দোলন নিয়ে বিশেষ কিছুই বলার নেই।এর জন্য বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সম্মান একচুলও কমে না।বাংলাদেশের মানুষ কোন পণ্য কিনবেন সেই সিদ্ধান্ত তাঁদের।জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী একদিন গ্রাম স্বরাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন গোটা ভারতকে।আর সেই মহাত্মা গান্ধীর দেশ ভারত কেনই বা বাংলাদেশের একাংশের পণ্য বয়কট আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে?বাংলাদেশ যদি অন্য দেশের পণ্যের বদলে নিজেদের পণ্য ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে তাতে তো ভারতের খুশিই হবার কথা।তবে ভারতের প্রতি বিদ্বেষের বশবর্তী না হয়ে বরঞ্চ নিজ দেশকে স্বাবলম্বী করে তুলতে যদি বয়কটকারীরা অন্য দেশের পণ্যের বদলে বাংলাদেশের পণ্য কেনেন তাতেই সবার মঙ্গল।আসলে বিদ্বেষ দিয়ে কেউ কখনো জয়ী হতে পারে না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-সকলকেই মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল নানান সময়ে।কেউই তাতে সফল হননি।কেউ হয়তো ভাবছে পণ্য বয়কটের নামে জনগণকে উস্কে দিলেই বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে ভারতকে মুছে ফেলতে সে সক্ষম হবে।আবার ভারত, বাংলাদেশের একাংশের মধ্যে দেশীয় পন্য কেনার ঝোঁক দেখে খুশিই হচ্ছে এই ভেবে যে বাংলাদেশ আরও বেশি করে স্বাবলম্বী হচ্ছে।ভারত যে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু এই ঘটনাই তার প্রমান।তাই প্ররোচনায়, গুজবে কান না দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শুধুমাত্র নিজের দেশকেই উন্নততর করার প্রয়াস চালাবেন, তাও আবার ভারতের বন্ধুত্বের হাত শক্তভাবে ধরে রেখে এটিই সকলের বিশ্বাস।
লেখক- প্রতীক মুখার্জ্জী।ঠিকানা- ১৯/১ শিবতলা লেন,পোস্ট অফিস- মাহেশ,থানা-শ্রীরামপুর,জেলা-হুগলি,পশ্চিমবঙ্গ।
Leave a Reply