ড. মুর্শিদা বিন্তে রহমান
পাকিস্তানী শোষণের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ সংগঠন করেছিল বাংলাদেশের সিভিল সমাজ। বলা যায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের রূপকার এই সিভিল সমাজের প্রতিনিধিরা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামেরও নেতৃত্ব দিয়েছে এই সিভিল সমাজ। তাহলে বর্তমান বাংলাদেশে সেই সিভিল সমাজ কোথায়? যদি প্রশ্ন করা হয় – সিভিল সমাজ কি শুধু আন্দোলনই সংগঠন করে? বিদ্যমান সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলাই কি একটি রাষ্ট্রের সিভিল সমাজের একমাত্র কর্তব্য? বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি সরকার পরিচালনা করছে, তাহলে তো সিভিল সমাজ স্তব্ধ থাকবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?
বস্তুত, সিভিল সমাজের কার্যক্রম রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নের অবদান রাখে, জীবনযাত্রার মান উন্নত করে এবং জনসংখ্যার বিভিন্ন অংশের কন্ঠস্বরকে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় যেন শোনা এবং বিবেচনা করা হয় তা নিশ্চিত করে। আরেকটু স্পষ্ট করে বলতে গেলে সিভিল সমাজের অন্যতম কার্যক্রম হলো ১। রাষ্ট্রের মানবাধিকার, পরিবেশ এবং সামাজিক ন্যায় বিচার রক্ষা করে এমন নীতি এবং আইন প্রচার করা; ২। নীতিগত সিদ্ধান্ত , এবং বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে লিয়াজো করা; ৩। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং আবসনের মতো সামাজিক পরিসেবাগুলো প্রদান করা; ৪। সমাজের উন্নয়ন এবং দারিদ্র বিমোচনের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা; ৫। স্বচ্ছতা ও জবাবাদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকারি কর্মকান্ড ও নীতি পর্যবেক্ষণ করা; ৬। সরকারি কর্মক্ষমতা, দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করা; ৭। সমাজের সদস্যদের এবং অন্যান্য সংস্থার দক্ষতা এবং ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ এবং সংস্থান প্রদান করা; ৮। শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন; ৯। পরিবেশ সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারাভিযানের আয়োজন করা; ১০। নাগরিকদের তাদের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করা; ১১। সম্প্রদায় পর্যায়ে, বিরোধের মধ্যস্থতা এবং পুনর্মিলন প্রচার করা; ১২। সংঘাত পরবর্তী এলাকায় শান্তি বিনির্মাণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা; ১৩। ভোটদান, জনসাধারণের পরামর্শ এবং নাগরিক কার্যক্রমের মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রণকে উৎসাহিত করা; ১৪। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা জন্য কমিউনিটি মিটিং, ফোরাম এবং কর্মশালার আয়োজন করা; ১৫। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বৈচিত্র সংরক্ষণ ও প্রচার করা; ১৬। সম্প্রদায়ের চেতনা এবং সামাজিক সংহতি বৃদ্ধির জন্য খেলাধুলা, শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা; ১৭। সংরক্ষণ প্রকল্পে নিযুক্ত হওয়া এবং টেকসই উন্নয়নের পক্ষে সমর্থন করা; ১৮। তৃণমূল উদ্যোগের মাধ্যমে দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির মতো সমস্যাগুলোর সমাধান করা ইত্যাদি।
একটি রাষ্ট্রের সিভিল সমাজের উপর্যুক্ত কার্যক্রম চলমান থাকার বিবেচ্য দিক থাকলে বাংলাদেশে বর্তমানে সিভিল সমাজের অস্তিত্ব কোথায় তা বোঝা অসম্ভব নয়। শুরুতেই বলতে হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের মূলনীতিতে যে পরিবর্তন এসেছিল তা আজও সংশোধন করা হয়নি। আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে পারিনি। দেশকে আপন পরিচয়ে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সিভিল সমাজের কোনো কন্ঠস্বর নেই। এরপর বলা যায়, রাষ্ট্রের নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করতে সিভিল সমাজের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সামরিক – বেসামরিক আমলাতন্ত্র যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে তার ফলে সিভিল সমাজের কথা বলার কোনো স্থান নেই।
আবার অন্যদিকে সিভিল সমাজের প্রতিনিধিরাও সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগীর রূপ ধারণ করেছেন। ফলে, আমলাতন্ত্রের সঙ্গে তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। ‘আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য’ হলো পাকিস্তানী মানস। বঙ্গবন্ধু এর বিপরীতে বাংলাদেশের সিভিল সমাজের প্রতিনিধিত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তাঁর সংগ্রামই ছিল আমলাতন্ত্রের আধিপত্য বিরোধী। কিন্তু আজ আমরা বিষ্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরকারই বাংলাদেশের সিভিল সমাজের মেরুদন্ড- ভেঙ্গে দিয়ে আমলা নির্ভর রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করেছে।
বলা হয়, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’, আর শিক্ষকরাই এই সিভিল সমাজের অন্যতম প্রতিনিধি। রাষ্ট্রের তরুণ সমাজকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে তারা সর্বদা নিয়োজিত থাকেন। যুগ যুগ ধরে এই তরুণরাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ কোনদিকে? প্রাথমিক থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কোথাও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়নি। শিক্ষার মানকে উন্নত করতে গ্রহণ করা হয়নি কোনো সুনির্দিষ্ট ও দৃঢ় পরিকল্পনা। আমলা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে দেশ- বিদেশে তাদের নানারকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে শিক্ষার মানোন্নায়নের জন্য শিক্ষকদের মানসম্মত কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষাখাত সবচেয়ে অবহেলিত খাত হিসেবে বিবেচিত।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি হাস্যকর ব্যবস্থায় পরিণত করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে চলে নানা হাস্যকর ট্রল। নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু যে কারিকুলাম শিক্ষকরাই বোঝেন না তা তারা ছাত্রদের বোঝাবেন কী করে? অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষার অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। দেশব্যাপী অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেগুলোতে নিয়োগ দেয় হচ্ছে বিভিন্ন পদে শিক্ষকদের। এসকল শিক্ষকদের মান নিশ্চিতের দায়িত্ব কার? ভিসি মহোদয়গণ তাদের নির্দিষ্ট মেয়াদকালে ক্যাম্পাস শান্ত এবং বাহ্যিক উন্নয়ন দেখাতে দেখাতেই ব্যস্ত থাকেন। কোয়ালিটি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নে তারা কার্যত কিছু করতে পারেন কি? সুযোগে শিক্ষকরা শিক্ষকতার সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়ে কেউ আজ ব্যবসায়ী, কেউ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট-টাইমার আর কেউবা সরকারি প্রজেক্টে ব্যস্ত। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সকল শিক্ষকই এমন নন। তবে তারা কোনঠাসা। নীতিহীনরা সম্প্রদায়গত স্বার্থে সব যুগেই একদল একতাবদ্ধ থাকে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় আরেক চিত্র। কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলোর শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্ব র্যাংকিংকে সামনে রেখে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবলিকের চেয়ে ভালো কৌশল অবলম্বন করছে। কিন্তু কৌশল তো কৌশলই, তা শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক মান উন্নয়নে কোনো অবদান রাখে না। একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্য যেখানে তার বৃহত্তর আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে, যা ব্যক্তি উন্নয়ন এবং সামষ্টিক অগ্রগতি উভয়কেই উৎসাহিত করে সেখানে প্রাইভেট বিশ্ব বিদ্যালয়গুলো শিক্ষাকে শুধুই বিপণনযোগ্য পণ্য হিসেবে বিবেচনা করছে। অর্থাৎ শিক্ষা তাদের কাছে এমন একটি পণ্য যা একটি বাজারের মধ্যে কেনা, বিক্রি এবং ব্যবসা করা যায়। এই দৃষ্টিকোণ শিক্ষার অর্থনৈতিক মূল্য এবং ছাত্রদের (ভোক্তা) এবং নিয়োগকর্তাদের (বাজারের চাহিদা) চাহিদা পূরণে এর ভূমিকার ওপর জোর দেয়। সেক্ষেত্রে পেছনে পড়ে থাকল আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার কাছে জাতীয় স্বার্থ। এভাবেই বাংলাদেশে সিভিল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী বৃহৎ এই অংশ আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। রাষ্ট্র ও সমাজকে গড়ে তোলার মতো মনোভাব তাদের মাঝে অনুপস্থিত। তাই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সিভিল সমাজের বিপরীতে আমলাতন্ত্র আজ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতায় শিক্ষকদের পাশাপাশি তরুণ ছাত্র সমাজও আজ দিশাহীন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণ সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একটি বড় অংশ আছে যারা প্রকৃত শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই সীমিত এবং মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানী সংস্কৃতি দ্বারা অধিকতর প্রভাবিত। অথচ, ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের ওপর ইসরাইল বাহিনীর পৈশাচিক গণহত্যার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের তরুণরা যখন রাস্তায় তখন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ তো বটেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সরব তথাকথিত ইসলামী মতাদর্শীরাও রাস্তায় তাদের সরব উপস্থিতি প্রদর্শন করতে ব্যর্থ। তাদের চেতনা বেশি বিচ্ছুরিত হয় ভারত বিরোধীতা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধীতায়। মুসলিম বিশ্বের অধিকার রক্ষায় সৌদি আরব সরকারের নীতির বিরোধীতায় তাদের কোনো অবস্থান দেখা যায় না। অন্যদিকে ১৯৭৫ সালের পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী ভাবাদর্শীরা বাংলাদেশ পরিচালনা করায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জাতীয় স্বার্থ ও সংস্কৃতির বিষয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছিল তা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের ক্ষেত্রে উত্তোরণ করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রের ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে বা বোঝাতে সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে একটি কোর্স চালু করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই ইতিহাস পড়াবেন কারা? বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইতিহাস কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের পরিস্থিতি কি? শিক্ষক যদি পাকিস্তানী মানসের হন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কোন দিকটা তারা ছাত্রদের পড়াবেন? তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলবেন না ‘গৃহযুদ্ধ’ বলবেন? ছাত্রদের মানসপটে বাংলাদেশকে কোন আদর্শের রাষ্ট্র হিসেবে তিনি পরিচয় করিয়ে দেবেন? অবশ্য সরকার কী চায় যে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঠিক চর্র্চা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হোক সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
সরকারের কর্মপরিকল্পনা মূল্যায়ন করলে তা আমাদের ব্যথিত করে। জাতীয় ইতিহাস চর্চায় সরকার চরম অবহেলার পরিচয় দিয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোন মতাদর্শের লোক এগিয়ে আছে তা মনিটরিং করা কী সরকার প্রয়োজন বলে মনে করেছে? হয়তো সরকারই চায় প্রকৃত ইতিহাস মুছে যাক, ‘হাইব্রিড’ সংস্কৃতি উন্নতিলাভ করুক। কিন্তু যে জাতি নিজের ইতিহাস ভুলে যেতে চাইবে তার আত্মপরিচয়ের সংকটই দৃঢ় হয়ে উঠবে। সবকিছুকে উপেক্ষা করে ক্ষমতায় টিকে থাকাটাকেই যদি সরকার বড় দিক হিসেবে বিবেচনা করে তাহলে ইতিহাসের পাতায় তারা সেভাবেই মূল্যায়িত হবেন। অবশ্য, তারা ভাবতে পারেন মৃত্যুর পর তারা কীভাবে মূল্যায়িত হলেন তা ভাববার বিষয় না, আমৃত্যু ক্ষমতা ভোগ করে যাওয়াটাই শ্রেয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ এমনই পরিস্থিতির আভাস দেয়। এমন হাজারো দিক রয়েছে, যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি দৃঢ় ও মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়নে সরকার কতটা উদাসীন। ফলে তরুণ সমাজও আজ রাজনীতিবিদদের মতো ‘হাইব্রিড’ সংস্কৃতিতে নষ্ট। সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে জাতীয় স্বার্থ সেখানে তুচ্ছ। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রদের মধ্যে বর্তমানে একজনও বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, প্রগতিশীলতা তাদের আকর্ষণ করে না। বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীলতার কতটা বাড়াবাড়ি চলছে সে বিষয়টির ব্যাখ্যা নাই দিলাম। সিভিল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে এখানেই ছাত্র সমাজের আজ বড় ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়।
রাজনীতিবিদরাও সিভিল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। এক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদগণ বর্তমানে কেন রাজনীতি করেন? তাদের রাজনীতির উদ্দেশ্য কী? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা শুধুমাত্র সরকার দলীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতে পারে না। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে রাষ্ট্রের আদর্শ অনুসারে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সিভিল সমাজের মুখ্য প্রতিনিধি হিসেবে জনগণের স্বার্থের পক্ষে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশ বিশ্বের এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে দেশের স্বাধীনতার পক্ষের ও বিপক্ষের রাজনৈতিক মতাদর্শের দল ও মানুষ সহাবস্থানে আছে। নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের আদর্শের বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন নয়। দীর্ঘদিন একটি দল ক্ষমতায় থাকায় কার্যত ‘হাইব্রিড’ সংস্কৃতির উদ্ভব হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তি মিলে মিশে একাকার। আদর্শ বলে রাজনীতিতে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আর বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় যেহেতু জনগণের আস্থা নেই, আপামর জনগোষ্ঠী যেখানে বিশ্বাস করে প্রশাসন দ্বারা নির্বাচন ম্যাকানিজম করা হয় সেহেতু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রতিও জনগণের আস্থা নেই। সম্প্রতি ঝিনাইদহ-৪ আসনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আনোয়ারুল আজিমের হত্যার ঘটনার পর জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে জনগণ বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের নীতিহীনতার দিকটি আরো স্পষ্টভাবে অনুধাবন করেছে। আর নির্বাচন যেহেতু জনগণ বিবর্জিত এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে তাই আমলারাও রাজনীতিবিদদের তেমন সমীহ করেন না। রাজনীতিবিদরা আজ ‘গৃহপালিত নেতা’য় পরিণত হয়েছেন। তাদের মূল্যবোধ, আদর্শ, বিবেচনা সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। দেশগড়ার প্রত্যয় তাদের মাঝে নেই, তাই কোন ব্যবস্থা এলো আর কোন ব্যবস্থা চলে গেলো তাতে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
আবার যেখানে ব্যবসায়ী নির্ভর রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থের পক্ষে আওয়াজ তোলার কণ্ঠ থাকে না এটাই স্বাভাবিক। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী থেকে আরম্ভ করে বাজারের সকল পণ্য লাগামহীন ও অযৌক্তিকভাবে বেড়ে চলেছে, কিন্তু এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কোনো কণ্ঠস্বর নেই ,নেই কোনো নাটক, গান, সিনেমা কিংবা সম্মিলন।
সিভিল সমাজের আরেকটি অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো সংবাদপত্র। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক সংবাদ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসার হয়েছে। কর্মসংস্থান হয়েছে শতশত সাংবাদিকের। প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রের সংকট মোকাবেলায় কিংবা প্রকৃত সত্য তুলে ধরে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অবদান রাখতে তারা কতটুকু সক্ষম হয়েছেন? মিডিয়া অনেক সেনসেটিভ মাধ্যম। জনমতকে প্রভাবিত করতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি অনেক নেতিবাচক ভূমিকাও আমরা প্রত্যক্ষ করি। সাম্প্রতিক সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে মিডিয়া একজন সম্মানিত শিক্ষককে যেভাবে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে তা অত্যন্ত নেতিবাচক ভূমিকার পরিচায়ক। মিডিয়ার এরূপ হঠকারিতা ১৯৭৪ সালে বাসন্তীকে জাল পড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে আমরা দেখেছি, আবার ২০০৬ সালে পিলখানা ট্রাজিডির সময় হত্যাকারী বিডিআরদের পক্ষে সহমর্মিতা যোগাতেও আমরা দেখেছি। মিডিয়া ট্রায়ালের নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষককে নিয়ে (দেশের নামী-দামী চ্যানেলগুলোতে) যা করা হয়েছে তা দেশের সংবাদ মাধ্যমের চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় বহন করে। দেশের প্রকৃত সংকট দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে তারা ব্যর্থ। শত শত সাংবাদিক তাহলে সমাজের, রাষ্ট্রের কী উপকারে আসছে? সিভিল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে তারা কী ভূমিকা পালন করছে?
এভাবে শুধু শিক্ষক, রাজনীতিবিদ কিংবা সাংবাদিক নন সিভিল সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্র আজ বাংলাদেশে স্থবির হয়ে পড়েছে। তাদের কোনো অংশের কার্যত অবস্থান বা আওয়াজ কোথাও নেই। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপির বৃদ্ধি দিয়ে দেশ অগ্রসর হতে পারে না। তরুণ সমাজ ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক কিংবা ব্যবসায়ী সকলেই আজ লক্ষ্যহীন। সম্প্রদায়গতভাবে সামষ্টিক উন্নয়নে তারা কোনো কার্যক্রমে নেই। দেশে রাজনৈতিক কোনো আন্দোলন বা অস্থিরতা নেই বটে, কিন্তু তা কী কোনো পরিস্থিতির শুভদিকের ইঙ্গিত করছে? মোটেই না। সুষ্ঠু রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলতে এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরকার চরমভাবে উদাসীন। আর সিভিল সমাজের এই প্রাণহীনতা দেশকে বহুদূরে ঠেলে দিয়েছে। সহসা এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে যে দলকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সিভিল সমাজের আন্দোলন আলোর মুখ দেখেছিল সেই দলটিই আজ সিভিল সমাজের বিপরীতে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো শিক্ষার ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব না রেখে বিভিন্ন নীতি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজ যে দেশে অবহেলিত সে দেশের উন্নতি কি শুধু কংক্রিটের কাঠামো দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে? সিভিল সমাজের স্তব্ধতা রাষ্ট্রের উন্নয়নকে দৃঢ় রূপ দেবে কি ?
ড. মুর্শিদা বিন্তে রহমান
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান
ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply