সুমন চট্টোপাধ্যায়
আজ আমি কতকটা স্বতোপ্রণোদিত হয়েই যূপকাষ্ঠে গলা দিতে চলেছি। দেশের নয়টি সংস্থার বুথ ফেরত সমীক্ষা, তাকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের ‘হাম কিসমিসে কম নেহি’ আস্ফালন, বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস, বিজেপি বিরোধীদের আর্তনাদ, তাদের নানাবিধ সম্ভব-অসম্ভব ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব, গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে সব কিছু দেখা, শোনা, পরিশ্রমী অধ্যয়নের পরে এই অভাজনের উপসংহার, নরেন্দ্র মোদী উপর্যুপরি তৃতীয়বারের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, বিজেপি একাই গরিষ্ঠতা পাচ্ছে এবং এন ডি এ জোট কম-বেশি পাঁচ বছর আগেকার অঙ্কের ধারেকাছেই ঘোরাফেরা করছে। এক কথায়, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে হতে চলেছে স্থিতাবস্থা না বদলানোর রায়।
ই ভি এম-এর বাক্স খোলার এক দিন আগে এমন একটা ঝুঁকি আমি নিচ্ছি কোন সাহসে? অকপটে বললে, এত দিনের আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়ার পাপ-স্খলন করতে। সেই মহাভ্রান্তিটি হোল আমরা যাকে সংসদের ভোটে বলে মনে করে থাকি তা আদতে রাজা নির্বচনের ভোট। মানে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ভোট। সেই জায়গাটিতে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী, বিরোধী শিবিরের নেতারা তাঁর কাছে এখনও লিলিপুট। এই সম্ভাব্য জয় অতএব প্রথমে রাজা নরেন্দ্রর জয়, তারপরে বিজেপির, সবশেষে এনডিএ-র।
তার মানে কী দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও মোদী-ম্যাজিকের একই রকম চুম্বক-আকর্ষণ ছিল? একেবারেই নয়। তার মানে কী এই যে বিরোধীরদের তোলা বিবিধ ইস্যু, যেমন অসহ্য সীমায় পৌঁছে যাওয়া বেকারি, লাগামছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কিংবা চোখে পড়ার মতো আর্থিক অসাম্য ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যার মোটেই কোনও প্রাসঙ্গিকতা ছিলনা? আলবাৎ ছিল। প্রাক নির্বাচনী বিবিধ জনসভায় বিরোধীরা যখন যে যাঁর মতো করে এই সব ইস্যু সামনে আনছিলেন তাঁরা কী জনতার স্বতস্ফূর্ত সাড়া দেখতে পাননি? অবশ্যই দেখেছিলেন। এই অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে অতএব বিরোধীরা যদি পাশা পাল্টে দেওয়ার সুখস্বপ্ন দেখে থাকেন, তাঁদের দোষ দেওয়া যাবে কী? না যাবেনা।
এদেশে ভোট নিয়ে যাঁরা সমীক্ষা চালান তাঁদের মধ্যে সিএসডিএস- লোকনীতির সমীক্ষাকেই আমার সবচেয়ে বৈজ্ঞানিক ও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। প্রতিটি লোকসভা ভোটের আগে ও পরে তাঁরা দেশজুড়ে নিজেদের সমীক্ষা চালান, তারপরে সেই সমীক্ষার ফলাফল, স্যাম্পল সাইজ, প্রশ্নমালা, সব কিছুই নিজেদের ওয়েব সাইটে তুলে দেন। স্বচ্ছভাবে এই কাজটি অন্য কোনও সংস্থা করেনা, সেই কারণেই তাদের সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে অনেক সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ওঠে।
এবারের লোকসভা ভোটের আগে সিএসডিসের সমীক্ষায় পরিষ্কার ধরা পড়েছিল, বেকারি, দ্রব্যমূল্য ইত্যাদি নিয়ে জনতা বেশ ক্ষুব্ধ। যেমন মোদী সরকারের পূর্বতন পাঁচ বছরের কাজে কতটা সন্তুষ্ট এই প্রশ্নের জবাবে ৩৪ শতাংশ বলেছেন তাঁরা মোটামুটি সন্তুষ্ট, আর অসন্তুষ্টর সংখ্যা ৩৮.০৫ শতাংশ। ক্রমবর্ধমান বেকরির প্রশ্নে ৬২ শতাংশ বলেছেন পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে আর ১৮ শতাংশ বলেছেন হাতে কোনও কাজ নেই বলে তাঁরা বাড়িতেই বসে আছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য আম জনতা কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়কেই উল্লেখযোগ্য হারে দোষী ঠাওরাচ্ছেন।
মানুষের ক্ষোভ সবচেয়ে উচ্চকিত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রশ্নে। ৭০ শতাংশ বলেছেন তাঁদের দফারফা হয়ে যাচ্ছে। অযোধ্যার রাম মন্দিরে রামলালার বিগ্রহ স্থাপন নিয়েও মানুষের যে তেমন একটা মাথাব্যথা ছিলনা, সেই সত্যও প্রতিফলিত এই সমীক্ষায়। ৫৫ শতাংশের স্পষ্ট রায় দুর্নীতিও বাড়ছে ক্রমাগত। সামগ্রিকভাবে এই সমীক্ষা থেকে পরিষ্কার সাধারণ ভারতবাসীর জীবন বিপর্যস্ত, তাঁদের দৈনন্দিন সমস্যা আর বোঝার ভারও ঊর্ধ্বমুখী। অতএব কংগ্রেস ও ইন্ডিয়া জোটে তাদের সহযোগী দলগুলি ভোটের ইস্যু সঠিকভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাঁদের অঙ্কে গোলটা বেধেছিল অন্য জায়গায়। কোথায় তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিতও আছে সি এস ডি এসের সমীক্ষায়। এত সমস্যার ভারে ন্যুব্জ জনতাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তাঁরা এতৎসত্ত্বেও কোন দলকে ভোট দেবেন ৩৯ শতাংশ বলেছেন বিজেপি আর মাত্র ২০ শতাংশ বলেছেন কংগ্রেস। তার মানে আমরা খারাপ আছি কিন্তু শাসকের ওপর আস্থা এখনও অটুট।যিনি মুশকিলের কারণ তিনিই আবার মুশকিল আসান। মনে হতে পারে এতো স্ববিরোধী কথা, কিন্তু জনচেতনা এখনও সেই পর্যায়ে উন্নীত হয়নি।
বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর দলের এই পার্থক্যটা রচনা করে দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী যাঁর বিস্ময়কর জনপ্রিয়তার গ্রাফ একটি বিন্দুও নীচে নামেনি। গত দশ বছর ধরে খুব যত্নে এবং সুনিপুনভাবে নিজের এই সুপারহিউম্যান ভাবমূর্তিটি মোদী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা নিয়ে বিরোধীদের সমালোচনা, শ্লেষ, বিদ্রূপ কোনও কিছুর ধার ধারেননি। বীরভোগ্যা বসুন্ধরায় জনতা কী চায় সেটা মোদীর চেয়ে ভালো কেউ বোঝেননা। তিনি জানেন যতদিন তাঁর নেতৃত্বের ওপর মানুষের এই আস্থা থাকবে ততদিন বাকি কোনও প্রতিকূলতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারবেনা। এজন্যই গত আড়াই দশক ধরে তিনি অপরাজেয়, প্রথম পনেরো বছর গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার পরে এক দশক দিল্লিতে।
সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্যাবিনেট ধাঁচের সরকারে প্রধানমন্ত্রীকে ‘ফার্স্ট অ্যামংগ দ্য ইকুয়ালস’ বলে গন্য করা হয়। অন্তত কেতাবে সেটাই লেখা আছে, রানীর নিজের দেশে সেটাই দস্তুর। এদেশে সেই ব্যবস্থায় প্রথম বিকৃতি ঘটে ইন্দিরা গান্ধির জমানায়, সেই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর অফিসে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করে। নরেন্দ্র মোদী সেই প্রবণতাকে এক অবিশ্বাস্য রকম উত্তুঙ্গ শিখরে নিয়ে গিয়েছেন। তাঁর দফতরের সবুজ সঙ্কেত না পেলে দিল্লিতে এখন গাছের পাতাও হাওয়ায় দুলতে ভয় পায়।
ইস্যুর চেয়ে ব্যক্তির গুরুত্ব বেশি হওয়াটা স্বাস্থ্যকর অথবা অভিপ্রেত কিনা সে বিতর্ক আলাদা। তবে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও টানা সাতশ বছর গোলামিতে অভ্যস্ত ভারতবাসী আজও প্রজা হয়ে থাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে, আধুনিক দেশের নাগরিক নয়। বস্তুত আজ পর্যন্ত সে প্রজা আর নাগরিকের মধ্যে তারতম্যটুকুও বুঝতে শেখেনি। ভক্তির দেশে ভক্ত হওয়া স্বভাবজাত, জীবনের সব ক্ষেত্রে ভক্তমন আরাধ্য খোঁজে। পেয়ে গেলে সহজে তার সেই ভক্তি চটেনা। প্রথমে নেহরু তারপরে ইন্দিরা সবশেষে মোদী পেরেছেন সেই আরাধ্যের স্তরে নিজেকে উন্নীত করতে। এই ক্ষমতা তিনি জন্মসূত্রে পাননি, মোদীর সবটাই উপার্জিত।
ভারতের সংবিধান রচনার ইতিহাস এবং সংবিধান পরিষদের কার্যবিবরণীর সামান্য তত্ত্ব-তালাশ করলেই দেখা যাবে স্বাধীন ভারত কী ধাঁচের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহন করবে তা নিয়ে কার্যত কোনও বিতর্কই হয়নি, ইংল্যান্ডের দৃষ্টান্তে সদা-অনুপ্রাণিত জওহরলাল নেহরু প্রায় একক প্রচেষ্টায় এমনকী গান্ধি, প্যাটেল ও গোড়ার দিকে আম্বেদকরের বিরুদ্ধ মনোভাবের তোয়াক্কা না করেই ওয়েস্টমিনস্টার মডেলে সাংবিধানিক শিলমোহর বসিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সময়ে সময়ে এই ব্যবস্থা হুবহু মেনে নেওয়া সঙ্গত হয়েছে কিনা সেই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে তবে জল বেশিদূর গড়ায়নি। কিন্তু ধীর অথচ প্রত্যয়ী পায়ে সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে আমরা নির্বাচনী রাজতন্ত্রে পৌঁছে গেলাম নাতা!
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক,সাবেক নির্বাহী সম্পাদক আনন্দবাজার পত্রিকা
Leave a Reply