স্বদেশ রায়
যে মুহূর্তে এ লেখা লিখছি এর অল্প কিছুক্ষণ পরেই বাজেট অধিবেশন শুরু হবে। তার কিছু ঘন্টা পার করে দিয়ে পেশ হবে বাজেট । তাই এটা ঠিক বাজেট নিয়ে লেখার সময় নয়। তাছাড়া জাতীয় বাজেট নিয়ে লিখতে হলে অনেক বিষয় লিখতে হয়। যেমন জ্বালানির দাম বাড়ানো ঠিক, কি ঠিক না। না বাড়ালে লাভ কোথায়। বাড়ালে আশু কার লাভ হচ্ছে। তেমনি কোন পন্যের ওপর শুল্ক বাড়ালে জাতি লাভবান হবে আর কোন পন্যের ওপর শুল্ক বাড়ালে কিছু মানুষ লাভবান হবে। বাজেট প্রনয়নে সরকার জনপ্রিয়তার দিকে তাকালে তার ফল ভালো না ভবিষ্যতের শক্তিশালী অর্থনীতির দিকে তাকালে ভালো। এমনকি এই বাজেট উপলক্ষ্য করে লেখা যায় সারা বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলো ভোটের রাজনীতির জন্যে যে ফিডিং অর্থনীতি চালু করেছে- এই ভাতার অর্থনীতি আসলে পপুলিস্ট রাজনীতির একটি কুফল; না, বাস্তবে দরিদ্রের সত্যি অর্থ উপকার হচ্ছে? এমনকি বতর্মান বিশ্বে যে প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে – পপুলিস্ট রাজনীতি থেকে সরে আসা উচিত কি উচিত না- এ বিষয় নিয়েও বাজেট ঘিরে লেখা যায়। আসলে এসব বাস্তব ও মৌলিক সমস্যার সমাধান ছাড়া বাজেট কতখানি কার্যকর হয় সব দেশের জন্যে- তাও বড় প্রশ্ন।
তবে এ সব কোন কিছুতে না গিয়ে তুলনামূলক কম তাপমাত্রার দিনে একটি ভিন্ন ধরনেরে ছোট্ট বাজেটের গল্প লেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। যে বাজেটগুলো প্রতি সপ্তাহে বা সপ্তাহে দুই তিনবার আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়। এমনকি প্রতি মুহূর্তেও সামনে আসে।
যেমন শুক্রবারের কাঁচা বাজারের ঢোকার মুখের গলি থেকেই একটা বাজেট শুরু হতে পারে। গলির মোড়েই পর পর কয়েকজন ডাবওয়লা। বাজার করতে আসা ব্যক্তিটি তাজা ডাবের দিকে তাকিয়ে দাম জিজ্ঞাসা করতেই বিক্রেতা জানালো, ছোটগুলো ১৫০ টাকা, বড় গুলো ১৮০ টাকা।
তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, কি বলেন আপনি গত সপ্তাহে তো বড় গুলোই ১৫০ টাকা বিক্রি করলেন, এ সপ্তাহে এই ছোট ডাব ১৫০ টাকা! বিক্রেতা জানিয়ে দিলো, এটাই দাম। এর থেকে কমানোর কোন সুযোগ নেই।
তখন সে মনে মনে একটু হিসাব করে নিলো, গত সপ্তাহে চারটে বড় ডাব নিয়েছিলো ৬০০ টাকায়। এ সপ্তাহে চারটে বড় ডাব নিলে ৭২০ টাকা। তিনটে নিলে ৪৫০ টাকা। গত সপ্তাহের ডাবের সাইজ অনুযায়ী ডাব নিলে খরচ বাড়ছে ১২০ টাকা। আর এ সপ্তাহে ডাবের সাইজ কমালে গত সপ্তাহের সমান টাকা খরচ হয়। প্রথমেই মনে করে তাহলে ডাবের সাইজ কমিয়ে খরচের হিসাব সমান রাখা যাক। পরক্ষনেই তার মনে হয়, ডাবের দাম যখন বেড়েছে তখন অন্য অনেক কিছুর দামও বাড়তে পারে। তাই ডাবের সাইজের সঙ্গে সঙ্গে একটি ডাবের সংখ্যাও কমিয়ে ফেলা ভালো। তাহলে ১৫০ টাকা হাতে থাকে। অন্য জিনিসের দাম বাড়লে খরচের একটা সামঞ্জস্য করা যাবে। তাছাড়া সপ্তাহে যখন সাতটা থেকে কমিয়ে এর আগে চারটেতে আনা হয়েছে ডাব সেখানে চারটের জায়গায় তিনটে করে ফেললে খুব বেশি ক্ষতি নেই।
ডাব তিনটেই রাখা হলো।
এবার ডানে বায়ে আর মুদির দোকানগুলোতে না তাকিয়ে সোজা আগে মাছ আর সবজি কেনার জন্যে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো।
মাছ তাকে ডাবের থেকে বেশি না হোক সমানই ধাক্কা দিলো- ভেটকি মাছ গত সপ্তাহে ৮শ টাকা কেজি কিনেছিলো। সেই পরিচিত মাছওয়ালা বলছে, আজ এক হাজার টাকার কম দেবার কোন উপায় নেই। দুই কেজির কিছু বেশি হয় এমন সাইজ নিলেও আড়াই হাজার টাকা আবার তিন কেজির কিছু বেশি হয় এমন সাইজ নিলে সাড়ে তিন হাজার টাকা। গত সপ্তাহে তিন কেজির কিছু বেশি সাইজটি নিয়েছিলো ২৭০০ টাকায়। ৮শ টাকা এখানে চলে যাচ্ছে। ডাব থেকে বেচেছিলো ১৫০ টাকা। এখানে সে মাছের সাইজ কমালো ঠিকই তার পরেও ২৮শ টাকা হয়ে গেলো। প্রথমে ডাব থেকে যেটা বাচিয়েছিলো তার থেকে চলে গেলো ভেটকি মাছে গত বাজারের তুলনায় একশ টাকা। তারপরেও মাছ কমে গেলো এক কেজি।
এভাবে মাছের বাজার, সবজির বাজার, মুরগির বাজার সব ছেড়ে সে যখন ফেরার পথে মুদির ওখানে ঢোকে তখন তাকে পুরো দুই হাজার টাকা বাকি রেখে আসতে হয়। বাজারে যে টাকা এনেছিলো তা দিয়ে হলো না। ঘাটতি পড়ে গেলো।
বাজার থেকে ফিরে একটু ক্লান্তি হচ্ছিলো তার- তাই সোফায় একটু নিজেকে এলিয়ে দিয়েছিলো। আর ওই অবস্থায় নিজেকে রেখে হাত দিয়ে সামনের টি টেবিলে সে গতকাল যে বিদ্যুত বিলটি পাথরের পেপার ওয়েট চাপা দিয়ে রেখেছিলো, সেটা হাতে নিয়ে চোখ বুলাতেই দেখতে পায়- গত মাসের বিল দেয়া হয়নি, ওটা ৫হাজার ৭০০ ছিলো- তার সঙ্গে এ মাসে যোগ হয়েছে ৬ হাজার ৫০০শ টাকা। নিজেই উঠে গিয়ে দুটো লাইট বন্ধ করে এসে আবার সোফার ওপর গা এলিয়ে দেয়।
কোভিডের আগে তার প্রমোশন হবার কথা ছিলো। কিন্তু কোভিডের পর থেকে কোম্পানি বলতে থাকে কোভিড যাক, তারপরে দেখা যাবে।
কোভিড যেতে যেতেই শুরু হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। কোম্পানি প্রথমে ইউেক্রেন যুদ্ধের কথা বলেনি। তারপরে সরকারের সুরে সুর মিলিয়ে না নিজের থেকে বলা শুরু করা করলো, কোভিড আর যুদ্ধ মিলে তার কোম্পানির অবস্থা খারাপ করে দিয়েছে। তারপরেও মনে একটা আশা ছিলো হয়তো দ্রুত এগুলো কেটে গেলে প্রমোশন হবে।
এরপরে কোথা থেকে হঠাৎ উড়ে এলো ডলার ক্রাইসিস। এখন তো সে নিজেই বুঝতে পারছে তার কোম্পানি কাঁচামাল ওইভাবে আমদানী করতে পারছে না। এলসি খুলতে পারছে না। ব্যাংক সাপোর্টও আগের মতো পাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো শুধু ডলার ক্রাইসিস বলছে না ফান্ড ক্রাইসিসও বলছে। সব মিলে কোম্পানির উৎপাদন কমে গেছে। রফতানিও কমেছে। এখন তো শুধু চেষ্টা কোম্পানির আয়- ব্যায় সমান সমান রাখা যায় কিনা? অন্তত ঘাটতিতে না যায়। তার ওপরে সে নিজেই জানে এ মাসেই ঈদ। এই ঈদে তাদের কোম্পানির মালিককে সবগুলো কোম্পানি মিলে বেতন দিতে হবে তিরিশ কোটির বেশি।
তাই কী যেন একটা ভেবে সে তার পুরানো এক বন্ধুকে ফোন করে। শুক্রবার। নামাজের প্রস্তুতির সময় হয়ে গেছে। ও প্রান্তে বন্ধুটি ব্যস্ত। কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারে। তাকেও নামাজে যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই সে কোন সময় নষ্ট না করে বলে, সে কিছুদিন আগে একটা কোম্পানিতে যে কিছু কনসালটেন্সির কথা বলেছিলো , তার কোন খোঁজ আছে কিনা? ও প্রান্ত থেকে উত্তর শুনে সে অনেকা নিস্পৃহভাবে ফোনটা রেখে দেয়। আর কিছুটা স্বগোক্তির মতোই তার গলা দিয়ে বের হয়ে আসে- এত ভালো কোম্পানিটা ঘাটতিতে চলে গেলো!
জুমার নামাজে যাবার প্রস্তুতির জন্যে সোফা থেকে উঠেতে উঠতে সে শুধু ভাবে কাঁচা বাজারে এই ঘাটতি আর না বাড়লে হয়। বিদ্যুতের বিল এখানেই থাকলে হয়। বাড়িভাড়া তো এক বছর পরে বাড়বে। বছর খানেক সময় সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। এই সব ঘাটতি আর সময় মিলিয়ে তাকে বিকেলের দিকে একটা বাজেট করতে হবে। এখন আর পাক্কা বাজেট ছাড়া চলা ঠিক হবে না।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply