শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:৪৩ পূর্বাহ্ন

বাজেটের কিছু অর্থ প্রতিবছর কেন আবার কোষাগারে ফেরত যায়?

  • Update Time : শনিবার, ৮ জুন, ২০২৪, ৯.৫৩ পিএম
ঢাকার কেরানীগঞ্জের মোল্লাবাজার ব্রিজ। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানো হলেও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ

তাফসীর বাবু

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি উপজেলায় কমলা ঘাট-আলদী বাজার খাল। পুরো খালটির দৈর্ঘ্য ১০ কি.মি।

২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে খালটি খননের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় পৌনে পাঁচ কোটি টাকা। কাজ শেষের সময় নির্ধারণ হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাস। কিন্তু কাজটি শেষ পর্যন্ত আর সমাপ্ত হয়নি। ফলে ফেরত যাচ্ছে প্রকল্পের প্রায় সোয়া কোটি টাকা।

খোঁজ নিতেই জানা গেলো, খাল খননের মতো কাজ শুষ্ক মৌসুমে শুরু এবং শেষ করতে হলেও এই খালের প্রকল্পে সেটা হয়নি। এখানে টেন্ডার হয়ে কার্যাদেশ পেতেই পেরিয়ে যায় অর্থবছরের প্রথম সাত মাস।

গেলো মার্চ মাসে যখন কাজ শুরু হয় ততদিনে শুষ্ক মৌসুম শেষের পথে।

ফলে কাজ শুরুর দেড় মাসের মাথায় শুরু হয় বৃষ্টি। খালে চলে আসে পানি। ফলে বন্ধ করে দিতে হয় খননকাজ। জানতে চাইলে টঙ্গিবাড়ি উপজেলা প্রকৌশলী শাহ মোয়াজ্জেম জানান, নতুন করে প্রকল্পের জন্য সময় আবেদন করে আগামী অর্থবছরে কাজ শেষ করবেন তারা।

“আসলে এখানে আমরা কার্যাদেশ পেয়েছি ৩০শে জানুয়ারি। সব প্রস্তুতি শেষ করতে একটু সময় লাগে। আমরা মার্চের প্রথম সপ্তাহে কাজ শুরু করি। কিন্তু দেড় মাস কাজের পরই বৃষ্টি এবং নদীর পানি খালে জমা হতে থাকে। একপর্যায়ে কাজ বন্ধ করে দিতে হয়। তবে এর মধ্যেই আমরা ৭০ শতাংশ কাজ শেষ করেছি।”

প্রকল্প পরিচালক দায় দিচ্ছেন, ঠিক সময়ে কাজ শুরু করতে না পারাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন অনেক প্রকল্পও আছে, যেগুলো যথাসময়ে শুরু হলেও কাজের দুর্বলতার কারণে ঠিক সময়ে শেষ হয় না।

যদিও বাংলাদেশে প্রতিবছরই বাজেটের আকার এবং বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়তে দেখা যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

তবে দেখা যায়, প্রতিবছর বিশেষত: উন্নয়ন বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ রাখা হয় তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশই অব্যবহৃত থেকে যায়।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা যাকে বাজেট বাস্তবায়নে দুর্বলতা হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে এমন অবস্থার কারণ কী?

বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন না হয়ে কেন ফেরত যায় প্রকল্পের অর্থ?

মেয়াদ বাড়ে, প্রকল্প শেষ হয় না

ঢাকার কেরানীগঞ্জের মোল্লাবাজার ব্রিজ।

ঢাকাকে মুন্সীগঞ্জের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে এই ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে।

কিন্তু শুরুর পরই প্রকল্পের কাজে ধীরগতি দেখা যায়। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়ালেও এর কাজ আর শেষ হয়নি। সর্বশেষ এর মেয়াদ ছিলো ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে।

কিন্তু তখনও মূল ব্রিজের বিশাল অংশের কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার। ফলে অদক্ষতার কারণে শেষ পর্যন্ত ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে এলজিইডি।

এখন এই প্রকল্প শেষ করতে নতুন করে টেন্ডার আহ্বানের উদ্যোগ নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে কাজ ঝুলে থাকার ফলে যেমন প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে, তেমনি ভোগান্তি বাড়ে সাধারণ মানুষের।

মোল্লাবাজার সেতু নিয়েও ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা।

মান্নান মিয়া নামে একজন সিএনজি চালক ক্ষুব্ধ স্বরে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, পদ্মা সেতুর আগে এই ব্রিজের কাজ শুরু হলেও এখনও শেষ হচ্ছে না।

“পদ্মা সেতুতে এখন গাড়ি চলছে। অথচ এটার কাজই আটকে আছে। এই ব্রিজ কি পদ্মা সেতুর চেয়ে বড়? কেন এতোদিন সময় লাগবে?”

কাছেই ছিলেন হামিদুর রহমান একজন প্রবীণ বাসিন্দা। তিনি জানাচ্ছেন, ব্রিজটা হলেও ঢাকায় যাতায়াত সহজ হয়ে যেতো তাদের জন্য।

“এখন অনেক ঘুরে ঢাকায় যেতে হয়। সময় লাগে বেশি, টাকা খরচও বেশি হয়। মালামাল বহন করতেও অসুবিধা। সবক্ষেত্রেই আমাদের এখন সমস্যা,” বলছিলেন মি. রহমান।

উন্নয়ন বাজেটের অর্থ ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৮০ শতাংশ

বাংলাদেশের বাজেটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গেলো অর্থবছরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, বাস্তবে খরচ হয়েছে তার চেয়ে কম।

২০২৩-২০২৪ বাজেটে বরাদ্দ ছিলো ২ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। খরচ হয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ অব্যবহৃত টাকার পরিমাণ ৫২ হাজার কোটি টাকা। যা মোট উন্নয়ন বাজেটের ৭৯ শতাংশ।

এর আগের ২০২১-২০২২ অর্থবছরেও উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ টাকা খরচ করা যায়নি। সেখানে বরাদ্দের ব্যয় ৮২ শতাংশ।

এর অর্থ হচ্ছে, টাকা খরচ এবং বাজেট বাস্তবায়ন -দুটোতেই দুর্বলতা আছে।

কেন অর্থ খরচ হচ্ছে না?

এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে।

এক. অর্থ ছাড়ে বিলম্ব। প্রকল্পের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হয় সেটা পেতে পেতেই কয়েকমাস গড়িয়ে যায়। ফলে কাজ শুরু হতে দেরি হয়।

দুই. প্রক্রিয়াগত জটিলতা। টেন্ডার আহ্বান করে কার্যাদেশ দেয়ার যে প্রক্রিয়া অনেক সময় সেখানেই দেরি হয়ে যায়।

তিন. ঠিকাদারের অদক্ষতা। কোন কোন প্রকল্পে এমনও হয় যে কার্যাদেশ যে প্রতিষ্ঠান পেয়েছে, সে প্রতিষ্ঠানের যথাযথ দক্ষতার অভাব রয়েছে।

চার. থোক বরাদ্দ কোথায়, কোন কাজে, কীভাবে ব্যবহার হবে অনেক সময় সংশ্লিষ্টরা সেটা বুঝে উঠতে পারেন না।

সবমিলিয়ে দেখা যায় প্রকল্প শতভাগ শেষ হচ্ছে না। অথবা বরাদ্দের টাকা ফেরত যাচ্ছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক বলেন, অর্থ ছাড় থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন সবখানেই কিছু সমস্যা থাকার কারণে বাজেট বাস্তবায়নে একধরণের দুর্বলতা দেখা যায়।

“অনেক সময় জুলাই-অগাস্টের টাকাটা পেতে পেতে কয়েকমাস পেরিয়ে যায়। ফলে একটা কোয়ার্টারের কাজটা কিন্তু করতে পারছে না তখন। ফলে বাকী ৯ মাসে কাজটা সম্পন্ন করার একটা চাপ থাকে। কেনা-কাটাতেও সময় লেগে যায়।” বলছিলেন ড. রুমানা হক।

একটা দেশে বাজেট শতভাগ বাস্তবায়ন হবে সেটা হয়ত সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে পুরো বাজেটের পরিকল্পনা এবং অর্থ বরাদ্দ হয়, দেশটিতে বাজেট বাস্তবায়নে দুর্বলতার পেছনে সেটা একটা বড় কারণ।

বিশেষ করে কোন এলাকায় জনসংখ্যা কেমন, কী চাহিদা আছে সে অনুযায়ী বাজেটে পরিকল্পনা থাকে না।

খাতওয়ারি বাজেটেও বরাদ্দের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার দুর্বলতা স্পষ্ট।

ড. রুমানা হক বলছিলেন, “আমাদের দেশে যেটা হয় যে, আগের বছরে যে বাজেট বরাদ্দ ছিলো সবাই ধরে নেয় সেখান থেকে হয়ত ৫/৭ শতাংশ বেশি বরাদ্দ হবে। সেটাকে মাথায় রেখেই কিন্তু বিভিন্ন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বাজেট পরিকল্পনাটা করে ফেলে।”

“কিন্তু আমরা যদি অন্যান্য দেশের বাজেটের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে, সেখানে চাহিদা ভিত্তিক বাজেটটা তৈরি হয়। যেখানে দেখা হয় যে আমাদের আসলে কী প্রয়োজন আছে। এবং এলাকাভিত্তিক সেটা যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট টা প্রস্তুত হয়। ফলে তাদের বরাদ্দটা কাজে লাগে এবং যেহেতু পরিকল্পিতভাবে করা সেহেতু অর্থ খরচও হয়।”

অর্থ খরচ না হলে সমস্যা কোথায়?

অর্থ খরচ না হলে এর ভুক্তভোগী হয় সাধারণ মানুষ। তবে টাকা খরচ করলেই হয় না, টাকাটা যেন অপচয় না হয় সেটা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থাৎ অর্থনীতিতে অর্থ খরচের গুণগত মান যাচাই করা আবশ্যক। বাংলাদেশে এখানেও দুর্বলতা আছে উল্লেখ করে এর সমালোচনা বিভিন্ন সময় করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। বিশেষ করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে দেখানো, বেশি দামে কেনাকাটা ইত্যাদি।

অর্থ অপচয় হলে সেটা জনগণের করের টাকা নষ্ট হয়। আবার পরের বছর করের বোঝা চাপে। একইভাবে অর্থ খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে মানুষ সেবা পায় না।

কিন্তু এমন অবস্থার কারণ কী? জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার অবশ্য সমস্যার কথা স্বীকার করেই জানাচ্ছেন, এ থেকে উত্তরণের পথও খুঁজছে সরকার।

“এটা আমাদেরও উদ্বেগ। আমরা সবক্ষেত্রে পুরোপুরি অর্থ ব্যয় করতে পারছি না। আমি টাকা দিচ্ছি, কিন্তু ব্যয় করতে পারছে না। স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো খাত থেকে টাকা ফেরত আসে। আমরা এটা নিয়ে ভাবছি যে, এসব খাতকে কীভাবে আরও সমৃদ্ধ করা যায়। যাতে করে তারা প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ করতে পারে। আমরা সব ঠিক করে ফেলেছি, এমন দাবি করছি না। কিন্তু আমরা সমস্যাগুলো নিয়ে ফাইন টিউনিং করছি।”

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলছেন, বাজেটের খরচ এবং বাস্তবায়নে সক্ষমতা বাড়াচ্ছেন তারা।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এলাকাভিত্তিক এবং খাতওয়ারি বাজেটে জনসংখ্যা ও চাহিদা নিরূপণ করে যে অর্থ বরাদ্দ, বাংলাদেশে ঘাটতি সেখানেই। ফলে বাজেট বাস্তবায়নেও দুর্বলতা কাটছে না।

অন্যদিকে মানুষের কাছেও এর সুফল পৌঁছতে দেরি হচ্ছে।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024