সারাক্ষণ ডেস্ক
কার্বন নির্গমন ক্রমশ বাড়তে থাকায় উত্তপ্ত হচ্ছে বায়ুমণ্ডল। এছাড়া, পৃথিবীতে গাছপালা তথা বন কমে যাওয়ায় বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা ও তাপ না কমায় ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর প্রভাবে বরফাচ্ছাদিত হিমালয় পর্বতসহ পৃথিবীর অপরাপর বরফাচ্ছাদিত পর্বতের বরফও গলছে একইহারে। বরফ গলা সেই পানি সমুদ্রে পতিত হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় সমূদ্র উপকুলের বাসিন্দারাসহ দ্বীপের বাসিন্দা প্রচুর ঝুঁকিতে আছে। অতিসম্প্রতি এই ঝুঁকির তথ্য নিরাপত্তা পরিষদকে জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এ সময় তিনি বিশ্বের নিচু উপকূলীয় অঞ্চল ও ছোটো দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে বসবাসকারী লাখ লাখ বাসিন্দার বিষয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেন।
গার্দী সুগডুবে স্কুলের আগে একদল অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
সমূদ্রপৃষ্ঠের ক্রমাগত উচ্চতার এই ঝুঁকির ফলাফল এরই মধ্যে বেশকিছু দ্বীপের বাসিন্দারা বেশ কঠিন ভাবেই টের পাচ্ছে। বিশেষ করে সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় তারা আর দ্বীপে থাকতে পারছেনা। হচ্ছে বাস্তুচ্যুত। দ্বীপ ছেড়ে ক্রমশ তারা মেইনল্যান্ডের দিকে চলে যাচ্ছেন। এমনি একটি দ্বীপ থেকে মেইনল্যান্ডে উঠে আসা কিছু মানুষের সুখ-দুখের কাহিনী দিয়ে তৈরী হয়েছে আজকের গল্প। ঘটনাটি দ্বীপদেশ পানামার।
একটি গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টিস্নাত দিনে কতিপয় স্বেচ্ছাসেবক প্লাস্টিকের চেয়ার, ড্রয়ার এবং একটি গ্যাস চুলা সামরিক মোটরনৌকায় তুলে নিচ্ছে।নৌকার উপর, ইউনিফরম পরা লোকেরা পানামার আদিবাসী গুনা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী সবুজ-লাল কাপড় পরা একজন নারীকে ঘাটের উপর থেকে নামতে সাহায্য করতে দেখা গেল। তিনি গার্ডি সুগডুব নামের পানামার উত্তর উপকূলের কাছে একটি ক্ষুদ্র প্রবাল দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন বা আছেন এমনই মনে হলো।
একজন মহিলা একটি ছোট নৌকায় গার্দি সুগডুব এবং গার্দি কোয়েবিতার মধ্যে ৷
৩ রা জুন পানামা সরকার এই দ্বীপ থেকে ৩০০ পরিবারকে মেইনল্যান্ডের সরকারি নির্মিত নতুন আবাসনে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করেছে।পরিবর্তনশীল আবহাওয়া এবং উঠতি সমুদ্রের জল ধীরে ধীরে এই দ্বীপটি এবং এর কাছাকাছি ৩৭টি অন্যান্য বসতিপূর্ণ দ্বীপগুলিকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, যেগুলির অধিকাংশই এক মিটারের কম উচ্চতায় অবস্থিত।
সেই উচ্চতা প্রতি বছর ৩.৪ মিলিমিটার হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝড়ঝাপটাগুলি আরও ভারী এবং ঘনঘন হচ্ছে। পানামা সিটির স্মিথসোনিয়ান ট্রপিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্টিভ প্যাটন বলেন, এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ দ্বীপগুলি বসবাসের জন্যে অনুপযুক্ত হয়ে যাবে।
ঝড়ের কারণে পড়ে যাওয়া পাম গাছের চারপাশে মাছের ঝাঁক সাঁতার কাটছে।
গার্ডি সুগডুবের পরিবারগুলিই প্রথম সরে যাচ্ছে। যদি সবকিছু ভালভাবে চলে তাহলে আরও অনেকে সরে যেতে পারে। “এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা,” বলেন রজেলিও পারেডেস, পানামার আবাসন মন্ত্রী।”এটি ল্যাটিন আমেরিকায় প্রথমবার যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমগ্র একটি কমিউনিটিকে নতুন জায়গায় সরানো হচ্ছে।
বিশ্ব এখন গার্ডি সুগডুবের উপর থেকে দৃষ্টি সরাচ্ছেনা।”তবে এই ধারণাটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে হচ্ছে তা স্পষ্ট । কারন, দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করছে।
গার্ডি সুগডুবের বয়স্ক বাসিন্দারা জলবায়ু উষ্ণতার ক্রমবর্ধমান প্রভাবগুলি অবশ্যই লক্ষ্য করেছেন কারন এখন বর্ষাকালীন বন্যা এখন আরও ঘনঘন হচ্ছে । জল এখন লোকালয়ের একদম কাছাকাছি উঁচু পর্যন্ত উঠে আসছে। তবে গত ২০ বছর ধরে তাদের প্রধান উদ্বেগ ছিল পরিচ্ছন্নতা পানিতে তলিয়ে যাওয়া নয়।
শিশুরা তাদের দাদির সাথে একটি বাড়িতে খেলছে যেখানে ১২ জন লোক থাকে। দ্বীপে উপচে পড়া ভিড় একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে কয়েকটি পরিবার ঘন দেওয়ালবেষ্টিত বাড়িগুলিতে বসবাস করতে শুরু করেছিল। শিশুরা যেখানে খেলতে পারত এমন বাইরের জায়গা ধীরে ধীরে খর্ব হয়ে গেছে। মেইনল্যান্ডের একটি নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানি ধীরে ধীরে দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠেছিল।
দ্বীপটির পায়খানাগুলি হল ব্রিজের শেষাংশে অবস্থিত কুঁড়েঘরের মতো করে তৈরী যেগুলি সরাসরি নীচের জলে পড়ে। দ্বীপটির বয়স্ক এক নেতা জোসে ডেভিস বলেন, কমিউনিটি প্রথম ১৯৯০ এর দশকে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে শুরু করে।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে ইসবার ইয়ালা সম্প্রদায় তাদের নতুন বাসস্থান নির্মাণের । সরকার-নির্মিত শহরটি দুই বেডরুমের প্রিফেব্রিকেটেড বাড়িগুলির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে।
এই ধারণাটি ২০১৮ সালে একটি জলবায়ু-অভিবাসন প্রকল্প হিসেবে ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা পায়। এরপরে সরকার মেইনল্যান্ডে নতুন বসতির নির্মাণের জন্য দরপত্র চুক্তি আহ্বান করে।
নতুন গ্রাম, স্থানীয় লকোয়াট গাছের নাম অনুসারে ইসবার ইয়ালা নামে অভিহিত, কমিউনিটির মালিকানাধীন কৃষিজমিতে নির্মিত হয়েছে, জায়গাটি নৌকা ও রাস্তা দিয়ে গার্ডি সুগডাব থেকে আধঘন্টার পথ। তিনশত বেজ প্লাস্টিকের বাড়ি টালির ছাদসহ গ্রিড প্যাটার্নে সাজানো রয়েছে।
প্রতিটি বাড়িতে দুটি বেডরুম, চলতি পানির সুবিধাসহ বাথরুম এবং পর্যাপ্ত বাগান রয়েছে। আবাসন মন্ত্রণালয়ের স্থাপত্য প্রধান মার্কোস সুইরা জোর দিয়ে বলেন যে, ইসবার ইয়ালাতে এই ধরনের প্রকল্প এটাই প্রথম।
একটি ছোট ছেলে নৌকার ডকের কাছে দেয়ালে খেলা করছে।
বড় বাজেটের সাথে অধিক সুসংহত আবাসন প্রকল্প পরবর্তীতে আসতে পারে। তবে স্থানান্তরিত বাসিন্দারা তা খুব একটা মনে করছেন না। ইসবার ইয়ালায় আসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা গুনাদের পছন্দনীয় খাট হ্যামক বাড়ির ধাতব বিমগুলি থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ৪৬ বছর বয়সী ইয়ানি প্রেস্টান বলেন, “এটা সুন্দর, আমি যা অভ্যস্ত তার চেয়ে বড়। আমি এটা পছন্দ করি।”
গার্ডি সুগডাবে সে চার সদস্যের পরিবারের সাথে একটি বাড়িতে থাকত; সেখানে প্রায় গোপনীয়তা ছিলই না এবং খাদ্য ও অর্থ নিয়ে প্রায়শই বিতর্ক হত।সে বাগানে তার সাতজনের পরিবারের জন্য দুটি বেডরুম ও বারান্দায় একটি রান্নাঘর বানাতে চায়। রাস্তা ও নালার মধ্যবর্তী সংকীর্ণ ঘাসের জায়গাটি ফুলের বাগানের জন্য উপযুক্ত হয়েছে।
নাদিন মোরালেস মূল ভূখণ্ডে সম্প্রদায়ের নতুন অবস্থানে যাওয়ার জন্য উন্মুখ।
একটু দূরে, সকালবেলায় ৪৫ বছর বয়সী জেনারো ফের্নান্দেজ তার জায়গার চারপাশে নালখাগড়া বানাতে এসেছিল। এখানে কচু ও মানিয়োকের চারা গজিয়েছে। কিছু সমস্যা আছে যেমন এখনও বিদ্যুতের সংযোগ নেই।
কোনো আবর্জনা সংগ্রহের ব্যবস্থা নেই এবং বন্দরে যাওয়ার জন্য কোনো পরিবহন নেই, যা একটা বড় সমস্যা। কারণ অধিকাংশ বাসিন্দা মাছ ধরা ও দ্বীপ পর্যটনে কাজ করেন।পরিকল্পিত একটি হাসপাতালের কংক্রিটের শূন্য কাঠামোটি রৌদ্রে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে তার পাশে একটি বড় আধুনিক স্কুল আছে যা এই বছরের শেষের দিকে খুলবে।
এয়ার কন্ডিশন্ড ক্লাসরুম, ছাত্রাবাস এবং ফুটবল মাঠসহ স্কুলটি নতুন বাসিন্দাদের কাছে একটি বড় আকর্ষণ। ক্লাসগুলি স্প্যানিশ ও গুনা উভয় ভাষায় পড়ানো হবে।গুনারা মনে করেন না যে এই স্থানান্তরণ তাদের সাংস্কৃতিক সমস্যা সৃষ্টি করবে। ২০০ বছর আগে তারা মেইনল্যান্ডে বাস করত, তারপর স্প্যানিশ উপনিবেশিকদের সঙ্গে রোগ ও সংঘাত এড়াতে দ্বীপে চলে এসেছিল।
গুনা জনগণ মাছ ধরা থেকে শুরু করে পর্যটন পর্যন্ত সমুদ্রের প্রতি নিবেদিত জীবন গড়ে তুলেছে।
এই অঞ্চলের অনেক অনানুষ্ঠানিক গানে মেইনল্যান্ডের নদী ও পাহাড়ের উল্লেখ রয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানে প্রায় ৪১ মিলিয়ন মানুষ জীবনঘাতী ঝড় ও বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় এলাকায় বাস করে।গার্ডি সুগডাব স্থানান্তরণটি এমন সুপরিকল্পিত প্রত্যাবাসনের মতো মনে হচ্ছে যার সাফল্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে এটি উন্নত আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো উন্নয়নমূলক লক্ষ্যগুলিকে পূরণ করতে পারবে বলে অনেকের ধারণা।
জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা সাব্রিনা জুরান বলেন, সম্প্রদায়কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্ত করলে এখনকার প্রত্যাবাসন কর্মসূচি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যা বহুমুখী চাহিদা পূরণ করবে।প্রথমদিকে কিছুটা সন্দেহপ্রবণ থাকলেও, গার্ডি সুগডুবের অধিকাংশ লোকই মেনে নিয়েছেন যে সমূদ্র জলের ঢেউই শেষ পর্যন্ত তাদের বাড়িঘর দখল করবে।
তবে তারা এখনই দ্বীপ ত্যাগ করবে না। নতুন মেইনল্যান্ডারদের কিছু কিছু বলছেন যে তারা প্রতি সপ্তাহান্তে দ্বীপটিতে আসবেন। অন্যরা বলছেন যে তারা তাদের বন্ধু এবং প্রতিবেশী দ্বীপগুলির ভিড়ের কারণে তাদের হ্যামক খাট সেখানে বিছিয়ে দেবেন।
দ্বীপটির একটি ভবনের পুননির্মাণ করা হচ্ছে। ৬৪ বছর বয়সী বাড়ির মালিক গুস্তাভো ডেনিস মনে করেন যে, এখন প্রতিযোগিতা হলো মেইনল্যান্ডে চলে যাওয়াযর এবং এটি একটি নতুন দোকান খোলার জন্য উপযুক্ত সময়।
Leave a Reply