বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৯ অপরাহ্ন

যেতে না পারা বাংলদেশি কর্মীদের না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় মালয়েশিয়া

  • Update Time : বুধবার, ১৯ জুন, ২০২৪, ২.৫৪ পিএম

আবুল খায়ের ও আবু কাউসার দুজন সম্পর্কে চাচা-ভাতিজা। মালয়েশিয়া যেতে গত ২৯-৩১ মে পর্যন্ত তিন দিন নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরের ফ্লোরে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত এজেন্সি থেকে বিমানের টিকিট না দেওয়ায় তাদের কেউ মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে কান্না করতে করতে ঢাকা ছেড়ে ফিরে গেছেন পটুয়াখালীর বাড়িতে।

বাংলাদেশ সরকার মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য জনপ্রতি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা খরচ নির্ধারণ করলেও এই দুজন ‘আদম ব্যাপারীদের’ ১০ লাখ টাকা দিয়েও যেতে পারেননি।

আবু কাউসার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “তিন দিন আমি, চাচা এবং বাবা কোনোরকম খেয়ে বিমানবন্দরের মেঝেতে শুয়ে-বসে ছিলাম। আশা ছিল, বিদেশে গিয়ে পরিবারের ভাগ্য বদল করব। কিন্তু প্রতিদিনই এজেন্সির লোক বলত টিকিট হয়ে যাবে আজ, রাতে ফ্লাইট। এভাবে তিন দিন বিমানবন্দরে কষ্ট করে পার করেছি। বিদেশের আশায় ছোট একটি চাকরি করতাম, সেটাও ছেড়ে দিয়েছি। সবকিছু হারিয়ে পথে বসে গেছি। এখন কান্না করা ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই।”

আবু কাউসারের বাবা হানিফ শিকদার ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “ছেলে আর ভাইকে মালয়েশিয়া পাঠাতে দালালকে ১০ লাখ টাকা দিয়েছি ভিসা এবং টিকিটের খরচ বাবদ। আর মেডিকেল করতে, ঢাকায় আসতে যেতে, তিন দিন বিমানবন্দরে থাকতে এবং বিদেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কেনাকাটায় আরও ২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “কিছু জমি ছিল, সেটি বিক্রি করে ৫ লাখ। সুদে ঋণ নিয়েছি ৩ লাখ টাকা। আত্মীয়স্বজন এবং জমানো কিছু টাকাসহ মোট ১০ লাখ দিয়েছি দালালকে। কিন্তু ভাই-ছেলে কেউ তো বিদেশ যেতে পারেনি। এখন কীভাবে ঋণের ৩ লাখের বছরে ৪৫ হাজার টাকা সুদ পরিশোধ করব। কোথা থেকে এত টাকা আসবে, মাথায় আসে না। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে আমাদের। এখন সরকার যদি কিছু না করে আমাদের বেঁচে থাকাই কষ্ট হয়ে যাবে।”

শুধু আবু কাউসার কিংবা আবুল খায়ের নয়, তাদের মতো ১৭ হাজার কর্মী ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ করেও মালয়েশিয়া যেতে পারেনি। আগামীতে এসব কর্মী যেতে পারবে– এমন সম্ভাবনাও দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।

সরকার ও জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মালয়েশিয়া সরকারের বেঁধে দেওয়া সময় অনুযায়ী বাংলাদেশে থেকে কর্মী পাঠানোর শেষ দিন ছিল ৩১ মে। এরপর তারা বাংলাদেশ থেকে এবারের মতো আর কর্মী নেবে না বলে আগেই ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সবকিছু সম্পন্ন হওয়ার পরও দেশ থেকে ১৭ হাজারের মতো কর্মী যেতে পারেনি। তাদেরকে নিতে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ করা হলেও তারা এখন পর্যন্ত ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। অন্যদিকে আগামী কিছুদিনের মধ্যে এসব ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে। তখন মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুললেও তারা যেতে পারবেন না।

মালয়েশিয়া যেতে না পেরে এক তরুণের আত্মহত্যা

গত ২ জুন ভৈরব রেলস্টেশনে থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রেন মেঘনা নদীর ওপর রেলসেতু অতিক্রমকালে ট্রেন থেকে নদীতে ঝাপ দেন সোহেল তানভীর নামের এক যুবক। পরবর্তীতে ৪৪ ঘন্টার পরে মেঘনা নদীর নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার বেগমাবাদ এলাকায় তার মরদেহ ভেসে ওঠে। পরে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন গিয়ে মরহেদ উদ্ধার করে।

স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো বলছেন-নিহত যুবক তানভীর মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ দিন ৩১ মে বিমানে যাত্রী ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যেতে পারেননি। পরে তিনি বাবার আমির উদ্দিন সঙ্গে ঢাকা থেকে ভৈরব ফিরে যাচ্ছিলেন।

নিহত তানভীরের মামা মো. ইমরান হোসেন বলেন, “আমার বোনের পরিবারে আর্থিক অনটন ছিল না। ভাগনে যেন জীবনের প্রতি দায়িত্বশীল হয়, সে জন্য তাকে প্রবাসে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। তানভিরের প্রবাসে যাওয়া ও প্লেনে ওঠার খুব শখ ছিল। কিন্তু প্রবাসে না গিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেল ভাগনে। ছেলের আগ্রহে বাবা বিদেশ যাওয়ার সব ব্যবস্থা করেছিলেন।”

মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না: বায়রা

মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের আগামীতে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু– জানতে চাইলে বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আপাতত তাদের যাওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না। তার নানা কারণ রয়েছে। এ ছাড়া আগামীতে কিছুদিনের মধ্যে এসব ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাবে।”

কতজন কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেনি, তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) এই মহাসচিব বলেন, “বিভিন্ন তথ্যমতে সবকিছু সম্পন্ন হওয়ার পরও ১৭ হাজারের মতো কর্মী যেতে পারেনি।”

আলী হায়দার বলেন, “এই ১৭ হাজার না যেতে পারার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তার মধ্যেও কয়েকটি ক্যাটেগরি আছে। যেমন–

কিছু মালয়েশিয়ান কোম্পানি আমাদেরকে ১০০ লোকের (শ্রমিক পাঠানোর) চাহিদা দিয়েছিল। সেখান থেকে ৫০ বা ৬০ জন কর্মীকে পাঠানোর পর, তারা বাকিদের নেয়নি। এখন তারা না নিলে আমরা তো জোর করে পাঠাতে পারব না। দ্বিতীয়ত, অনেক কোম্পানিকে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকার কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এসব কোম্পানির শ্রমিকরা তো আর যেতে পারেনি বা পারবেও না। ফলে, আবারও মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হলেও এই শ্রমিকদের তো পাঠাতে পারব না।”

তিনি আরও বলেন, “আবার কিছু লোক বিমানের টিকিটের সংকটের কারণে যেতে পারেনি। তাদের ভিসার মেয়াদও কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। তারপর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের মধ্যে আলোচনা চলছে, কীভাবে এসব শ্রমিক পাঠানো যায়।”

সিন্ডিকেট প্রতি শ্রমিকবাবদ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়েছে– এ বিষয়ে বায়রা জানে কিনা, জানতে চাইলে আলী হায়দার বলেন, “কে কাকে টাকা দিয়েছে, তা আমি জানি না। এ নিয়ে আমি কিছু বলতেও পারব না। এ বিষয়ে সরকারের কথা বলা উচিত। কোনও ব্যবস্থা নিতে হলে সরকারকেই নিতে হবে।”

অন্য ১৩টি দেশ থেকে মালয়েশিয়া উন্মুক্ত পদ্ধতিতে শ্রমিক নিলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন বারবার সিন্ডিকেট হয়–

জানতে চাইলে বায়রা মহাসচিব বলেন, “এটার উত্তর মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকার দিতে পারবে। আমরা সব সময় বলে আসছি, নির্দিষ্ট কোনও এজেন্সির মাধ্যমে আমরা কর্মী পাঠাতে চাই না। অন্য ১৩টি দেশের যেভাবে সব (৩০০-৪০০) এজেন্সি কর্মী পাঠায়, আমরা সেভাবে পাঠাতে চাই। কিন্তু আমাদের এখানে বারবার সিন্ডিকেট হয়। এবারও মালয়েশিয়ায় কর্মী গেছে ১০০টি এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।”

জানতে চাইলে বায়রা মহাসচিব বলেন, “এটার উত্তর মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকার দিতে পারবে। আমরা সব সময় বলে আসছি, নির্দিষ্ট কোনও এজেন্সির মাধ্যমে আমরা কর্মী পাঠাতে চাই না। অন্য ১৩টি দেশের যেভাবে সব (৩০০-৪০০) এজেন্সি কর্মী পাঠায়, আমরা সেভাবে পাঠাতে চাই। কিন্তু আমাদের এখানে বারবার সিন্ডিকেট হয়। এবারও মালয়েশিয়ায় কর্মী গেছে ১০০টি এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।”

কর্মীর টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ হয়ে গেছে, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ: বায়রার সাবেক মহাসচিব

মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেটের একটি রিক্রুটিং এজেন্সি সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক বায়রার সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান।

তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “যতটুকু জানা গেছে সবকিছু সম্পন্ন করেও সাড়ে ১৬ হাজারের বেশি কর্মী (ই-ভিসা, ম্যানপাওয়ার, বিএমইটি কার্ডসহ অন্যান্য কার্যক্রম) যেতে পারেনি। আরও ৫০ হাজারের মতো ভিসা হয়েছে–এমন কর্মী যেতে পারেনি।”

শামীম আহমেদ বলেন, “এসব কর্মীকে পাঠাতে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে হাইকমিশনার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু মালয়েশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দেয়নি।”

সাবেক এই বায়রার মহাসচিব বলেন, “মালয়েশিয়ায় এখনও কর্মীর চাহিদা আছে। দুই মাস পরও যদি তারা শ্রমবাজার খোলে, তাহলে অনেক কর্মী যেতে পারবে। না হলে এত লোকের কী হবে, বলা মুশকিল।”

যারা যেতে পারেনি তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু–

জানতে চাইলে শামীম আহমেদ বলেন, “মালয়েশিয়া সরকারকে টাকা দিতে হয়েছে, কলিং আসার পর টাকা দিতে হয়েছে, ম্যানপাওয়ার করতে খরচ হয়েছে, মেডিকেল করতে খরচ হয়েছে, বিএমইটি করতে খরচ হয়েছে, এ ছাড়া অন্যান্য খরচ তো আছেই। কর্মী থেকে এজেন্সিগুলো যে টাকা নিয়েছে, সেটা তো খরচ হয়ে গেছে। এখন হয়তো এজেন্সিগুলো তাদের যে লাভ ধরছে, সেটা আছে।”

তিনি আরও বলেন, “এখানে তো একজন কিংবা ১০ জন লোক নয় যে, এজেন্সির মালিকরা নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিয়ে দেবে। হাজার-হাজার লোকের এত টাকা কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে? এটা সম্ভব নাকি।”

১ লাখ ৫০ হাজার নিয়েছে সিন্ডিকেট: জনশক্তি ব্যবসায়ীদের দাবী

জনশক্তি ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ বাদে অন্য ১৩টি দেশ থেকে কর্মী প্রেরণে এফডব্লিউসিএমএস থেকে এজেন্সি বাছাই করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অটো রোটেশনের মাধ্যমে এজেন্সি ঠিক করা হয়– কোন এজেন্সি কর্মী পাঠাবে। যার ফলে যে ব্যবসায়ী চাহিদাপত্র আনেন, তিনি জিম্মি হয়ে যান সেই এজেন্সির কাছে। এই সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেটের এজেন্সিগুলো জনপ্রতি ১ লাখ ৫০ হাজার করে নিয়েছে।

জনশক্তি ব্যবসায়ী শফিক আহমেদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সিন্ডিকেটের লোকদের প্রতি কর্মীবাবদ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে।

কেন এই টাকা দিতে হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কারণ এসব সিন্ডিকেটের লাইসেন্সে কাজের চাহিদাপত্র এসেছে। কাজ করতে হয়েছে তাদের পোর্টালের মাধ্যমে। তারা ফি বাবদ এই টাকা নিয়েছে। এখন আমি যদি টাকা না দিই, তাহলে তখন তারা বলবে আপনার কাজ করার দরকার নেই। ফলে, আমাকে কাজ করতে বাধ্য হয়ে ফি হিসেবে এই টাকা দিতে হয়েছে।”

তার নিজের এজেন্সির কতজন কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেনি– জানতে চাইলে শফিক আহমেদ বলেন, “আমাদের মোটামুটি সব কর্মী যেতে পেরেছে। লোকাল এজেন্টরা কিছু কর্মীর পুরো অর্থ পরিশোধ না করার কারণে কয়েকজন যেতে পারেনি।”

নিজের ব্যবসার ক্ষতির শঙ্কার কারণে নাম না প্রকাশের শর্তে একটি এজেন্সির মালিক ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “একজন সংসদ সদস্যের রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে আমার কাজের চাহিদাপত্র আসে। সেটি ছাড়পত্র আনতে আমাকে জনপ্রতি ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। তাহলে কীভাবে সরকারের নির্ধারিত টাকায় কর্মী বিদেশে পাঠাব।”

তিনি আরও বলেন, “এরপর মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও বিএমইটি কার্ড করতে ঘুষ দিতে হয়। তারপর অন্যান্য খরচ তো আছেই। আবার শেষ সময় ২৫-৩০ হাজার টিকিট কিনতে হয়েছে ১ লাখ ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে। যার কারণে কোনও কর্মী ৫ লাখ টাকার নিচে মালয়েশিয়া যেতে পারেনি। এটা সরকারের সব মহলের লোকই জানে।”

দোষী প্রমাণিত হলে যত প্রভাবশালী হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না: প্রতিমন্ত্রী

প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “নির্ধারিত সময়ে যেসব কর্মী যেতে পারেনি, তাদের নিতে আমরা মালয়েশিয়া সরকারকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে পজিটিভ কিছু পাইনি। এখনও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

কর্মী যেতে না পারার পেছনে কারণ খুঁজে বের করতে মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “২ জুন আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। সাত কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এখনও রিপোর্ট পাইনি। আরও দুই-তিন দিন সময় লাগবে। তবে তদন্তে যারাই দোষী প্রমাণিত হবে এবং যত প্রভাবশালী হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”

গত ৮ জুন প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছিলেন, ২-৩ দিন পর রিপোর্ট পাওয়া যবে।

কিন্তু ১৩ জুন রাতে ফোন করা হলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তদন্ত করার জন্য আরও ৫ দিন সময় বাড়ানো হয়েছে। আমরা সবকিছু তদন্ত করছি। এই জন্য সময় বেশি লাগছে। ১৪ জুন থেকে বাংলাদেশে ঈদুল আযহার ছুটি শুরু হচ্ছে। শেষ হবে ১৯ জুন।

প্রতিমন্ত্রী জানান, ৩১ মে পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে আসা ৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৩ জনের চাহিদা পত্রের বিপরিতে বিএমইটির ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে। ৩১ মে পর্যন্ত যেতে পেরেছে তাদের মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন। সেই হিসাবে ১৬ হাজার ৯৭০ জন যেতে পারেননি। সংখ্যাটা কিছুটা কমবেশি হতে পারে।

৫৮১ জনকে ক্ষতিপূরণ দেবে বায়রা

৩১ মে মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ দিন হাজারো কর্মী না যেতে পারায় হতাশায় কান্নাকাটি করে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ফিরে যান। কিন্তু বায়রার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে– শেষ দিন মাত্র ৫৮৩ জন কর্মীকে বিভিন্ন এজেন্সি বিমানের টিকিট না দেওয়ায় তারা ফিরে গেছেন। এ নিয়ে বায়রার পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, কোন কোন এজেন্সির কর্মী ছিল, তা খুঁজে বের করতে। একইসঙ্গে এসব কর্মীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বায়রা।

৩১ মে শেষ দিন বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৫৮১ জন মালয়েশিয়া যেতে পারেনি বলে উল্লেখ করেন নিজাম হাজারী। তিনি বলেন, “এসব কর্মীর এজেন্সির লোকেরা টিকিট দেবে বলে বিমানবন্দরে পাঠায়। কিন্তু সেই সময় টিকিটের দাম ২৫-৩০ হাজার থেকে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায় চলে গেছে, তখন এজেন্সিগুলো দেখেছে যে এই দামে টিকিট কেটে লোক পাঠালে তাদের ২৫ হাজার টাকার মতো লস (ক্ষতি) হচ্ছে। এই কারণে অনেক এজেন্সি তখন কর্মীদের টিকিট দেয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “এটা নিয়ে আমরা বায়রার পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করেছি, ৫৮১ জন কর্মী কোন এজেন্সির, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এই লোকদের আমরা বায়রার পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

নিজাম হাজারী বলেন, “বলা হচ্ছে ১৭ হাজারের মতো কর্মী যেতে পারেনি, এটা ঠিক নয়। সর্বোচ্চ হলে ৫ থেকে ৬ হাজার লোক যেতে পারেনি। এখানে যেটা হয়েছে–

বিভিন্ন অনিয়মের কারণে মালয়েশিয়া সরকার ৩৭টি এজেন্সিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। তাদের সেই লোকগুলো যেতে পারেনি।

চার সংসদ সদস্যের মালয়েশিয়া সিন্ডিকেট, অস্বীকার তাদের

স্থানীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া কর্মী পাঠানোর যে ১০০ জনের সিন্ডিকেট করা হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন চারজন সংসদ সদস্য ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীকিছু নেতা। এই চারজন সংসদ সদস্য হলেন ফেনী-২ আসনের নিজাম হাজারী, ফেনী-৩ আসনের মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা-২০ আসনের বেনজীর আহমদ ও কুমিল্লা-১০ আসনের সাবেক মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

সরকারের নির্ধারিত ফি ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার বিপরীতে এসব এজেন্সি প্রতি কর্মী থেকে গড়ে ৫ লাখ থেকে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে নিয়েছে। সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে নিজাম হাজারী ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “প্রথমত এখানে সিন্ডিকেটের কোনও বিষয় নেই। কারণ আমরা ১৫০৪টি এজেন্সি মালয়েশিয়া সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম শ্রমিক পাঠানোর জন্য অন্তর্ভুক্ত করতে। সেখান থেকে মালয়েশিয়া সরকার ১০১টি এজেন্সিকে অন্তর্ভুক্ত করে। তার মধ্যে একটি সরকারি আর বাকি ১০০টি বেসরকারি। এর মধ্যে আমার লাইসেন্সও ছিল।”

তিনি বলেন, “সিন্ডিকেটের ১ লাখ ৫০ টাকা নিয়েছি, এটা সঠিক নয়। আমরা শুধু সরকারের নির্ধারিত অভিবাসন ফি বা ভিসা প্রসেসিং বাবদ ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নিয়েছি। আমরা একটিও ভিসা ক্রয় বা বিক্রি করিনি। শুধু প্রসেসিং করেছি।”

কর্মীপ্রতি ৪ লাখ ৫০ হাজার থেকে ৬ লাখ টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিজাম হাজারী বলেন, “এই বিষয়টি আমরা বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি। এটা কতটুকু সত্য আমরা জানি না। তবে যেহেতু মিডিয়া এসেছে, কিছু সত্য তো আছে। এটা হয়তো মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা নিয়েছে।”

সিন্ডিকেট ফি হিসেবে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার বিষয়টি মিথ্যা বলে দাবি করেন আরেক সংসদ সদস্য বেনজীর আহমদ। অন্য ব্যবসায়ীর চাহিদাপত্রের কর্মীর ছাড়পত্র করে দিতে কত টাকা নিয়েছেন জানতে চাইলে বেনজীর আহমদ বলেন, “সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নিয়েছি। এর বাইরে আমরা কোনও টাকা নিইনি।”

তবে মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ও মুস্তফা কামালকে ফোন করে ও মেসেজ দিয়েও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী বলছেন “দায়ী ব্যক্তিদের” বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে

গত ৬ জুন সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। “এবার এ ব্যাপারে যে সমস্যা হয়েছে আমরা তা তদন্ত করে দেখছি। যদি কেউ দায়ী হন, তাদের অবশ্যই বিচার হবে।”

বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হক চুন্নুর এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কর্মসংস্থানের জন্য যাওয়া স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু কিছু লোক দালালের মাধ্যমে যেতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে যায়। এতে সমস্যা তৈরি হয়।”

মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার বিশেষ ফ্লাইট চালু করেছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “বিশেষ ফ্লাইট, অন্যান্য ফ্লাইটের সঙ্গে সংযুক্ত করে সবাইকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু অনেকেই বাদ পড়ে গেছে। বাদ পড়ার কারণ কী সেটা অনুসন্ধান করা হচ্ছে।”

দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে বারবার বন্ধ হয় শ্রমবাজার

২০০৯ সালে প্রথম দফায় বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০১৬ সালের শেষদিকে পুনরায় বাজারটি খোলা হয়। তখন বাংলাদেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি এতে যুক্ত ছিল। পরে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় দফায় বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এর চার বছর পর ২০২২ সালে আবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলে। শ্রমবাজার খোলার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে মালয়েশিয়া। তখন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সব এজেন্সির জন্য কর্মী পাঠানোর সুযোগ উন্মুক্ত রাখার ওপর জোর দেয়নি। বরং তারা এজেন্সি নির্ধারণের দায়িত্ব দেয় মালয়েশিয়াকে। প্রথমদিকে ২৫টি এজেন্সিকে ঠিক করে তারা। এরপর আন্দোলনের মুখে আরও ৭৫টি এজেন্সিকে যুক্ত করে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর জন্য ১০০টি এজেন্সিকে ঠিক করা হয়।

গত ১৯ এপ্রিল মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে এক বিবৃতি প্রকাশ করা হয় এতে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেই দুর্বিষহ, মানবেতর ও অমর্যাদাকর পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। চাকরির ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রমিকদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

গত মার্চে মালয়েশিয়া জানায়, তারা আপাতত আর শ্রমিক নেবে না। যারা অনুমোদন পেয়েছেন, ভিসা পেয়েছেন, তাদের ৩১ মের মধ্যে মালয়েশিয়ায় ঢুকতে হবে।

সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান বলেন, “এখানে বাংলাদেশে সরকারের কিছু করার নেই। নিয়োগকারী দেশ চায় বলেই সিন্ডিকেট হয়েছে।”

ইউএনবি

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024