সারাক্ষণ ডেস্ক
চন্দ্রবোড়া সাপ বা রাসেলস ভাইপার বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। গত ১১ বছরে এই বিষধর সাপ ৩২টি জেলায় দেখা গেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, চন্দ্রবোড়ায় কামড়ানো রোগী বাড়ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় চন্দ্রবোড়া সাপের ব্যাপারে আতঙ্কিত না হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সাপের বিষ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ভেনম রিসার্চ সেন্টার গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। পুরোনো ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে এই সাপ থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেই জায়গার ছবিতে সাপ দেখানো হচ্ছে এবং এই সাপের যে প্রজাতির অস্তিত্ব বাংলাদেশে নেই, সেগুলোর ছবি প্রচার করা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে কোনো পোস্ট দেওয়ার আগে জেনেবুঝে তা করতে বলেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এই বিশেষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
চন্দ্রবোড়া বিষধর সাপ। এর গায়ের রং বাদামি বা হলুদ অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ। সারা দেহে সারি দিয়ে থাকে গোলাকৃতি বা ডিম্বাকৃতি গাঢ় বাদামি ফোঁটা। ফোঁটার সারি দেখে মনে হবে শিকল। সাপ গবেষকেরা বলেছেন, সব সাপই ডিম পাড়ে, সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। চন্দ্রবোড়ার ডিম ফোটে পেটের মধ্যে। পেট থেকে বাচ্চা বের হয়। পানিতে চলাচল এই সাপের পছন্দ।
কোথায় এই সাপ
১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের সাপ’ বইয়ে বন্য প্রাণিবিশেষজ্ঞ মো. আলী রেজা খান বলেছেন, চন্দ্রবোড়া সাপ রাজশাহী বিভাগে সর্বাধিক পাওয়া যায়। অন্যত্র আছে, তবে তেমন দেখা যায় না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টার বলেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ৯টি জেলায় চন্দ্রবোড়া সাপ দেখা গেছে। ২০১৮ সালে এই সাপ থাকা জেলার সংখ্যা বেড়ে হয় ১১টি। ২০২৩ সালে ২৩টি জেলায় এই সাপ নথিভুক্ত করেছিলেন ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষকেরা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে জেলার সংখ্যা আরও বাড়ে।
২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ৩২টি জেলায় এই সাপ দেখা গেছে। জেলার তালিকায় আছে: নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি ও বরগুনা।
পদ্মা নদী ও তার শাখা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে চন্দ্রবোড়ার বিস্তার সবচেয়ে বেশি বলে দাবি করেছে ভেনম রিসার্চ সেন্টার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী সাপের বিষ নিয়ে গবেষণায় যুক্ত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই সাপ ভালো সাঁতার কাটতে পারে। নদীপথে এই সাপ ছড়ায়। মেহেরপুর, চুয়াডঙ্গার মতো এলাকাতেও এই সাপ কীভাবে পৌঁছাচ্ছে, তা গবেষণার দাবি রাখে।
রোগীও বাড়ছে
চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো একজন রোগী শনিবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি ছিলেন। ওই রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন রাজশাহী মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। ২০১৩ সালে তিনি প্রথম চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসা করেন। প্রথম আলোকে তিনি জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তিনি ২৩৫ জন রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন, যাঁরা চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগী ছিলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে এসব রোগীর ২৯ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে।
এখন কি রোগী বাড়ছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগী বাড়ছে। পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট। ২০২২ সালে রাজশাহী মেডিকেল চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো ৩১ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ভর্তি হয়েছিল ৫০ জন।’ তিনি আরও জানান, রাজশাহী মেডিকেল সবচেয়ে বেশি রোগী আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে। রোগীদের বড় অংশ ধানের মাঠে দংশনের শিকার হয়।
চন্দ্রবোড়া বাড়ছে কেন
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চন্দ্রবোড়া সাপ কবে প্রথম দেখা গিয়েছিল, সেই ইতিহাস অজানা। তবে সাম্প্রতিক কালে এই সাপ কেন বাড়ছে, তার সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে না। বিএসএমএমইউর ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফজলে রাব্বি চৌধুরী বলেন, ‘গুইসাপ, বেজি, প্যাঁচা, চিল ও বাজপাখি—এদের শিকার ছিল চন্দ্রবোড়া। এখন গুইসাপ, বেজি, প্যাঁচা, চিল ও বাজপাখি কমে গেছে বা কোথাও কোথাও নাই বললেই চলে। প্রধান শত্রুগুলো কমে যাওয়াই চন্দ্রবোড়া বৃদ্ধির কারণ বলে আমরা মনে করছি। তবে আরও গভীর অনুসন্ধান দরকার।’
দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শনিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনের একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়। ওই ভিডিও বার্তায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশের কয়েকটি জেলায় ও চরাঞ্চলে বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি দেখা গেছে, এতে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করছে। তবে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ‘অ্যান্টিভেনম’ বা সাপে কামড়ের রোগীর চিকিৎসার ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিষধর সাপে কামড়ালে বাঁচার পথ একটাই, রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া। রোগীর চিকিৎসায় ওঝা বা ঝাড়ফুঁক থেকে দূরে থাকার অনুরোধ জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় শনিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে সাপের কামড় এড়াতে কিছু পরামর্শ দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, চন্দ্রবোড়া দেখা দেছে, এমন এলাকায় মাঠে কাজের সময় বুট (জুতা) ও লম্বা প্যান্ট পরতে হবে, রাতে চলাচলের সময় টর্চলাইট ব্যবহার করতে হবে, পতিত গাছ–লাকড়ি–খড় সরানোর সময় সতর্ক থাকতে হবে, সাপ দেখলেই তা ধরা বা মারার চেষ্টা করা যাবে না, প্রয়োজনে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করতে হবে।
চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ানো রোগী চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা থেকে রাজশাহী মেডিকেলের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু শাহীন মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে যে অ্যান্টিভেনম আছে, তা চন্দ্রবোড়ার বিষ নিরাময়ে কার্যকর। যারা দেরিতে হাসপাতালে এসেছে, তাদের অবস্থা খারাপ হতে দেখেছি। সুতরাং সাপে কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বা যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে আসতে হবে।’
আওয়ামী লীগের গৌরবোজ্জ্বল প্লাটিনাম জয়ন্তী, অর্থাৎ ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোববার (২৩ জুন) সকাল ৭টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা।
প্লাটিনাম জয়ন্তীতে সূর্যোদয়ের সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়।
এ দিন সকাল সাড়ে ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিদল শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবে।
এছাড়া বিকেল ৩টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ সভায় শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, আমন্ত্রিত অতিথিসহ দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা অংশ নেবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে রাজনৈতিক সংহতি ও সহযোগিতার নবক্ষেত্র উন্মোচন এবং দুই দেশের সম্পর্ক যে নতুন উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে তাকে আরও এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
দুদেশের মধ্যে সংযোগ বা কানেক্টিভিটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর যাতে ভারতের উত্তর-পূর্ব, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলের জন্য ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও আমাদের অগ্রগতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।’
সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে রাজনৈতিকভাবে দুদেশের ঐক্যমতের অভাব নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এরপরও যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলোও যাতে একদম কমানো যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী আছে। এগুলোর নাব্যতা রক্ষাসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা, বন্যা দুর্যোগ মোকাবিলা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়েও গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎখাতে সহযোগিতার প্রসার, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানিতে সহায়তা এবং ভারত যে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের নতুন সঞ্চালন লাইন করছে, সেটি থেকে কীভাবে সহায়তা পাওয়া যেতে পারে সে বিষয়ে আলোকপাত করেন।’
‘এ সময় পেঁয়াজ, তেল, গম, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানিতে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট কোটা সংরক্ষণ ও আমদানি যাতে বন্ধ না হয়, সে বিষয়েও আমরা আলোচনা করেছি’, বলেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ব্রিকস সদস্য বা অংশীদার যেকোনো পদে আমরা ভারতের সমর্থন চেয়েছি এবং তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। পাশাপাশি বিমসটেক, ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনসহ বহুপাক্ষিক ফোরামগুলোতে অবস্থান শক্তিশালী করা, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়েও আলোচনা ছিল ইতিবাচক।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনায় চীনের ভূমিকা বৃদ্ধির কথাও এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে এটি আলোচনা করবেন বলেছেন।
ভিসা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ড. হাছান মাহমুদ জানান, বাংলাদেশিদের জন্য ভারত বছরে প্রায় ২০ লাখ ভিসা প্রদান করে। মেডিকেল ভিসা ত্বরান্বিত করতে ও অন্যান্য ভিসার অযথা বিলম্বরোধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের মিশনগুলোকে নতুন নির্দেশনা দিয়েছেন।
ব্যাংক ঋণ খেলাপি হওয়ার আগের ধাপ ‘ওভারডিউ’ বা ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’। কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ অনিয়মিত হয়ে গেলে সেটি মেয়াদোত্তীর্ণ বলে গণ্য হয়। এ ধরনের ঋণই পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয় খেলাপির খাতায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯২ কোটি টাকায়। পরিশোধ কিংবা পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত না করা হলে এ ঋণও শিগগিরই খেলাপির খাতায় উঠবে।
দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি হওয়া ঋণের মতো মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২ সালের মার্চে ব্যাংক খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। একই সময়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা ছিল খেলাপি ঋণ। অর্থাৎ দুই বছর আগে খেলাপি ও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের মার্চে এসে এ ধরনের ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার ২৮৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। আর চলতি ২০২৪ সালের মার্চে খেলাপি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। বাকি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৯২ কোটি টাকার ঋণ ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে খেলাপি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা বা প্রায় ৪৬ শতাংশ বেড়েছে।
মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়া ঠেকাতে প্রতিনিয়ত পুনঃতফসিলের আশ্রয় নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। শুধু ২০২২ সালেই রেকর্ড ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। ২০২৩ সালে পুনঃতফসিল করে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া ঋণের পরিমাণ আরো বেশি। খেলাপি, পুনঃতফসিল ও পুনঃগঠনকৃত ঋণকে ‘স্ট্রেসড’ বা ‘দুর্দশাগ্রস্ত’ হিসেবে দেখায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। গত বছর শেষে পুনঃতফসিলকৃত ঋণের স্থিতি ৩ লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়। আবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় অযোগ্য হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপনও করেছে। সব মিলিয়ে দেশের ব্যাংক খাতের এক-তৃতীয়াংশের বেশি ঋণ এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ’ হলো খেলাপি হওয়ার প্রথম ধাপ। পুনঃতফসিলের মতো ওষুধ দিয়ে টিকিয়ে না রাখা হলে অনাদায়ী এসব ঋণ দ্রুতই খেলাপির খাতায় উঠবে। খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ কিংবা কমানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে, তার কোনোটিই কাজে আসবে না। আগামীতে খেলাপি ঋণের ক্ষত আরো বেশি গভীর হবে। এতে ব্যাংক খাত আরো বেশি নাজুক পরিস্থিতিতে পড়বে।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ বণিক বার্তাকে জানান, ‘দেশের অনেক ব্যবসায়ী এখন সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করছে না। এ কারণে খেলাপি ঋণ ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশে ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার জন্য শুধু ক্রেডিট অ্যানালাইসিস বা ক্রেডিট ম্যানেজমেন্টের ব্যর্থতা দায়ী নয়। বরং এজন্য অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, আইনি কাঠামোর দুর্বলতা, সুশাসনের ঘাটতি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিসহ বহু কারণ রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ভ্যাট, টেক্সসহ সবক্ষেত্রে তাদের ব্যবসার ব্যয় বেড়ে গেছে। এ কারণে তারা মুনাফা করতে পারছে না।’
তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বলেছেন, ‘দেশে ঘুস-দুর্নীতির বিস্তার ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে গেছে। এর প্রভাবেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ বাড়ছে। যারা দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। কিন্তু যেসব ব্যবসায়ী সততার সঙ্গে ব্যবসা করার চেষ্টা করছে, তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রভাবশালীদের চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই রীতিনীতি-বিরুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকগুলোয় সবচেয়ে বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ সৃষ্টি করেছে শিল্প খাত। গত মার্চ শেষে শিল্প খাতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭৭ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ রয়েছে ট্রেড অ্যান্ড কমার্সের। কৃষি খাতের ১৮ হাজার ১৯৮ কোটি, নির্মাণ খাতের ১৫ হাজার ৬০৪ কোটি, ভোক্তা ঋণের ৫ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকার ঋণ এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। খেলাপির মুখে পড়া এ ঋণের মধ্যে ৮৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা সরকারি বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর (ইসলামী ধারার ব্যাংক ছাড়া) ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৪ কোটি টাকার ঋণও এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। আর ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ রয়েছে ৩৯ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের শীর্ষ পাঁচজন ব্যবসায়ী বা শিল্প গ্রুপের নামে এখন প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। আর এ গ্রুপগুলোর বেনামি ঋণ আমলে নিলে সেটির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ লাখ কোটি টাকারও বেশি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এসব ঋণের সিংহভাগই এখন খেলাপি। কিন্তু বিভিন্নভাবে ঋণগুলোকে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। একইভাবে বেসরকারি ব্যাংক পরিচালক ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের ঋণ খেলাপির যোগ্য হলেও সেগুলো নিয়মিত দেখানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণও দেখানো হচ্ছে না। এভাবে তথ্য গোপনের মধ্যেমে দেশের ব্যাংক খাতকে আরো বেশি নাজুক পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশির ভাগ কর্মকর্তার আন্তরিকতা থাকলেও অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকানো যাচ্ছে না।’
খেলাপি ঋণ কম দেখাতে গত কয়েক বছরে দফায় দফায় ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালা উদার করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত এককালীন বা ডাউন পেমেন্ট জমা দিতে হতো। কিন্তু খেলাপিদের প্রতি নমনীয় হতে গিয়ে ২০১৯ সালে এ হার ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। যদিও ব্যাংকের প্রভাবশালী গ্রাহকরা কোনো ডাউন পেমেন্ট না দিয়েও খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহকের অনুকূলে ঋণসীমা বাড়িয়ে দিয়েও ব্যাংকগুলো খেলাপি হওয়ার যোগ্য ঋণকে নিয়মিত দেখাচ্ছে।
অন্যদিকে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতাও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হাতে ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ আগে ব্যাংকগুলো নিজ পর্ষদে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করে সেটি অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যাচাই-বাছাইয়ের পর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করত। কিন্তু ২০২২ সালের জুলাইয়ে সে ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনটি জারি হওয়ার পর ব্যাংকগুলো নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ‘উদারতাকেই’ খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে উল্লম্ফনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
খেলাপি ঋণ কমাতে হলে পুনঃতফসিলের সংস্কৃতি থেকে বেরোতে হবে বলে মনে করেন ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ওভারডিউ বা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে। এ ধরনের ঋণ নিয়মিত দেখাতে ব্যাংকগুলো পুনঃতফসিলের সুযোগ দিচ্ছে। এতে ঋণ পরিশোধ না করেও এক শ্রেণীর গ্রাহক ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে ভালো ব্যবসায়ীদের ওপর। তারা সব আইন-কানুন মেনে ব্যবসা করার পরও ক্ষতির মুখে পড়ছেন।’
আরফান আলী বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো, যেসব ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছেন, বিদেশে পাচার করেছেন, তাদের ঋণই খেলাপি কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ হচ্ছে। এ শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা যত বেশি সুযোগ পাবে, দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ তত বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ বন্ধ হলে ঋণ পরিশোধের সংস্কৃতি ফিরবে। দেশের ব্যাংক খাতও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবে।’
দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানান, একজন গ্রাহকের কাছে আমাদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার ঋণ আটকে আছে। ওই ব্যবসায়ীর কাছে টাকা চাইতে গেলে তিনি বলেন, ‘আমি আদালতে ১-২ কোটি টাকা খরচ করলে সব রায় আমার অনুকূলে চলে আসবে। তাহলে কেন আপনাদের টাকা ফেরত দিতে যাব।
সুশাসন ভেঙে পড়ার প্রভাবই সব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের ব্যাংক খাতের সুশাসন অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে ঋণের নামে জনগণের অর্থ লুণ্ঠন হয়েছে। এ কারণে পুনঃতফসিল নীতিমালা সহজ করা সত্ত্বেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের ব্যাংকগুলোয় দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে ধামাচাপা দেয়া খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। একই ঋণ বহুবার পুনঃতফসিল করে নিয়মিত দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সে ঋণ আবারো মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা খেলাপি হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ পুরো ব্যাংক খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে।’
Leave a Reply