মণীশ রায়
লেখাপড়া করতে তুষ্টির আর ভালো লাগে না।
শুধু লেখাপড়া কেন, কোনো নিয়মের ভেতরেই আর বাঁধা পড়ে থাকতে ওর ইচ্ছে করে না।
এ ব্যাপারে তপতী কিছু বললেই চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়, বমিবমি ভাব হয়, শরীর রি-রি করে প্রচণ্ড রাগে ও দুঃখে!
অথচ সারাদিন গিটার নিয়ে বসে থাকতে বললে ওর কোনো আপত্তি নেই। কী যে ভালো লাগে চুপিচুপি গীটারটা নিয়ে ছাদবাগানে চলে যেতে পারলে। পুরো আকাশটা শুধু হাতের মুঠোয় নয়, মাথার ভেতরও যেন খেলা করে।
ছাদ জুড়ে সাজানো অনেকগুলো টব। এর ভেতর মাত্র দুটো ওদের, ভাগাভাগির ছাদে বাকিগুলো অন্য ফ্ল্যাটওলাদের। ওদের বলতে একটি ডালিম আর অন্যটি লেবু। দুটোই ওর খুব আপন।
ছাদের মাঝখানে ক-খানা প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। তুষ্টি একটায় বসে অন্যটির উপর পা ছড়িয়ে দেয়। তারপর গীটারে আঙুল বুলাতে শুরু করে। একসময় আপনমনে গুনগুন করে ওঠে ; ওর সামনে শ্রোতা বলতে ওই দুজন ডালিম আর লেবু। গানের সুরে গাছের চারা দুটো আর চারা থাকে না, দুজন মুগ্ধ দর্শক-শ্রোতা বনে যায়। বিজ্ঞের মতো ওদের মাথা নাড়ানো দেখে তুষ্টি ঠিকই বুঝতে পারে, ওর গুনগুন করা গান ওদের খুব মনে ধরেছে।
সদ্য ফুল এসেছে গাছে ; শীতের দমকা বাতাসে ডালিম আর লেবু ফুলগুলো আনন্দ-শিহরণে দোল খাচ্ছে বারবার। একটা কচি লাল ডালিম সবে মুখ তুলে সূর্যের দিকে তাকাতে শিখেছে। সে-ও মাথা নাড়ে বোদ্ধা শ্রোতার মতো। যেন কত বোঝে !
তুষ্টি জিজ্ঞাসা করে,‘খুব তো মাথা নাড়ছিস ? বল তো কোন গানটা গাইলাম ?’
পাশ থেকে লেবুর কুঁড়িগুলো মাথা দোলায়। আগেভাগেই যেন বলতে চাইছে ,‘ওর সব ভান। পারবে না, দিদি। ও বলতে পারবে না। দেখো। ’
‘তুই খুব পারবি ? বেশি মাতোব্বর।’ ছদ্ম রাগ তুষ্টির গলায়। চোখে আশকারা।
পরক্ষণে বাতাসের ধাক্কা লাগে দুটো কচি গাছের শরীরে। সামলাতে না পেরে একজন অন্যজনের গায়ে এলিয়ে পড়ে। ঝরঝর করে বৃষ্টির মতো শব্দ হয়। তাতেই তুষ্টি আচমকা হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে তারপর বলে,‘তোরা দুটোই গাধা। পারবি না। আমি গাইছিলাম, ওলো সই, ওলো সই। আমার ইচ্ছা করে, তোদের মতো মনের কথা কই। পারলি না তো ? ’
ঠিক এসময় পিছনে এসে দাঁড়ায় ছোটবোন সৃষ্টি। তুষ্টির তুলনায় ওর বয়স মাত্র এক বছর কম। সবাই বলে, তুষ্টি ওর বাবার মতো আর সৃষ্টি মায়ের ফটোকপি। তুষ্টির গায়ের রং খানিকটা কালোয় মিশানো দোয়েল-শ্যামার মতো। কাটা-কাটা নাক-চোখ আর মুখের গড়ন, চেহারায় বেশ একটা আহলাদি ভাব ; সৃষ্টি সাদা গোলাপের মতো ফর্সা। সামান্য মোটা । তবে চোখ দুটো ওর বাক্সময়। দেখলেই মনে হবে বাতাসে দোল খাওয়া দুটো গন্ধরাজ ফুল। সারাক্ষণ বুঝি কিছু বলতে চায়, সঙ্গে অন্তহীন দুষ্টুিমর পাঁচফোড়ন।
ওরা একই স্কুলে পড়ে। তুষ্টি এক ক্লাস উপরে আর সৃষ্টি এক ধাপ নিচে। একসঙ্গে খাওয়া-পড়া, একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া-আসা আর একই সাথে খেলাধুলা-রাগারাগি-বাদানুবাদ সব চলে। তুষ্টির তুলনায় সৃষ্টি সামান্য মেজাজী। সারাক্ষণ সবার উপর খবরদারি করার অভ্যাস। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই রেগে কাঁই। রুটিনের সামান্য ব্যত্যয় হলে তার অনুযোগের অন্ত নেই।
‘তোরে বাপি-মামণি খুঁজতেছে আর তুই এইখানে বইসা-বইসা গাছেরে গান শুনাইতেছিস? আমি কিছু জানি না ভাবিস ? মামণি তোর মাথা ফাটানোর জন্য তৈরি অয়া আছে নিচে। যা তাড়াতাড়ি ?’ এমন ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল যে তুষ্টির গায়ে জ্বর এসে গেল ওর কথায়। নিমেষে মন থেকে শীতের সকালের মিষ্টি আবেশটুকু হারিয়ে গেল। মাথা থেকে আকাশ উধাও।
পড়িমড়ি করে গীটারটা বোনের হাতে গুঁজে দিয়ে ছুটে গেল নিচে।
একই চেয়ারে সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল সৃষ্টি। তুষ্টি আর সৃষ্টি দুজনই একই সংগীত-বিদ্যায়তনের ছাত্রি। লেখাপড়ার মতো তুষ্টি গানে-বাজনাতেও এগিয়ে ; একবার দেখিয়ে দিলে খুব দ্রুত একটা গান কর্ড মিলিয়ে নিজের কণ্ঠে তুলে নিতে জানে ওরা।
সৃষ্টি গাছ দুটোকে তৃপ্তিভরা গলায় বলল,‘ দিদিরে ক্যামনে খেদাইলাম, দেখলি তো ? বল, তোরা কী গান শুনতে চাস আমার কাছে ? বল্ , বল্ । লজ্জা পাচ্ছিস কেন ? বলে ফেল্ ? ’
গাছদুটো হিমেল বাতাসে আগের মতোই লিকলিকে শরীর নাচায়।
সৃষ্টি বলে,‘দূর, দিদির মতন কি আমি পারি ? আমি একটা গান গাই। শুনে দ্যাখ। চোরাকে নিন্দিয়া গৌরিয়া চলি.., ভাল না ? হিঃ হিঃ হিঃ। ’
টবের পলকা গাছগুলো শিরশির করে ওঠে বাতাসের ছোঁয়ায়। সৃষ্টি আপনমনে গান শোনায় ওদের।
এসময় কেউ ছাদে আসে না। আশেপাশের ছাদগুলোও জন-মানবহীন। তাই ওর গলা ছেড়ে গাইতে কোনো বাধা নেই।
মাঘের শীতেও ওরা দু-বোন নির্বিকার। এতোটুকু নিরিবিলি আনন্দের জন্য ওরা সুযোগ পেলেই যখন তখন ছুটে আসে এখানে।
এর চেয়ে নির্জন আর সংগোপন আনন্দ কিছু নেই ওদের জীবনে !
Leave a Reply