শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৫৮ অপরাহ্ন

জীবন আমার বোন (পর্ব-৩৮)

  • Update Time : সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

খোকা মরিয়া হ’য়ে বললে, ‘তুই তাহলে নিশ্চয়ই একথা বোঝাতে চাচ্ছিস আমাকে, দেশ মানে তোর বাবার রেশন শপের যাবতীয় সেদ্ধ চাল বাজারে ব্ল‍্যাক ক’রে গম আর আতপ চাল গেলানো। দেশ মানে তোর ম্যাটিক ফেল চোগা-চাপকান চাপানো বড় ভাইয়ের ফোরকানি কেতাব চড়াদামে বি.এন.আর-এর কাছে গচানো। দেশ মানে তোর বড়বোনের জীবন বীমার দালালি করা, ব্ল‍্যাকডগ গিলে চুর হ’য়ে লাল-নীল-সাদা- কালো টয়োটা-ইম্পালায় মাঝরাতে ঘরে ফেরা। ঠিক আছে। আমি মেনে নিচ্ছি। আর এই সঙ্গে এও মেনে নিচ্ছি এই দেশটা একা তোর, আমি কেউ নই, হ’তে পারি না এই দেশের। দেশ বলতে যদি এই সবই হয় তাহলে দেশদ্রোহী হ’তেও রাজি আছি আমি।’

‘এগুলো কোনো তর্কই নয়, নোংরা কাদা মাখামাখি। এর কোনো মানে হয় না’ অপেক্ষাকৃত ঝিমিয়ে পড়ে মুরাদ, নিষ্প্রভ হ’য়ে আসে। ‘কেন তোর বোনের প্রসঙ্গ উঠেছে ব’লে?’

‘তোর যা খুশি বলে যা, এসব যখন তোর ভালো লাগছে। আমি বাধা দেবার কে?’

‘কেন ড্যাফোডিলে ব’সে বিয়ার গিলতে গিলতে হাউ হাউ ক’রে আমার কাছে এসব কাঁদুনি গাইবার সময় তো খারাপ লাগেনি। নাকি বেহেড মাতাল হ’য়ে পড়েছিলি সেদিন?’

‘বাজে কথা রাখ!’ সিগ্রেট ধরিয়ে হঠাৎ সোজা হ’য়ে বসলো মুরাদ, তেমন কিছুই ঘটেনি এই রকমের একটা ভঙ্গি ক’রে সে বললে, ‘দেশ বলতে আমি কি বুঝি তাই জানতে চাস তুই, বলছি শোন! কখনো বন- উপবন, খাল-বিল, নদ-নদী, পশু-পাখি, ঝড়-বৃষ্টি-রোদ-মানুষ রাজ্যের যাবতীয় জিনিশ নিয়ে যে ভৌগোলিক সীমা, তাই হ’লো দেশ। এক্ষেত্রে পদ্মার ইলিশ কিংবা মাঠের একটা ঘাসফড়িং সুন্দরবনের একটা চিতল হরিণ কিংবা মানিকছড়ি, পাতাছড়ি, হিমছড়ির মোটা মোটা শিশিরবিন্দু কোনো কিছুরই বাদ পড়ার সম্ভাবনা নেই। কোনো কিছুই বাদ পড়ে না। এমন কি স্মৃতি, অর্থাৎ অতীতে এই সীমার আওতায় যা ছিলো তাও কখনো মহাস্থানগড় হ’য়ে কখনো শালবন বিহার হ’য়ে দেশ শব্দটির মধ্যে গ্রথিত হয়ে যায়।’

‘থামলি কেন, চালা’ পা লম্বা ক’রে দিলো খোকা।

কিছুক্ষণের জন্যে থেমে, সিগ্রেটে লম্বা টান দিয়ে একরাশ ধোঁয়া উদ্‌দ্গীরণ ক’রে কুণ্ডলীর ভিতর থেকে গলা তুলে, আমি তোমাকে বধ করতে চাই না আমি তোমাকে বাধ্য করবো শুনতে-এই রকম একটা ভঙ্গিতে পুনরায় শুরু করে মুরাদ, ‘আবার কখনো লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সমষ্টিবদ্ধ মানুষ মিলেমিশে এমনভাবে পৃথিবীর একটি পৃষ্ঠদেশ তৈরি করে যে দেশ শব্দটির রোমান্টিকতা পদপিষ্ঠ হবার ভয়ে সমষ্টির ওই লৌহবন্ধনীর ভিতর প্রবিষ্ট হ’য়ে ইচ্ছেমতো হারিয়ে যায়। আর তখন, এমন একটা মূর্তিমান অবস্থার দরুন পদ্মার ইলিশ, ইস্টিমার, পুরানো পল্টনের বুড়ো অশ্বথ গাছ, আলস্যকুজ, মায়াবন, সবকিছু ঝাপসা হ’য়ে যায়। শারদ আকাশ, বিনম বুঞ্জলতা, দীঘির পাড়ের বিলোল বিকেল, কালো কুচকুচে নৌকোর মতো বেদেনীর তীক্ষ্ণ শরীর, কিছুই আর মনে থাকে না তখন। অথচ এইসব যে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায় তাও নয়–”থামলি কেন, চালা’ পা লম্বা ক’রে দিলো খোকা।

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024