বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৬ অপরাহ্ন

ঢাকাই মসলিন কেন হারিয়ে গেল

  • Update Time : সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪, ৭.২৭ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

আঠার শতকের শেষের দিকে মসলিনের রপ্তানী অনেক কমে যায়। পূর্ব অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে, ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে  ইংরেজদের দিওয়ানী লাভের পর ইংরেজরা অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং ফলে অনেক বিদেশী ব্যবসায়ী ঢাকার ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। নিম্নের তালিকায় এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা করা যায়।

রপ্তানীকারকদের নাম      ১৭৪৭ খৃঃ                            ১৭৯৭ খৃঃ

১। দিল্লীর বাদশাহ             ১,০০,০০০  টাকা                  “

২। মুর্শিদাবাদের নওয়াব  ১,৫০,০০০    “                     “

৩। জগৎ শেঠ                ১,৫০,০০০   “                        “

৪। তুরানী ব্যবসায়ী          ১,০০,০০০   “                       “

৫। পাঠান ব্যবসায়ী            ১,৫০,০০০  “                      “

৬। আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ী  ৫,০০,০০০      “

৭। মোগল ব্যবসায়ী         ৪,০০,০০০   “                 ৬,৩৭,০২৫ টাকা

৮। হিন্দু ব্যবসায়ী             ২,০০,০০০   “

৯। গ্রীক ব্যবসায়ী

১০। ইংরেজ কোম্পানী     ৩,৫০,০০০  “                     ৫,০৭,৩৮৮-৪০”

১১। ইংরেজ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী ২,০০,০০০ “                ২,৫৭,১৩৬.০০ ”

১২। ফরাসী কোম্পানী            ২,৫০,০০০”

১৩। ফরাসী ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী   ৫০,০০০”

১৪। ওলন্দাজ কোম্পানী           ১,০০,০০০”

মোট  ২৮,৫০,০০০”                 ১৪,০১,৫৪৫-৪০”

উপরের তালিকায় পরিষ্কার বুঝা যায় যে,১৭৯৭ খৃষ্টাব্দে মোগল বাদশাহ, বাংলার নওয়াব ও জগৎ শেঠের জন্য মসলিন সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যায়। তুরানী, ফরাসী ও ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরাও ঢাকার রপ্তানী বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়। ইংরেজ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের রপ্তানি ১৭৪৭ খৃষ্টাব্দ থেকে কিছুটা বেড়ে যায় সত্য কিন্তু আর্মেনিয়ান, মোগল, পাঠান ইত্যাদি ব্যবসাীদের রপ্তানী অর্ধেক কমে যায়। ১৭৯৭ খৃষ্টাব্দে ঢাকার সুতী বস্ত্রের মোট রপ্তানী ও ১৭৪৭ খৃষ্টাব্দের মোট রপ্তানী থেকে অর্ধেক নেমে আসে। সুতরাং দ্বিধা ছাড়াই বলা যায় যে, আঠার শতকের শেষ দিকে ঢাকাই মসলিনের রপ্তানী বাণিজ্য অর্ধেক বন্ধ  হয়ে যায়। পরবর্তীতে মসলিন শিল্পের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। ১৮১৩ খৃষ্টাব্দে মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ টাকা মূল্যের ঢাকাই মসলিন ইউরোপে রপ্তানী হয় এবং ১৮১৭ খৃষ্টাব্দে ইউরোপে ঢাকাই মসলিন রপ্তানী প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর পরে মসলিন ইউরোপে পৌঁছলেও ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক নীত হয়; তাকে রপ্তানী বলা চলেনা।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকার মসলিন শিল্প চালু ছিল, যদিও তা বেশ কমে আসে ।ঐ সময়ে যে পরিমাণ মসলিন তৈরী হত তার হিসাব নিম্নে দেওয়া  হলঃ

১। সাদা জমিন বিশিষ্ট (plain) কাপড়ের  উপর ফুল করা ফাইন মসলিন (এগুলি দিল্লী, লখনৌ, নেপাল,মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি এলাকায় নওয়াব, বাদশাহরা ব্যবহার করত; এসব ফাইন মসলিন ঢাকায় কাটা সুতার  দ্বারা তৈরী হত)।         ৫০,০০০ টাকা”

২। মাঝারি এবং সাধারণ শ্রেণীর কাপড় (এগুলি পাক-ভারতের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হত এবং বিলাত থেকে আমদানীকৃত সুতার দ্বারা তৈরী হত)।    ৫,০০,০০০ টাকা”

৩। মুগা ও তসরের সিল্ক মিশ্রিত কাপড় (এগুলি সাধারণতঃ আরব দেশে রপ্তানী হত)।  ২,০০,০০০ টাকা ।

৪। সূচের কাজ করা কাপড় (এগুলি বিদেশে রপ্তানী হত) ৩৬,০০০ টাকা

৫।. মোটা কাপড়, ধুতী, শাড়ী ইত্যাদি (বিলাতী সুতার তৈরী এই কাপড়গুলি দেশেই বিক্রি হত)।

১,৫০,০০০ টাকা।  মোট ৯,৩৬,০০০টাকা ।

উপরের হিসাব দেখে বুঝা যায় যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বস্ত্র শিল্প তিন ভাগের দুই ভাগ কমে গেছে, মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ তখনও চালু ছিল। চালু এক ভাগেরও অধিকাংশ কাপড় ইংলণ্ড থেকে আমদানীকৃত সুতার দ্বারা তৈরী হত। অর্থাৎ মসলিন শিল্প তখন দ্বিধা-বিভক্ত; বয়ন শিল্প ১৩এ এসে ঠেকেছে, সুতা কাটা প্রায় ১/১০-এ নেমে এসেছে। এবং কাপাশি চাষও সেই অনুপাতে ১/১০-এ এসে ঠেকেছে বলা যায়। ১৮৪৩-৪৪ খৃষ্টাব্দে ঢাকায় আমেরিকার কার্পাস চাষের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তাও সফল হয়নি।৪ ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেটের রিপোর্টে দেখা যায় যে, ঢাকায় তখন কার্পাস চাষ নাই বললেই চলে।

১৮৪৪ খৃষ্টাব্দে তৎকালীন ঢাকার অস্থায়ী কমিশনার মিঃ আই. ডানবার ঢাকার মসলিন শিল্পের অবনতির নিম্নরূপ কারণ দর্শানঃ

বিদেশে বাষ্পীয় শক্তির আবিষ্কার এবং বস্ত্র শিল্পে  যন্ত্রপাতির ব্যবহারই ঢাকার বস্ত্র শিল্পের রপ্তানী বাণিজ্যের অবনতির অন্যতম কারণ। এরকম বৈজ্ঞানিক উন্নতির ফলে ইংলেন্ডে অনেক সস্তায় সুতা কাটা ও বস্ত্র বুননের কাজ শুরু হয়। যদিও বিদেশের তুলনায় ঢাকায় শ্রমিকদের বেতন অনেক কম ছিল, ঢাকার শিল্পীরা বিদেশের মত অত অল্প খরচে সুতা কাটতে বা বস্ত্র তৈরী করতে সক্ষম ছিলনা। রপ্তানী বাণিজ্য কমে  যাওয়ার সাথে সাথে মসলিন শিল্পের সাথে জড়িত  অন্যান্য কারিগরি, যেমন সুতা কাটা, কার্পাস চাষ, রিফু করা ইত্যাদিরও অবনতি হয়। আগে সুতা কাটার কাজে অসংখ্য লোক নিয়োজিত ছিল, এখন প্রচুর পরিমাণে বিদেশী সুতা আমদানীর ফলে ঢাকার বাজারে দেশী সুতা প্রায় অদৃশ্য হয়ে পড়েছে। কারণ একই মান বিশিষ্ট বিদেশী সুতা ঢাকাই সুতার চাইতে  অনেক বেশী সস্তা।বছরে প্রায় তিন লক্ষ টাকার  বিদেশী সুতা ঢাকায় আমদানী হয়। দেশী সুতার প্রসার কি ভাবে  কমে  গেছে ,এর  মাধ্যমে তাই প্রমাণিত হয়। বস্ত্র বুনন শিল্প এর চেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু সস্তা বিদেশী কাপড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢাকার কাপড়ও বাজারে টিকতে পারেনা।  বিদেশী কাপড়ের চেয়ে ঢাকাই কাপড় অনেক বেশী ভালো , কিন্তু দেশী গরীব লোকেরা সস্তার মোহে পড়ে গুণের কথা ভুলে যায়।

“বৃটিশ বস্ত্র শিল্পের প্রতিযোগিতায় ঢাকার বস্ত্র শিল্পের অবনতি হয়। বৃটিশ বস্ত্র শিল্পের  সৃষ্টির সময় বৃটিশ কর্তৃপক্ষ পাক-ভারতীয় সুতী বস্তু ইটিশ রপ্তানীর উপর উচ্চ হারে শুল্ক বসায়, তাতে ইংলেন্ডে  ঢাকার সুতী বস্ত্র রপ্তানীতে বাধা জন্মে। কয়েক বছর আগে শুল্কের হার কিছু কমালেও অবস্থার  কোন উন্নতি হয়না। মনে হয় শুষ্ক সম্পূর্ণভাবে  বাদ করলেও ঢাকার বস্ত্র শিল্প এখন আর বৃটিশ বস্ত্র শিল্পের সাথে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারবেনা, কারণ বৃটিশ বস্তু ঢাকাই বস্ত্রের চাইতে দামে সস্তা।

“বর্তমান সরকার ঢাকার বস্ত্র শিল্পের অবনতি রোধ করতে পারবেনা কারণ যে কারণে ঢাকার বস্ত্র শিল্পের অবনতি হয়েছে সে কারণ দূর করা বর্তমান সরকারের ক্ষমতার বাইরে। যতদিন পর্যন্ত  বিদেশে সস্তা সুতা বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হবে ততদিন পর্যন্ত ঢাকার মধ্য সুতার কাটতি হবেনা। অতি উচ্চ হারে শুল্ক আদায় করে বিদেশে সস্তা সুতার আমদানী বন্ধ করা যায়, কিন্তু বর্তমান সরকার এরকম নীতি নির্ধারণ করবে আশা করা বৃথা। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, ঢাকার বস্ত্র শিল্পের আর উন্নতি হবেনা, বরং দিনে দিনে খারাপের দিকে যাবে। অবশেষে যে মসলিন শিল্প পৃথিবীময় সুনাম অর্জন করেছিল, তার নামও আর কেউ মনে রাখবেনা।”

ঢাকার অস্থায়ী কমিশনার ডানবারের উপরের বিবরণে ঢাকার মসলিনের অবনতির প্রধানতঃ তিনটি কারণ নির্দেশিত হয়েছে। ১ম, বিদেশের বস্ত্রশিল্পে বাষ্পীয় শক্তির সাহায্যে যন্ত্রপাতির ব্যবহার, ২য়, বিদেশী  সস্তা সুতার আমদানী এবং ৩য়, উচ্চ হারে শুল্ক আদায়ের ফলে বিদেশে ঢাকাই বস্ত্রের রপ্তানী নিষিদ্ধ করা। ডানবার কর্তৃক নির্দেশিত প্রথম দুটি কারণ নিতান্তই সঙ্গত, কিন্তু তৃতীয় কারণটি খুব যথার্থ বলে মনে হয়না। একথা ঠিক যে, বিলাতে পাক-ভারতের বস্ত্র আমদানী নিষিদ্ধ করে বিদেশে কয়েকটি আইন পাশ করা হয়। ১৭০০ খৃষ্টাব্দে বিলাতের আইন সভায় (Parliament) পাক-ভারতীয় সিঙ্কের তৈরী বস্ত্র এবং কেলিকো বিলাতে আমদানী নিষিদ্ধ করে যে আইন পাশ হয় ঢাকার তৈরী কয়েক প্রকারের মসলিনও তার আওতায় আসে, কারণ বিদেশের ব্যবসায়ী মহলে এবং শাসন কর্তৃপক্ষের কাছে তখন কেলিকো ও ঢাকার অপেক্ষাকৃত কম  ভালো মসলিনের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিলনা। ১৭২০ খৃষ্টাব্দে আর একটি আইনের আমদানীও নিষিদ্ধ হয়, সে কাপড় বলে ছাপানো হউক বা বিদেশে ছাপানো হউক। আইনের অন্য ধারা মতে জামদানীকৃত পাক-ভারতীয় বস্ত্রের উপর শতকরা ১৫ টাকা হারে শুল্ক ধার্য করা হয়। পরে এই শুল্কের পরিমাণ দাঁড়ায় শতকরা ৪৪ টাকা। এসব আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও দেখা যায় আঠার শতকে ইংরেজ কোম্পানী ও অন্যান্য ইংরেজ বণিকরা প্রচুর পরিমাণে ঢাকাই মসলিন রপ্তানী করে। তাছাড়া প্রকৃত পক্ষে ইংলণ্ডে ঢাকাই মসলিনের কাটতির চেয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঢাকাই মসলিনের অনেক বেশী কাটতি ছিল। ইংরেজ কোম্পানীর আঠার শতকের দলিলপত্রে দেখা যায় যে, ১৭৯২ খৃষ্টাব্দের পূর্বে ইংরেজ কোম্পানী প্রতিভাগেভ ৫০ টাকার বেশী দামের মসলিন কখনও রপ্তানী করেনি বা সংগ্রহ করেনি। জন টেলরও বলেন যে, ১৭৯২ খৃষ্টাব্দের পূর্বে ইংরেজ কোম্পানী প্রত্যেকটি  ৫০ টাকার বেশী দামের কাপড় কখনও রপ্তানী করেনি; ১৭৯২ খৃষ্টাব্দের পরে প্রত্যেক খণ্ড ১০০ টাকা দামের কাপড় বেশীর পক্ষে বছরে ১৫০ভাগ রপ্তানী করত।৮ তাহলে দেখা যায় বিদেশের শুল্ক আইন ঢাকার রপ্তানী বাণিজ্যে সামান্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও ঢাকার মসলিন শিল্পের অবনতির বড় কারণ নয়।

সাধারণতঃ মনে করা হয় যে, মসলিন শিল্পের বিলুপ্তির উদ্দেশ্যে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীরা ঢাকার নিপুণ তাঁতিদের হাত কেটে দেয়। ১৯২২ খৃষ্টাব্দে মাদ্রাজের কোন এক দৈনিক পত্রিকার ৩০ শে জানুয়ারী সংখ্যায় প্রচার করা হয় যে,অনেক বড় দুইজন  উচ্চপদের পুলিশ অফিসার এবং একজন কংগ্রেসী স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে নিম্নরূপ কথপোকথন হয়ঃ

ডি আই জি: তোমার পরনের কাপড় কোথা থেকে যোগাড় করেছ? কাপড়গুলি কি খুব কর্কশ নয়?

স্বেচ্ছাসেবক: আমাদের গ্রামে চরকার সুতার দ্বারা এগুলি তৈরী হয়েছে।

ডি আই’ জিঃ কাপড়গুলি ভাল নয়। বিদেশী কাপড় ভাল এবং মোলায়েম। নয় কি?

স্বেচ্ছাসেবক: তোমাদের লোকেরা আমাদের তাঁতিদের আঙ্গুল কেটে না দিলে

আমাদের কাপড়ও ভাল এবং মোলায়েম হত।

ডি আই জি: আমাদের লোক কোথায় তা করেছে?

স্বেচ্ছাসেবক: ঢাকায়।

ডি আই জিঃ (পুলিসের জিলা সুপারিন্টেঞ্জেন্টের দিকে ফিরে) ইহা কি সত্য?

সুপারিন্টেন্ডেন্ট: ইতিহাসে তাই লিখা আছে, ইহা সত্য।

এছাড়া আমাদের দেশেও সাধারণ লোকের বদ্ধমূল ধারণা যে, ইংরেজদের এরূপ দুষ্কৃতির ফলেই মসলিন শিল্প ধ্বংস হয়।’ সোনারগাঁও-এর লোকেরা এখনও একটি পুকুর দেখায় যেখানে মসলিন শিল্পীদের কাটা আঙ্গুল নিক্ষেপিত হয়। ১৯২৫ খৃষ্টাব্দে অধ্যাপক যোগীশ চন্দ্র সিংহ লিখেছেন যে, তিনি এর স্বপক্ষে

কোন প্রমাণ যোগাড় করতে পারেননি। ১০ আমিও এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ বা তথ্য আবিষ্কার করতে পারিনি; পুলিস সুপারিন্টেন্ডেন্ট কর্তৃক উল্লেখিত ইতিহাসও আমার  দখলে হয়নি। আমাদের সংগৃহীত সকল তথ্যাদি ইংরেজদের রক্ষিত দলিলপত্র বা তাদের লিখিত ইতিহাস অবলম্বন করে নেওয়া। ইংরেজরা এই কুকর্মের জন্য দায়ী হলেও তারা তা লিখে রাখতে যাবে কেন? সুতরাং নেতিবাচক প্রমাণের উপর নির্ভর করে জোর করে বলা যায়না যে, ইংরেজরা এমন কাজ করেনি। কিন্তু যোগীশ চন্দ্র সিংহ মহাশয় মনে করেন এবং আমিও স্বীকার করি যে, নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের খাতিরেই ইংরেজরা এরূপ জঘন্য কাজ না করার সম্ভাবনা বেশী। পূর্বে বলা হয়েছে যে, ইংরেজরা তাঁতিদের উপর যথেষ্ট অত্যাচার করেছে, ঠকিয়ে কম মূল্যে তাদের কাপড় কিনেছে, তাঁতিদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের কাজ আদায় করেছে। ১১ কাশিমবাজারের সিল্ক শিল্পীদের উপর এত অত্যাচার ও নির্যাতন করেছে যে, শিল্পীরা কাজ বাদ দেওয়ার জন্য নিজেরা নিজেদের আঙ্গুল কেটে ফেলেছে।  ১৭৬৭ খৃষ্টাব্দে ঢাকাস্থ ইংরেজ তত্ত্বাবধায়ক (Supervisor) কেলছাল ইংরেজ কোম্পানীকে কাপড় সরবরাহ না করার অভিযোগে তাঁতিদের ডেকে এনে  অনেক মারধর করে । ১৩ এসব কথাই সত্য, কিন্তু তবুও তারা মসলিন শিল্পীদের হাত বা আঙ্গুল কেটে ফেলবেএকথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ মসলিন শিল্পীরাই ছিল ইংরেজদের ব্যবসার প্রাণ।

তাঁতিরা বা ঢাকার তাঁতশিল্প ধ্বংস হলে ইংরেজদের ঢাকার ব্যবসাও বন্ধ হওয়ার কথা। তাঁতশিল্প  পুরোপুরি ধ্বংস করা ইংরেজদের লক্ষ্য ছিলনা, তাদের নীতি ছিল তাঁতিদের নিংড়ে নিঃশেষে তাদের রস বের করে নেওয়া। এভাবে নীতি ছিল রস বের করে নেওয়ার পর আসল বিদেশের  শিল্প বিপ্লব এবং এর যথাসম্ভাবী পরিণতি হল  বিদেশের তাঁতে  যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং কলের তাঁতে তৈরী সস্তা সুতা ও সুতী বস্ত্র পাক-ভারতের বাজারে আমদানী। ঢাকার মসলিন শিল্প রক্ষার উপায় ছিল বিদেশের সস্তা সুতা আমদানী নিয়ন্ত্রণকরণ বা ও সুতী বস্ত্রের পাক-ভারতে * নিষিদ্ধকরণ। বিদেশের  আইন সভা বিদেশী শিল্প সংরক্ষণের জন্য পাক-ভারতীয় বস্ত্র  বিদেশে আমদানী নিয়ন্ত্রণ করেছিল, কিন্তু  তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তারা অনুরূপ নীতি গ্রহণ করার কোন যুক্তি খুঁজে পায়নি। ডানবার যখন বলেছিলেন, “বর্তমান সরকার ঢাকার বস্ত্র শিল্পের অবনতি রোধ করতে পারবেনা, কারণ যে কারণে ঢাকার বস্ত্র শিল্পের অবনতি হয়েছে সে কারণ দূর করা বর্তমান সরকারের ক্ষমতার বাইরে” তখন তিনি একথাই স্মরণ করেছিলেন। ফলে ঢাকার মসলিন শিল্প আপনাআপনিই শুকিয়ে গেল।

উপরে ঢাকার মসলিন শিল্পের বিলুপ্তির কারণ স্বরূপ ইংরেজদের দায়িত্ব বর্ণনা করা হল কিন্তু আমাদের দেশী লোকদের দায়িত্বও কম নয়। মোগল বাদশাহ বা তাঁর অমাত্যবর্গ ঢাকার মসলিনের রপ্তানী বাণিজ্যের শুল্ক আদায় করে তার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করেছেন, মলবুস খাস সংগ্রহ করে তাঁদের সৌন্দর্য ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ  করেছেন কিন্তু মসলিন শিল্পের বা তাঁতিদের অবস্থার উন্নতির দিকে কোন নজর দেননি। ব্যবসায়ীরা হাজার হাজার টাকা আয় করেছে কিন্তু তারাও সেদিকে লক্ষ্য করার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাঁতিরা দিনরাত খেটে কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করেছে, কিন্তু ঢাকার তাঁতিদের মধ্যে একজন হারগ্রীস কি আর্করাইট জন্ম নেয়নি। মান্ধাতার আমলের টাকু, মাকু এবং তাঁত শেষ পর্যন্তই তাদের সম্বল ছিল। কোন মহল থেকে, কোন দিন, কোন কেউ তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসবে, এ ই বোধ কোনদিন তাদের মনে জাগেনি। ফল যা হবার তাই হয়েছে, কলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হাতের টাকু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। মোগল রাজশক্তির পতনও মসলিন শিল্পের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ।

মোগলদের পতন এবং ইংরেজ রাজশক্তির উত্থানের ফলে পাক-ভারত উপমহাদেশ বিলাতের উপনিবেশে পরিণত হল। পাক-ভারত উপমহাদেশ কোনরা তাদের বিলাতী শিল্পের কাঁচা মালের আড়ত এবং পাকা মালের বাজারে পরিণত করে লাভবান হল। এদিক থেকে বিচার না করলেও বলতে হয় মোগলরা ঢাকার মসলিন শিল্পের বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মোগলদের অনুবর্তী বৃটিশ শাসন কর্তৃপক্ষের কাছে মসলিন শিল্প কোন পৃষ্ঠ পোষণ পায়নি। প্রকৃতপক্ষে ঢাকাই মসলিনের মত দামী ও সূক্ষ্ম বস্ত্র শিল্প রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষণ ছাড়া টিকতে পারেনা। সুতরাং মোগলদের পৃষ্ঠপোষণ অন্তর্হিত হওয়ায় মসলিন শিল্পেরও অবনতি হয়। এসব কারণগুলি বাদ দিলেও ঢাকার মসলিন শিল্পের মত মাথাভারী শিল্প হয়তঃ বেশীদিন বাঁচতে পারতনা। যে শিল্প, যারা প্রাণ দিয়ে শিল্প গড়ে তোলে তাদের অনাহারে অনটনে রেখে শুধু গুটিকয়েক মুনাফাখোরী ব্যবসায়ীর সিন্ধুক পূর্ণ করে সে শিল্পের ভবিষ্যত কোথায়?

ঢাকার মসলিন শিল্প কি এখন নূতন করে চালু করা সম্ভব? ১৯২৫ খৃষ্টাব্দে যোগীশ চন্দ্র সিংহ এর উত্তরে বলেছিলেন যে, ঢাকার ফুটী কার্পাস উৎপাদন করা সম্ভব, ঢাকার কারিগররাও ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিপুণ হয়ে উঠতে পারবে কিন্তু মসলিনের মত দামী সূতী বস্ত্রের বাজার পাওয়া অসম্ভব। তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে, হয়তঃ মোগলদের অনুবর্তী বৃটিশ ভাইসরয় এবং গভর্ণররা মসলিন ব্যবহার করার প্রয়াস পাবেননা। এখনও উত্তরে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে হয়। বর্তমান শাসন কর্তৃপক্ষ, শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, ধনী-বিত্তশালী সবাই যদি নাইলন, টেরিলিন এবং কারেলিন ইত্যাদি ছেড়ে মসলিন ব্যবহারে মনযোগী হয়, তাহলেই হয়তঃ একাগ্র চেষ্টার ফলে মসলিন শিল্প পুনর্জীবিত করা সম্ভব। কিন্তু সে সম্ভাবনা খুবই কম এবং ঢাকার মসলিন শিল্পের পুনর্জীবন কামনা করাও বিলাসিতা মাত্র। ঢাকার মসলিন এখন গবেষণার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দে ডানবার ঠিকই বলেছিলেন, “অবশেষে যে মসলিন শিল্প পৃথিবীময় সুনাম অর্জন করেছিল, তার নামও আর কেউ মনে রাখবেনা।”

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

 

 

 

 

 

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024