শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩১ অপরাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (পর্ব-১৫)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

মণীশ রায়

তাপস ওর বস্ত্র-কারখানায় বসে হিসাব কষছিল।

একা মানুষ। একা-একাই সব সামলাতে হয়।

মফস্বলের  একটা পার্টি আসবার কথা আজ। বাচ্চাদের জন্য তিনশো গেঞ্জি কিনবে তারা। পরিচিত লোক। আগেভাগেই ফিফটি পারসেন্ট টাকা আগাম জমা করে গেছে।  মালামাল  প্রস্তুত। এখন হিসাব কষে বাকি টাকাটা নিয়ে মালামাল বুঝিয়ে দিলেই হল। ওদের জন্যেই বসে রয়েছে সে। মোবাইলে দুবার এরই ভেতর কথা হয়ে গেছে ওদের।

ঠিক এসময় একটা রিং এল ওর মোবাইলে। অপরিচিত নম্বর। খানিকক্ষণ

ইতস্তত করে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে এক মহিলা বলে উঠলেন,‘আপনি তাপসবাবু ? কাল একটু আসতে পারবেন আপনার মেয়ের স্কুলে ? সরাসরি প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে চলে আসবেন। আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসতে পারলে ভাল হয়। বিষয়টা জরুরি।’ লাইনটা কেটে দিল। মহিলার কণ্ঠস্বরটি খনখনে। চূড়ান্ত বিরক্তি কণ্ঠ জুড়ে।

কথা বলবার ঢং-টি তাপসের ভালো লাগল না। নিজের পরিচয় তো দিলই না, উল্টো  সামান্য সৌজন্যজন্যবোধ পর্যন্ত অনুপস্থিত কথার ধরনে। মাসে মাসে বেতন ও বিবিধ খরচ বাবদ কাড়ি-কাড়ি টাকা দেয়া সত্তে¡ও এ নামজাদা বেসরকারি বিদ্যায়তনটি যাঁরা চালান, তাঁদের ন্যূনতম ভদ্রতাবোধ থাকবে না অভিভাবকদের প্রতি?

পরক্ষণে উল্টাপাল্টা নানা ভাবনায় মন অস্থির হল। সব ফেলে চলে এল বাসায়। তপতীকে জিজ্ঞাসা করল এ বিষয়ে। সে একেবারে আকাশ থকে পড়ে। তাপস তাতে বিরক্ত হয়। সে আশা করেছিল, তপতী অন্তত কিছু একটা ইঙ্গিত দিতে পারবে এ বিষয়ে। এ নিয়ে খোঁচা দিতেই বেধে গেল ঝগড়া। সেই ঝগড়া মেয়েদের স্কুল থেকে বাসায় ফেরা অবধি জিইয়ে রাখে ওরা।

তুষ্টি ঘরে পা দিতে না দিতেই মায়ের অস্থির-উদভ্রান্ত জিজ্ঞাসা,‘ স্কুলে কি হয়েছে ?’

‘কি হবে ?’ গা-ছাড়া উত্তর।

‘স্কুল থেকে যে জানাল আমাদের যেতে ? কি হয়েছে ?’

‘আমি কি জানি ? শুধু আমাকেই দেখো। সৃষ্টিকে জিজ্ঞাসা কর ?’ বলে সে নিজের কক্ষে ঢুকে পড়ল। ভয়ে তপতীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ে ধ্বক করে ওঠে।

তপতী একই কথা ছোট মেয়েকেও জিজ্ঞাসা করে। সে-ও কোন সদুত্তর দিতে পারল না।

তাপস-তপতীর উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল। কী এমন হয়েছে যে স্কুলে ওদের ডেকে পাঠিয়েছে Ñ এসব ভাবতে ভাবতে আর নিজেদের ভেতর ঝগড়া করে অর্ধেক রাত পার করে দিল স্বামী-স্ত্রী।

সকালে সোজা ওরা গিয়ে উপস্থিত প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে। চোখে-মুখে  উদ্বেগ-উৎকন্ঠার ছায়া। তুষ্টি-সৃষ্টি দূরে দাঁড়ানো। কাঁচুমাচু, চোখেমুখে অপরাধী  ভাব।

‘আদাব’ বলে ভেতরে ঢুকতেই রিতা আপা প্রধান শিক্ষিকার কানে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন। সঙ্গে সঙ্গে খনখন করে প্রধান শিক্ষিকা বলে উঠলেন,‘ তুষ্টি আপনাদের কন্যা ?’ এমন অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন যে মনে হল , তুষ্টি বড় কোন অপরাধ করে ফেলেছেন। ওদের বুক ঢিপঢিপ করছে অজানা ভয়ে।

‘শুনুন, আমাদের স্কুলের কিছু নিয়ম-কানুন আছে।  আপনার মেয়ে তুষ্টি ক্লাসরুমে মোটেই মনোযোগী নয়। কিছুটা পাগলামি আছে ওর ভেতর। প্রায়ই বিড়বিড় করে কিছু বলে আপনমনে। ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। এক মাস সময় দিলাম। ক্লাস টীচার যদি তারপরও কমপ্লেন করেন, তইলে আমারা টিসি দিতে বাধ্য হব। ওকে ?’ বলে ফিসফিস করা রিতা আপার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওরা যে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাঁচুমাচু হয়ে, সেদিকে খেয়ালই নেই। অনেক্ষণ পর বললেন,‘ এবার আপনারা যেতে পারেন। ’

বাসায় ফিরে তাপসের মুখে কোনো কথা নেই। চোখের সামনে সবকিছু বড় অর্থহীন লাগছে। মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ছেলের আশা করেনি কখনও। অথচ ওদের গাফিলতির কারণে ওকে এখন কষ্ট পেতে হচ্ছে। অপমানিত হচ্ছে যখন তখন ?

তপতী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও মনটা বিষণœ হয়ে থাকে সারাক্ষণ। স্বামীকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না সত্য। কিন্তু একরাশ বেদনা আর হতাশায় ভেতরটা বিষিয়ে উঠছে তার। খেয়ে না খেয়ে এত যে পরিশ্রম, সবই তাহলে বৃথা ?

সন্ধ্যার পর তাপস মেয়েদের নিয়ে বসল। গুরুগম্ভীর মুখ তার। পাশে তপতী। তারও বেদনার্ত চেহারা।

তুষ্টির দিকে তাকিয়ে তাপস বলে উঠল,‘সবই তো তোমরা জানো। বাবা হিসাবে আমার এখন কী করা উচিত বল ?’

তুষ্টি মাথা নিচু করে রয়েছে। নিজের জন্যে নয়, ওর বাবা কষ্ট পাচ্ছে Ñ একথাটা ভাবতেই ওর বুকটা টনটন করে উঠছে অসহ্য ব্যথায়।

‘কথা বল ? কথা না বললে আমি কিভাবে বুঝব তোমরা কি ভাবছো?’

তুষ্টি এবার মাথা তুলে তাকাল প্রিয় বাবার মুখের দিকে। তারপর বলে উঠল,‘এই স্কুলটা আমাকে স্যুট করছে না, বাপি। আমাকে অন্য স্কুলে ভর্তি করে দাও ? প্লিজ ?’ এমনভাবে বলল যেন একটা ছোট খেলনা কেনার বায়না ধরেছে বাবার কাছে।

‘অন্য স্কুলে ভর্তি হলে তুমি পড়ায় মনোযোগী হবে ? শিউর ? আর স্কুলে ভর্তি হওয়া অতই সোজা ? তুমি জানো কত ধরপাকড়, কত টাকাপয়সার ব্যপার আছে এতে ? ’ তাপস ক্ষোভ ঝরায়।

তপতী এবার স্বামীর কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায়,‘সব মোয়া ভাবে তোমার মেয়ে? কত কষ্ট করে, কত কোচিং করে এই স্কুলটায় ভর্তি করাতে পেরেছি তোদের। এখন বলিস ছেড়ে দিতে। সবকিছু খেলা ভাবিস, না ?’ চেঁচিয়ে ওঠেন মা।

তাপস আর কিছু বলে না। কেবলি মনে হতে থাকে, ওর স্বপ্ন-সাধগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্যে এত যে পরিশ্রম, বাইয়ারের হাতে-পায়ে ধরে অর্ডার নেয়া, শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো এবং তারপর  চাহিদা মতন ওদের হাতে মালামাল তুলে দেবার যে তীব্র ও প্রাণপন কষ্ট Ñ কেন যেন সব বৃথা বলে মনে হচ্ছে ।

সে নিজের বিছানায় এসে বিপর্যস্ত শরীর-মন নিয়ে শুয়ে পড়ে। হঠাৎ ওর ঘুম ভেঙে যায়। মাথার কাছে বসে তুষ্টি কাঁদছে। টপটপ করে চোখ থেকে জল ঝরছে ওর।

লাফ মেরে বিছানায় উঠে বসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুকে। মুখে বলে ,‘ কি হয়েছে রে মেয়ে ? কাঁদছিস কেন ?’

‘বাবা, আমি এখন থেকে পড়ায় মনোযোগী হব। কথা দিচ্ছি। সত্যি বলছি।’

তাপস ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024