একটি আর্ন্তজাতিক রিপোর্টিং প্রশিক্ষণ সেমিনারে বাংলাদেশের একমাত্র বক্তা হিসেবে প্রখ্যাত সাংবাদিক আতউস সামাদ দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন। অন্য সকল বক্তার থেকে তাঁর বক্তব্যে পার্থক্য ছিলো অনেক বেশি। কারণ, তাঁর বক্তব্য ছিলো রিয়েল লাইফ নির্ভর। সেমিনারে অংশ নেয়া দেশি ও বিদেশীরা তাঁর বক্তব্য শেষে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “স্যার আপনি যেভাবে রিপোর্টিং করতে বলছেন, এ কাজ করা কীভাবে সম্ভব হবে, কীভাবে আমরা নিজেদেরকে প্রস্তুত করবো? তিনি তার নির্মল হাসিটা মেলে দিয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, “মানুষকে সম্মান করতে শেখো”।
আর মাত্র কয়েকটি বছর গেলে সাংবাদিকতার পথে পাঁচ দশক পথ হাঁটা হবে। অন্য কোন কিছু না করে এই পেশাকে আঁকড়ে থেকেও সাংবাদিকতা ওইভাবে করতে পারেনি। এর মূল কারণ যেমন নিজের অযোগ্যতা তেমনি আমাদের জীবনের বেশিভাগ সময় গেছে গণতন্ত্রহীনতার মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতা সিনোনিমস। যে কারণে কখনও কখনও মনে হয়, সত্যি যারা আমেরিকা, বৃটেন বা জাপানে সাংবাদিকতা করে তারা সৌভাগ্যবান।
তারপরেও এই দীর্ঘ পথ হেঁটে এখন মনে হয়, যদি কখনও কোন সত্য তথ্য জোগাড় করতে সমর্থ হয়ে থাকি- যদি কোন রিপোর্ট বা লেখা সামান্যতম লিখেতে সমর্থ হয়ে থাকি, তা কেবল মানুষকে সম্মান করে, অন্য কোন পথে নয়।
বাস্তবে মানুষের এই সম্মানবোধটা তার কোথায় থাকে- মগজে, মননে- না সহজাত- এ নিয়ে চিন্তা করার মতো শিক্ষার গভীরতা আমার নেই। তবে যখন দেখি, বাস্তবে সব থেকে বেশি আত্মসম্মানে সচেতন হয় শিশুরা, তখন মনে হয় এই আত্মসম্মান বোধটি মানুষের সহজাত। মানব সভ্যতার ইতিহাসের পাতা খুঁজলেও ঠিক এমনই মনে হয়। শিশুদের পরে এই আত্মসম্মান বোধ তুলনামূলক বেশি থাকে তরুণদের। তারপরে লক্ষ্য করে দেখেছি বেশিভাগ ক্ষেত্রে মানুষের এই আত্মসম্মানের জায়গাটার সঙ্গে একটা অব্যবহৃত পাথরের মিল আছে। অব্যবহৃত পাথরে যেমন শ্যাওলা পড়ে তেমনি মানুষের আত্মসম্মানের স্থানটির ওপরেও যত সময় যেতে থাকে ততই শ্যাওলা পড়তে থাকে। পাথরের ওপর দিয়ে জল চলে নিত্য তারপরেও কেন যে শ্যাওলা পড়ে তা বোঝার পথ যেমন কম; তেমনি শ্যাওলাগুলো জলের স্রোতের থেকে শক্তিশালী হয় কীভাবে এটাও এক রহস্য।
অন্যদিকে, মানুষের আত্মসম্মান বোধের জায়গাগুলো লোভ, আপস, মোহ প্রভৃতি রিপু নামক শ্যাওলা দিয়ে ঢেকে যায় কেন তাও এক রহস্য। কেন বেশিক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে একটা চক চকে ভারী পাথর হিসেবে রাখতে পারে না- এ এক কঠিন মনোজাগতিক অঙ্ক!
এই অঙ্কে ফেলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম বড় ঘটনা মুক্তিসংগ্রামকেও বিচার করার চেষ্টা করেছি। ক্ষুদ্র বিবেচনায় মনে হয়, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের যে বৈষম্যের কথা আমরা বলি, এই বৈষ্যমের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় বিষয় ছিলো আত্মসম্মান বোধ। অর্থনৈতিক বৈষম্য নিয়ে অনেক কথা বলা হয়- তবে ষাটের দশকের স্থিতিশীল অর্থনীতিতে পূ্র্ব পাকিস্তান খুব খারাপ ছিলো না। তবুও পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মূল বৈষম্য দেখতে পেতো, পাকিস্তানি শাসক গোষ্টির একটি শ্রেণীর আচরণে। বিশেষ করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্টির একটি শ্রেনীর আচরণে শিক্ষিত তরুণ শ্রেণী তখন নিজেকে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক মনে করছিলো। আর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্টির আচরণ প্রতি মুহূর্তে সেই সলতেটাই উসকে দিচ্ছিলো।
তাই অনান্য দেশের স্বাধীনতার মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতারও মূলে ছিলো মর্যাদা, আত্মসম্মান, সমঅধিকার। কেউ সুপিরিয়র নয়। সকলেই একই সমতলে।
যদিও একদিনে সম্ভব নয় তারপরেও স্বাধীন জাতির স্বাধীনতার মূল শর্তই হলো ওই দেশের শিশুর ভেতর যে সহজাত সম্মানবোধ থাকে তা যেন স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে। কেউ যেন সে সম্মানে আঘাত না করে। আর এ বিষয়ে রাষ্ট্র ও পরিবার সকলকেই সচেতন হতে হয়।
Leave a Reply