সারাক্ষণ ডেস্ক
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় পিকআপ ট্রাক চালান নাসির উদ্দিন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনে তাঁর স্ত্রী বাবলী ছোট ছোট চার কন্যাসন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পাশেই অঝোরে কাঁদছিলেন নাসিরের মা রুমেলা আক্তার। তাঁরা জানান, ডিবি পরিচয়ে কয়েকজন গিয়ে বাসা থেকে নাসিরকে তুলে এনেছেন। তাঁরা নাসিরের খোঁজে এসেছেন।
শুধু নাসির নন, রাজধানীতে এখন প্রতিদিনই এমন অসংখ্য স্বজন ভিড় করছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়, বিভিন্ন থানা ও আদালতের সামনে। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ডিবি অফিসের সামনে এমন ৯টি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। আগের দিনও এমন আরও চারটি পরিবারকে পাওয়া যায় ডিবি কার্যালয়ের ফটকের সামনে। তাঁদের বেশির ভাগই দিনমজুর, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের স্বজন।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, তাঁরা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করছেন না। তিনি সচিবালয়ে গতকাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ এবং সাক্ষীসাবুদ নিয়ে যাদের শনাক্ত করা গেছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ভুলক্রমে যদি কেউ নিয়ে আসে তাহলে থানায় যাচাই করে যাঁদের নিরপরাধ মনে হচ্ছে, তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কাজেই গণগ্রেপ্তার হচ্ছে না।
ঢাকার আদালত সূত্রে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকায় ২৭০টি মামলায় ২ হাজার ৮৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক হিসাব বলছে, গত সোমবার পর্যন্ত রাজধানীতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ২৪৩টি মামলায় মোট ২ হাজার ৬৩০ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৮৪ জনেরই কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি, যা মোট গ্রেপ্তারের ৮৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ। অর্থাৎ কোনো দলের সঙ্গে তাঁদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষ।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বিএনপির নেতা-কর্মী আছেন ২৬৯ জন, জামায়াতের ৬৩ এবং শিবিরের আছেন ১০ জন। এ ছাড়া গণ অধিকার পরিষদের ৩ এবং জেপির আছেন ১ জন, যা মোট গ্রেপ্তারের ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এক বিচারপতি অসুস্থ থাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা ও কোটাবিরোধী আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তির নির্দেশনা চেয়ে রিটের আদেশ আজ হবে না। বুধবার (৩১ জুলাই) সকালে বিষয়টি জানা গেছে।
সংশিষ্ট আদালতের কনিষ্ঠ বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন প্রধান বিচারপতির কাছে ছুটি নেন। সেখানে অসুস্থতার কারণ দেখান তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে প্রধান বিচারপতির দপ্তর।
এর আগে হাইকোর্টের ওই বেঞ্চ বলেছিলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা লজ্জিত।
মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই কথা বলেন।
আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি না চালানোর নির্দেশনা চেয়ে ও কোটাবিরোধী আন্দোলনের ৬ জন সমন্বয়কের ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তির নির্দেশনা চেয়ে রিটের শুনানিতে আদালত এই কথা বলেন।
আদালত বলেন, সংবিধান ও আইনে সব বিষয় লেখা আছে। কিন্তু আমরা কেউ সংবিধান, আইন মেনে চলছি না।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান পান্না, ব্যারিস্টার অনীক আর হক ও অ্যাডভোকেট মানজুর আল মতিন প্রীতম।
বাংলাদেশের সভরেন ক্রেডিট রেটিং (সার্বভৌম ঋণমান) অবনমন করেছে আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষায় এতদিন দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং ছিল ‘বিবি মাইনাস’ (BB-)। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এ ঋণমান কমিয়ে ‘বি প্লাস’ (B+) করে দেয়া হয়েছে। তবে স্বল্প মেয়াদে ঋণমান অপরিবর্তিত (B) রাখার পাশাপাশি আউটলুক ‘স্থিতিশীল’ রেখেছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে এসঅ্যান্ডপির পক্ষ থেকে গতকালই এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে দেশের বহিস্থ চাপ মোকাবেলায় তারল্য সক্ষমতা কমে আসার পাশাপাশি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও এতে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানি, ইন্টারনেট বন্ধ ও কারফিউ জারির প্রেক্ষাপটে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তার কথাও তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার বিষয়টি ভবিষ্যতে নীতি পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা সংক্রান্ত পূর্বাভাস দেয়াকে কঠিন করে তুলতে পারে বলে এসঅ্যান্ডপির বক্তব্যে উঠে আসে। এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মতো সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ নির্বাচন বয়কট করেছিল। ঐতিহাসিকভাবে প্রধান এ দুই দলের মধ্যে তীব্র বিরোধ রয়েছে। সংসদে সরকারকে বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয় খুবই সামান্য। এজন্য সরকারের কার্যক্রমে জবাবদিহিতা বা ভারসাম্য আনার সুযোগও সীমিত।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনে দুই শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বর্তমানে বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আদালতের রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের পর এ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনের জবাবে সরকার টেলিকমিউনিকেশন ব্ল্যাকআউট ও দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে। এরপর ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট অধিকাংশ কোটা বাতিল করে রায় ঘোষণা করেন।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের ভাষ্যমতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের বহিস্থ চাপ মোকাবেলায় তারল্য সক্ষমতা কমে আসার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ২০২৪ সালের মে মাসে গৃহীত সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিপদক্ষেপগুলো (যেমন বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ নীতির বাস্তবায়ন, টাকার অবমূল্যায়ন ও কঠোর মুদ্রানীতির প্রয়োগ) এ চাপ কিছুটা প্রশমন করতে পারে, তবে সেটিও ঘটতে পারে ধীরে ধীরে।
ছাত্র বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ ও সহিংসতার জন্য বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি নিন্দা জানিয়ে একটি বিবৃতি জারি করেছেন মার্কিন সিনেটর ও বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির চেয়ারম্যান বেন কার্ডিন ও কোরি বুকার। এই ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে একটি আধাসামরিক ইউনিট রয়েছে যার সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ইতিমধ্যেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশে অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবের প্রতিবাদে এবং বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য সংরক্ষিত সরকারি চাকরিতে সরকারের অসম কোটা ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছে। বিক্ষোভকারীদের ন্যায্য অভিযোগে সাড়া দেবার পরিবর্তে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী নৃশংস বল প্রয়োগ করে শত শত বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে এবং আরও হাজার হাজারকে গ্রেপ্তার ও আহত করে। শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ ও প্রতিবাদ করার অধিকার গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম ভিত্তি। আমরা নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে অবিলম্বে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের অধিকারকে সম্মান এবং তাদের অভিযোগের সমাধান করার জন্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সাহসী ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়িয়েছে যারা তাদের মর্যাদার জন্য এবং একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম করছে। আমরা বাংলাদেশে মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলতে থাকব এবং এই ধরনের অপব্যবহারের সাথে জড়িতদের জবাবদিহি চাই।
Leave a Reply