প্রণয় শর্মা
একটি আকস্মিক রাজনৈতিক পরিবর্তন নেপালকে বেইজিংয়ের আরো ঘনিষ্ঠ করে তুলছে, যা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়াইরত দুই বিশাল প্রতিবেশী ভারত ও চীনের মধ্যরে প্রতিদ্বদ্ধিতাকে আরো উসকে দিচ্ছে।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী, পুষ্প কমল দাহাল, যিনি প্রচন্ড নামে পরিচিত, গত সপ্তাহে তাঁর জোটের ভারতপন্থী বলে পরিচতি নেপালি কংগ্রেসকে ক্ষমতার অংশীদারীত্ব থেকে বাদ দিয়েছেন। এবং চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র কে.পি. শর্মা ওলি, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি’র(ইউনাইটেড মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) প্রধানের সাথে সঙ্গে জোট করে নতুন সরকার গড়েছেন। , এটা বাস্তবে ভারতের জন্যে কমবেশি একটা কূটনৈতিক ধাক্কাও বলা যেতে পারে। । আরো আশ্চর্যের বিষয়, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে।
নেপালের দুই কমিউনিস্ট পার্টির মিলিত এই সরকার অনেকটা মালদ্বীপের নতুন সরকার যেমন ” ইন্ডিয়া ফার্স্ট” নীতির অবসান ঘটাতে যাচ্ছে সেটাকেই অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে।
কাঠমাণ্ডু-ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক যুবরাজ ঘিমিরে বলেন, যদিও ভারত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী তারপরেও নেপালের কিছু কিছু রাজনৈতিক বাস্তবে ভারতকে ওইভাবে পছন্দ করেন না। তারা একটি কাউন্টার ব্যালান্সের জন্যে ও ভারতের প্রভাব কমানোর জন্যে কখনও কখনও চায়নার দিকে ঝোঁকার পক্ষপাতি।
শ্রীলঙ্কাতে ভারত যে কূটনৈতিক মাঠ হারিয়েছিল তা পুনরুদ্ধার করেছে এবং ভুটান এবং বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি পুনর্নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তারপরেও সেখানে বিরোধীরা ভারতের প্রভাব কমানোর ডাক দিয়েছে। অন্যদিকে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী সপ্তাহে ভুটান সফরে যাচ্ছেন, যেখানে তার সরকার চীনা অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং সিনো-ভুটানি
ভূখণ্ড চুক্তির দ্রুত সমাপ্তির জন্য চাপ দিচ্ছে।
তবে নেপালের সিনো-ভারতীয় টানাপোড়েন — যার মধ্যে ভূখণ্ড এবং সীমানা দাবিগুলি নিয়ে একটা স্নায়ূ যুদ্ধ রয়ে গেছে সেটাকে বাড়ানো বা উত্তপ্ত করার একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছে এটা সত্য ।
নেপালের এই ঘটনা নিয়ে ভারত এখনও কোন অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে এটা যে ভারতের জন্যে একটা বড় কূটনৈতিক ধাক্কা তা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তাছাড়া নেপালের নতুন সরকারে আরো কয়েকটি ছোট ছোট কমিউনিস্ট পার্টি যোগ দিতে পারে।
অন্যদিকে চায়না নেপালের এই নতুন সরকারকে সঙ্গে সঙ্গে অভিনন্দন জানিয়েছে এবং নতুন সরকার গঠনের কয়েকদিনের মধ্যেই চায়নার সামরিক প্রতিনিধি দল সে দেশ সফর করে । এবং তারা চায়না- নেপাল সামরিক সহায়তা জোরদারের পক্ষে মত দিয়েছে।
দিল্লি’র মতো ওয়াশিংটনের জন্যও নেপালের এই কমিউনিস্ট সরকার একটি ব্যর্থতার ধাক্কা। বিশেষজ্ঞ ঘিমেরির মতে, ওয়াশিংটন ও দিল্লি মূলত কাটমুন্ডুতে এই পরিবর্তন ঠেকানোর জন্যে গত কয়েক মাস ধরে কাজ করেছে। কিন্তু পারেনি। ঘিমেরি আরো মনে করেন, এখানে প্রচন্ডের পক্ষে সেক্যুলারইজমও কাজ করেছে। কারণ, নেপালে আবার হিন্দুত্ব ফিরে আসার প্রতি ভারতের একটা নীরব সমর্থন ছিলো। অনেকে এটা হিন্দু রাজতন্ত্র পুনর্স্থাপনের একটি পদক্ষেপও মনে করছিলো।
নেপালের নেতা, প্রচন্ড বাস্তবে একজন মাওবাদী গেরিলা। যিনি দীর্ঘ সময় নেপালের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ২০০৬ সালে ভারতের মধ্যস্ততায় তার যুদ্ধের অবসান ঘটে। এবং এরই দুই বছর পর ওই দেশের ২৪০ বছরের পুরানো রাজতন্ত্র বাতিল করা হয় এবং নেপালে প্রচন্ডের নেতৃত্বের সরকারের প্রথম মেয়াদেই দেশটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
নেপালের রাজনৈতিক জোটগুলোর ওই ভাবে দীর্ঘস্থায়ী হবার কোন ইতিহাস নেই। তাছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে তিব্বত আগ্রাসন ও তার প্রতিরোধ সব মিলিয়ে নেপালে চায়ান বিরোধীতার একটা অবস্থান আছে। তবে এটাও ঠিক চায়নার বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পের উন্নয়নের ধারায় নেপাল ঢুকে গেছে। কিছু কিছু বড় প্রজেক্ট থেকে নেপাল ঋনের ভয়ে সরে আসার একটা উদ্যোগের মধ্যে ছিলো কিন্তু বর্তমান সরকার আবার চায়নার কাছে নতুন ঋন সহায়তা চেয়েছে।
তবে নেপালে ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন মি. রঞ্জিত রায়-এর মতে নেপালের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ চায়নার ঋণ নিয়ে উদ্বিগ্ন।কারণ নেপালে মূলত চায়নার বানিজ্যিক ঋনেই অবকাঠামোর কাজ হয়েছে। এ কারণে সেখানকার রাজনীতিবিদরা মনে করেন নেপাল শ্রীলংকার মতো ঋণের ফাঁদে পড়ে যেতে পারে।
এ কারণে রাজনৈতিক বিশ্লেষক দেব রাজ দাহাল মনে করেন, বর্তমানের এই নেপালের পরিবর্তন মানে এ নয় যে ভারত একেবারেই নেপাল থেকে ছিটকে পড়েছে।কারণ চায়নাও চাইবে না নেপালকে একা বহন করতে।
এছাড়াও নেপালি নাগরিকরা ১৯৫০ সালের একটি চুক্তির ফলে ভারতে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে। ওই চুক্তি বলে তারা ভারতে কাজ করতে, বসবাস করতে এবং বিনিয়োগ করতে এবং ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতেও যোগ দিতে পারে।
তাছাড়া ল্যান্ডলক এই দেশটিকে ভারত তাদের জল ও স্থল বন্দর এমনকি তাদের রাস্তাও ব্যবহার করতে দেয়। তাছাড়া সেদেশে সবথেকে বড় বিনিয়োগকারী দেশও ভারত।
নতুন জোটে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলির উপস্থিতি অনেকের মতে উদ্বিগ্নতার একটা কারণ। যেহেতু তার আমলে তিনি তার দেশকে অনেক বেশি চায়নার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। যার ফলে ভারতকে তার এই ছোট প্রতিবেশী দেশটির ওপর একটি অর্থনৈতিক অবরোধ চালু করতে হয়েছিলো।
অন্যদিকে যদিও নেপালের বর্তমান নেতা প্রচন্ডকেও প্রো-চীন হিসেবে দেখা হয় তবে এটাও ঠিক , তিনি বছরের পর বছর ধরে দিল্লির সাথে সম্পর্ক উন্নত করার পথটি তৈরি করেন।
এবং উভয় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। গত বছর, প্রচন্ড নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বিদেশ সফরের দেশ হিসেবে ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন। যার কয়েক মাস পরে চীন সফর করেন।
ভারতের আরেক প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জয়ন্ত প্রসাদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বাড়তি পদচারণা এখন ‘নতুন ও স্বাভাবিক’ তাই আমাদের প্রতিবেশীরা ভারত এবং চীন উভয়ের সাথে চলাফেরা করতে শিখেছে,” “আমাদেরও আমাদের নীতিগুলি পুনরায় মূল্যায়ন করতে হবে এবং এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে।”
রির্পোটটি নিক্কি এশিয়াতে প্রকাশিত । ভাষা ও বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে অুনদিত।
Leave a Reply