নবা ঠাকুরিয়া, অসম থেকে
গুয়াহাটি: চা ছাড়া পৃথিবী কি করবে, এই রকম একটি অধ্যায় ছিল আমাদের উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে, যা আমাদের শিক্ষক অনেক ভাবগাম্ভীর্যে পাঠ করেছিলেন। আমাদের বিদ্বান ইংরেজি শিক্ষকও আরও ভাবপ্রবণ লাইন যুক্ত করে দিয়েছিলেন সিডনি স্মিথ, ষোড়শ শতকের ব্রিটিশ লেখকের লেখা থেকে, যেমন “ঈশ্বরকে চায়ের জন্য ধন্যবাদ! আমি খুশি যে, চা আবির্ভাবের আগেই আমি জন্মগ্রহণ করিনি।” তবে সেই সময় পর্যন্ত আমার চা এবং চা বাগানের সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা ছিল। চায়ের বিভিন্ন প্রস্তুতির পদ্ধতি সম্পর্কে তো কথাই নেই।
কামরূপ জেলার বাসিন্দা হিসেবে আমি আমার কলেজ যাওয়ার আগে কখনও চা বাগান দেখিনি এবং শুধু দুধ ও চিনি দিয়ে চা প্রস্তুতের একটাই পদ্ধতি জানতাম। বই, উপন্যাস এবং অসমীয়া চলচ্চিত্র ছাড়া চা বাগান এবং চা শ্রমিক সম্প্রদায়ের সম্পর্কে আমার ধারণা খুব সীমিত ছিল।
তাই বোধহয় অসমের পশ্চিমাঞ্চলের অনেকের মতোই আমার কাছেও চা অজানা একটা বিষয়, যা আবিষ্কার করার অপেক্ষায় ছিল। বিভিন্ন সংবাদিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই পরবর্তীতে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগান দেখার সুযোগ এসেছিল, তবুও বড় একটা চা বাগানে কিছুদিন অবাধে বাস করার স্বপ্ন এখনও রয়েছে। সেই প্রবৃত্তিই আমাকে চায়ের গল্প নিয়ে লিখিত যেকোনো বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে। অসম ইলেকট্রনিকস ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (অসম ইন্ফরমেশন টেকনোলজি দপ্তরের নোডাল বাস্তবায়নকারী সংস্থা) প্রকাশিত ২০২৪ গ্রেগরিয়ান বর্ষের একটি টেবিল ক্যালেন্ডার চায়ের গল্প লিপিবদ্ধ করেছে, যা গড়ে উঠেছে ২০০ বছরের গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে।
অসমীয়া এবং ইংরেজিতে প্রস্তুতকৃত এই আকর্ষণীয় ক্যালেন্ডারে চা এবং অসমীয়া সমাজে তার বিপুল অবদানকে তুলে ধরা হয়েছে, দীর্ঘ বিবরণী ও মনোরম চিত্রাবলীর মাধ্যমে। এটি অসম ইলেকট্রনিকস ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের এক দশকব্যাপী টেবিল ক্যালেন্ডার প্রকাশের একটি অংশ, যার কনসেপ্ট তৈরি করেছেন কর্মকর্তা বসন্ত কুমার বর্ধন, বিবরণী ও গবেষণা করেছেন সমুদ্র গুপ্ত কাশ্যপ এবং চিত্রাংকন করেছেন নবা প্রতীম দাস।
পূর্বে প্রকাশিত বিশেষ বিষয়ভিত্তিক ক্যালেন্ডারগুলিতে অসমের বিশিষ্ট সন্তানদের জীবনী (শ্রীমন্ত শংকরদেব থেকে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া, জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা থেকে ভূপেন হাজরিকা), প্রাচ্যভারতের বৈষ্ণব মঠ, মহাত্মা গান্ধীর অসম সফর ইত্যাদি বেশ কিছু আকর্ষণীয় বিষয় তুলে ধরা হয়েছিল। যেখানে বিবরণী রচনা করেছিলেন শিবনাথ বরমন, প্রদীপ জ্যোতি মহন্ত, চরু কমল হাজরিকা, কমল কটকী, রামন বরা প্রমুখ।
অসম বর্তমানে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করে, যা ভারতের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক। অসমের অর্থনীতিতে চায়ের অবদান অনেক বেশী এবং ভারতীয় মুদ্রায় এর বার্ষিক রপ্তানী প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে অসমীয়া চায়ের ব্র্যান্ডিং এই অঞ্চলে রেলওয়ে নির্মাণেরও কারণ হয়েছিল যাতে কারখানায় তৈরিকৃত চা সমুদ্রপথে রপ্তানির জন্য নৌবন্দরে নিয়ে যাওয়া যায়। পরবর্তীতে এই রেললাইনেরই কারণে অসমে খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। কাছারী এবং অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীই প্রথম চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে হাজার হাজার শ্রমিককে বাংলা এবং ছোটনাগপুরের পাহাড়ী অঞ্চল থেকেও এনে বসত করানো হয়েছিল।
চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে এসে এই দশ লক্ষাধিক মানুষ শুধু অসমীয়া সমাজেরই অংশ হয়ে থাকেনি, সমাজ জীবনেও তাদের প্রভাব পড়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে গভীর দারিদ্র এবং শোষণের মধ্য দিয়েও তারা অসমকে তাদের ঘর বানিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় শাসন বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে কিছু কিছু মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। মালতি অরাং বা মুংগ্রী অসমের প্রথম নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী মার্টার।
চাতের বাঁশের ঝুড়ি থেকে বাঁশের নল এবং বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর কারখানা প্রক্রিয়া পর্যন্ত চা বহু পথ অতিক্রম করেছে। এখন গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং জলবায়ু পরিবর্তন চা উৎপাদনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সন্দেহ করা হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা দেখায় ২০৭৫ সালের মধ্যেই অনেক চা উৎপাদনকারী দেশে উৎপাদন কমবে। তবে অসমের চা এখানকার অঞ্চলের উদ্ভিদ হওয়ায় এবং গ্রীষ্মের গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় টিকে থাকতে পারার ক্ষমতা রয়েছে । এর ফলে উৎপাদন কিছুটা কমলেও অসমের চা বহু শতক ধরে বেঁচে থাকবে। এটাই বোধহয় অসমের লক্ষ লক্ষ বড়ো ছোটো চা উৎপাদকের কাছে আশার বাণী হয়ে উঠবে।
Leave a Reply