শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১০:১৭ পূর্বাহ্ন

অর্ধশতকের অনভিজাত জীবন

  • Update Time : বুধবার, ২০ মার্চ, ২০২৪, ১১.০০ এএম

অপু শহীদ

 

ভূমিকা

যে-মানুষটা কথাগুলো লিখবে তার সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার।

কেননা তোর অভিজ্ঞতাজাত উপলব্ধি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এবং অন্যদের কাছেও গুরুত্ব পাবে একটা সংযোগ তৈরি হলে পর।

শুরুতে এও বলে নেয়া ভালো, কথাগুলো অহংসর্বস্ব মনে হতে পারে। কিন্তু তা নয়। কেননা আমি দেশ-কাল-সমাজের গণ্ডিতে আবদ্ধ। স্বাধীন আবার স্বাধীন নই, অর্থাৎ শর্তনিরপেক্ষ নই।

এখানে সহজেই আমির বদলে আমরা শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। কেননা আমার মতো যারা পঞ্চাশে পা দিয়েছি আমরা আমাদের সময়, সমাজ এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সহজে নির্ণয় করতে পারব।

আমরা বলতে আমি আমার মতো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষকে বোঝাচ্ছি। কী রকম সেই লোক? পূর্ববঙ্গে নয়।

ব্রিটিশ ভারতে নয়। একেবারে বাংলাদেশে জন্ম। কিন্তু সামাজিক রাজনৈতিকভাবে উত্তরাধিকারীর ঐতিহ্য বহন করতে হয়।

শহরের মানুষ। ঢাকার মতো ক্রমবর্ধমান দৈত্যাকৃতি ধারণ করা একটা নগরে জন্ম।

পুরনো ঢাকার ছোট ছোট রাস্তার ভৌগোলিক সীমায় বেড়ে ওঠা। লোকটার জন্ম মধ্যবিত্ত ঘরে। নাকি মধ্য-মধ্যবিত্ত বলব। বরং আরেকটু নেমে নিম্নমধ্যবিত্ত বলাই ভালো। কেননা লোকটা পরবর্তীকালে জেনেছে লোকটার মা ছেলের অন্নপ্রাশনের নামে একুশ দিনের দিন কিছু হতদরিদ্র মানুষকে পেটভরে খাওয়ানোর ইচ্ছা করেছিল। লোকটির বাবা এবং বাবার বন্ধুরা ৭ই মার্চের ভাষণশেষে বাড়ি ফেরার সময় হাতে করে যে গজারি লাকড়ি নিয়ে এসেছিল তা-ই রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল।

লোকটার জন্ম যে-বাড়িতে তা একশ তিরিশ বছরের পুরনো। সুরকির দেয়াল।

জায়গায় জায়গায় ইট ক্ষয় হয়ে মাড়ির দাঁতের মতো গর্ত। কাঁচা হলুদ রঙের সেই ইটগুলোর কথা সেই বাড়ি ভেঙে

বহুতল ভবন হলেও লোকটা ভুলতে পারবে না। মাথার ওপর ছাদ ছিল আড়াআড়ি কাঠের ওপর চুন-সুরকির ঢালাই।

 

 

সেখান থেকে চলটা খসে পড়া ঘরের ভেতর একটা কাঠের মাচা। সেই মাচায় নারিকেল, গুড়-মুড়ির টিন আর আদা, রসুন, পেঁয়াজের সাথে লুকিয়ে থাকার অজস্র স্মৃতি।

আরেকটা ঘর ছিল বাবার রেশন দোকানের তেল, চিনি, লবণ, চাল রাখার গুদামঘর। এসব পার হয়ে বাড়ির শেষ মাথায় ছিল একটা কুয়ো। সেটা কবে কাটা হয়েছে জানা নেই। ধারণা করা হয় বাবার দাদার বাবার সময়ে।

যে-মহল্লায় লোকটা বড় হয় সেখানে পারতপক্ষে আমলা, উকিল, প্রফেসরদের চোখে পড়ত না।

তারা থাকেন এই মহল্লার প্রধান সড়ক শরৎগুপ্ত রোডের উত্তর অংশে। সেখানে বনেদি বাড়িঘরে বনেদি লোকজনের বাস। আর এই অংশের মানুষরা পেশায় ওস্তাগার, মিস্ত্রি, কারিগর, ড্রাইভার, দর্জি, দোকানদার ইত্যাদি। শিক্ষিত বলতে বড়জোর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নতুবা মিউনিসিপ্যাল কর্মচারী।

আমাদের এই লোকটা যে পঞ্চাশ বছরের দেখাটা লিখতে চায় সে কিন্তু শিক্ষার সুযোগ পেয়ে গেল। অর্থাৎ তার বাবা তার ভরণপোষণ এবং তার স্কুলের খরচ চালানোর মতো সক্ষম হলেন। ফলে সে হয়ে গেল শিক্ষিত। কিন্তু স্কুলের গৎবাঁধা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি লোকটা আরো আরো বই পড়ল। সর্বভুকের মতো পাঠ করতে করতে লোকটার মধ্যে শ্রেণী সচেতনতা এলো। ফলে লোকটা হয়ে উঠল আত্মবিধ্বংসী। লোকটা দেখল সমকালের সমবয়সী সকলেই কিছু না কিছু হতে চাইছে। কিন্তু লোকটা চেষ্টা করে গেল কিছু না হওয়ার।

শেষ পর্যন্ত লোকটার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যয়নপত্র জুটে ছিল  কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে সে এসবকে খুবই নিম্নমানের মূল্যায়ণ বলে বিবেচনা করে থাকে। সেই লোকটা তার দেখা গত পঞ্চাশ বছরের সামাজিক লংজাম্প, হাইজাম্প, উল্লম্ফন তুলে ধরতে চায়।

জাবরকাটা

গলির ভেতর তস্যগলি সেটাই চিপাগলি। এই চিপাগলি বাম ডান করতে করতে এগিয়ে গিয়ে ওঠে বড় গলিতে। তারপর ছোট রাস্তায় ছোট রাস্তা এগিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায়। এভাবে এই গলির সাথে সংযোগ ঘটে পৃথিবীর সব রাজপথের। আবার উল্টোদিকে দেশ-মহাদেশ এসে ঢুকে পড়ে এই তস্যগলিতে।

একদা এখানে হায়েনার খাঁচায় থাকা মন্টু খানের বাড়িতে পোলাও রান্না হলে মহলানবিশদের বাড়িতে ঘ্রাণ পাওয়া যেত। মহলানবিশদের পূজা ঘরের ধূপ চলে যেত সওগাতের নাসিরুদ্দিনের বাড়িতে। তারও অনেক আগে শরৎগুপ্ত রোড ধরে ব্রিটিশ পুলিশ ভাওয়াল সন্ন্যাসীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যায় খুনের দায়ে।

আবার এই ছোট রাস্তার এক পাশে বসু বাজার লেন পার হয়ে বাগানবাড়িতে এসে আশ্রয় নেন কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস। ‘মগের মুল্লুক’ কবিতা লিখে ভাওয়াল রাজমন্ত্রী লেখক কালীপ্রসন্ন ঘোষের রোষে পড়েন তিনি। মিডফোর্ট হাসপাতালে চিকিৎসাবিদ্যায় ভর্তি হন গোবিন্দ দাস। ব্যবহারিক ক্লাসে মানুষের কঙ্কাল দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। অ্যালোপ্যাথি বাদ দিয়ে ঢুকে পড়েন হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথে। শেষ পর্যন্ত গোবিন্দ দাসের মৃত্যু হয় এই নারিন্দা এলাকায়। অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও রাজরোষের কারণে স্ত্রী-কন্যার কাছে ফিরতে পারেন না তিনি। শ্যামপুরের শ্মশানে সরু রাস্তার কয়েকজন মিলে দাহ করে কবিকে।

এরকম আরেকজন সোমেন চন্দ। মেডিক্যালে ভর্তি হয়েও পড়া হয় না।

পড়বেন কীভাবে, সারাদিন শ্রমিক ইউনিয়ন আর রাতে ইঁদুর নিয়ে গল্প লেখেন। সেইসব ইঁদুরের বংশধর এখনো দক্ষিণ মৈশুন্ডী, কলতাবাজার, নারিন্দা, পাঁচভাই ঘাট লেন, বেগমগঞ্জ লেনে বাস করে। লক্ষ্মীবাজার মোড়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী মিছিলে গুলি করে হত্যা করা হয় সোমেন চন্দকে। এই ছোট রাস্তা তখন চলে যায় কলকাতার ধর্মতলায়।

দক্ষিণ মৈশুন্ডীর লালমোহন সাহা মোটরগাড়ি কিনে রোযে পড়েন নবাববাড়ির ফলত ছোট রাস্তা থেকে বেরিয়ে যশোহর রোড ধরে চলে যান বড় নগরীতে।

এসব যখন ঘটে তখন আমার জন্মই হয়নি। একটু পেছনে ফিরে দেখে নিলাম।

ধুলোজমা স্মৃতিকে উসকে দিলেই তা প্রকাশ্য। স্মৃতির পরতে পরতে জমে থাকা ধুলো ব্যক্তির কাছে হীরকদ্যুতি। নস্টালজিক। দুর্লভ। কিন্তু অপরের কিছু অতীত, জমে থাকা মলিন দাগ। কিছু মানুষ,

চালচিত্র

এখানে কোনো তাত্ত্বিক ভাবনা নেই। বড় চিন্তা নেই। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। সুদূর স্বপ্ন নেই।

এখানকার মানুষ এখানেই জন্মে। এখানেই ধুকে ধুকে মারা যায়। জীবিতেরা কাঁধে করে রেললাইনের পাশের কবরস্থানে সমাহিত করে আসে। পুরনো লোকেরা কবরে দেখিয়ে দেয় পঞ্চাশ বছর আগেও কাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে।

এখানে সরু সরু গলিপথ। অথবা গলিটাই ঢুকে গেছে বাড়ির ভেতর। এখানে আকাশের ব্যাপ্তি নেই।

আকাশ অনেক ছোট। চাপ চাপ অন্ধকার। অশরীরী ভৌতিক ছায়া। রাতের তারা এখানে কোনো ইশারা পাঠায় না। ভোরের সূর্যের সঙ্গে এদের কখনো দেখা হয় না। এরা মধ্যরাত্রির জাতক। আত্মপরিচয়ের আধিপত্যকে এরা মুক্ত করতে চায়। কেন্দ্র ও পরিধি যাদের মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠে। এখানেই আবার বুদবুদের মতো জন্ম নেয় স্বপ্ন, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, ঘৃণা, যন্ত্রণা, হত্যা, আত্মহত্যা, প্রতিশোধ, ব্যাকুলতা, সীমাবদ্ধতা। এসবের মধ্যেই হারিয়ে যাওয়া নিজেকে খুঁজি। হয়তো কিছুটা খুঁজে পাব।

কুয়োতলা

বাড়িতে ঢুকলেই প্রথমে নজরে আসবে না। শেষ দিকে গেলে পাওয়া যাবে এক গভীর কুয়ো। কুয়োর চারদিক উঁচু করে বাঁধানো। কুয়োর গায়ে কার্পেটের মতো শতবর্ষের শ্যাওলা। কুয়োর মধ্যে উপুড় হয়ে মুখ দেখার চেষ্টা করে একটা শিশু। হাতের আঙুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখে। একবার কুয়ো থেকে মাথা সরিয়ে নেয়। আবার কুয়োর ভেতর মাথা ঢোকায়। প্রতিকৃতি দেখার খেলা খেলে। উদোম গায়ের শিশুটিকে আজো শনাক্ত করতে পারি আমি বলে।

বালতিতে পাটের দড়ি বেঁধে কুয়োয় ডুবিয়ে পানি তোলা হতো। খাওয়া বাদে সমস্ত কাজই সেই পানিতে চলত। তখনো বাড়িতে ওয়াসা ঢোকেনি। স্কুলঘরের মোড়ে বসানো ছিল এজমালি চাপকল। সেখান থেকে খাবার পানি আনতে হতো। জলির মা বলে এক মধ্যবয়সী নারী কলসি কাঁখে বাড়ি বাড়ি পানি পৌঁছে দিত। জলি বলে তার কোনো কন্যা ছিল না। জল আনত বলে জলের মা, সেখান থেকে জলির মা। শেষে সকলে ডাকত ছলির মা বলে। তখনো ঘরের ভেতর রান্নাঘর, বাথরুম ঢুকে পড়েনি। থাকার ঘর থেকে একটু দূরে ছিল টাট্টিখানা, কলঘর, গোসলখানা। মলমূত্র গমনাগমনের জন্য পাইপ বসানো হয়নি। বড় বড় মাটির গামলায় সেসব ধরে রাখা হতো। এখনো টিস্যুর ব্যবহার আর কাচঘরে বাথটাব দেখলে মনে পড়ে বদনা ভরে আর বালতি করে তোলা পানি নিয়ে যাওয়ার কথা।

প্রায় সময় কুয়োর ভেতর বালতি পড়ে হারিয়ে যেত। পাটের দড়ি পুরনো হয়ে ছিঁড়ে যেত। কিংবা দড়ির গেরো ছুটে যেত। কখনো ভরা বালতি ওজন রাখতে না পেরে দড়িসুদ্ধ পড়ে যেত। ডুবে যাওয়া বালতি তোলার জন্য ছিল লোহার কাঁটা। সেই কাঁটা কুয়োর শেষ মাথা পর্যন্ত পৌছে বালতি ধরার চেষ্টা করত। কখনো কখনো কাঁটা সর্বাংশে ব্যর্থ হতো। বালতি উপুড় হয়ে পড়লে কাটার ক্ষমতা ছিল না তুলে আনার। সে ক্ষেত্রে ডেকে আনা হতো পাগলা শাহেদকে। শাহেদ কুয়োয় ডুব দিয়ে নাই হয়ে যেত। নাই তো নাই। বেশ সময় ধরে সাড়াশব্দ নাই। কুয়োর বাইরে দাঁড়ানো সকলের যখন শ্বাসরোধ হয়ে আসছে তখন হঠাৎ পানিতে বুদ্বুদ দেখা দিত। পরক্ষণেই ভুস করে ভেসে উঠত বালতিসহ আশ্চর্য ডুবুরি। হাতে করে নিয়ে উঠত হারিয়ে যাওয়া চামচ, চায়ের কাপ, নুনের বাটি, সাবানের কেস ইত্যাদি।

গ্রীষ্মকালে কুয়োর পানি তলানিতে চলে যেত। তখন মেপে মেপে খরচ করতে গ্রীষ্মকালো র বর্ষাকালে মাটি ছুঁয়ে তিরতির করে পানি এসে জমা হতো। তখনো যোলাইখালে বাঁশের ভেলা চলাচল করে। বংশাই নদীর চালের নৌকা সুতিখাল হয়ে কাঠের পুলের নিচ দিয়ে শ্যামবাজার এসে পৌঁছায়। ইমাম গাজ্জালীর পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাথে কূপের উদাহরণ যতবার দেখি, হারিয়ে যাওয়া সেই কুয়োর কথা মনে পড়ে। সেখানে চাপা পড়ে আছে আমার মুখের ছায়া। পূর্বপুরুষের সেই ছায়ার ওপর এখন কংক্রিটের দালান।

 

অন্দরের অলিন্দ

একটা কাঠের মাচা। তার ওপর বিড়ালের বাসা, ঘুড্ডি নাটাই, ফুটবলের ব্লাডার, একটা ট্রাঙ্ক। ট্রাঙ্কের ভেতর ন্যাপথলিন দেয়া বিয়ের শাড়ি। ঘরে স্টিলের আলমারি ঢোকে অনেক পরে। সুরকির বেশ মোটা দেয়াল। অনেক উঁচুতে আড়াআড়ি কাঠের ঢোকে চুন-সুরকির ঢালাই দেয়া ছাদ। দেয়ালের গায়ে কাঠের তক্তা বসানো তাক। নিচের তাকে থাকে হারিকেন, কুপি, প্রজাপতি মার্কা দেশলাই, কেরোসিনের ডিব্বা। একটু ওপরের তাকে পান, সুপারি, চিলমচি, চা  পাতা, গুঁড়া দুধ- এরকম আরো কত কী। সারি সারি সাজিয়ে রাখা রবিনসন বার্লির কৌটাসমূহ ভোক্তা হিসেবে চিনতে পারি। আরেকটু ওপরের দিকে এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত টানা কার্নিশ। সেখানটায় নানাবিধ তৈজসপত্র সাজানো। তার নিচে কাচ দিয়ে বাঁধানো কাঠের ফ্রেমের ভেতর:

‘যাও পাখি বলো তারে

সে যেন ভোলে না মোরে।’

দেয়ালের সুরকি পুরোপুরি ধসে যাওয়ার পূর্বে ডাকা হতো রাজমিস্ত্রি ওসমানকে। সঙ্গে থাকত শিষ্য লেবু মিঞা। এক টাগার সিমেন্টের সাথে সাত টাগার বালু মিশিয়ে আস্তর করে দিত ভাঙা দেয়াল।

মাচায় বাস করা বিড়াল পরিবার সঙ্গম প্রসব লালনপালন সব এখানেই সারত। শুধু চোখ ফোটার আগে ঘাড় কামড়ে ধরে সাত ঘর ঘুরিয়ে আনত। এই বিড়ালরা কিংবা রাস্তায় বড় হওয়া ভুট্টো, গণেশ, ল্যাম্পু, টাইগার এরা সকলেই এই ছোট গলির বাসিন্দা। এখনকার বিড়ালদের কোনো এক পূর্বসূরি আমার অবাধ অবোধ্য কান্নাকে ভেংচি ভেবে মাচার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিল। সেই থেকে বাম চোখের নিচে আঁচড়ের দাগ। সেই আঁচড় পঞ্চাশে এসেও বহন করছি। শুধু দাগটা অনেক নিচে নেমে গেছে, এখন ঠোঁট বরাবর।

মানুষের মেলা

সরু গলি হলেও একেকটার একেকটা নাম ছিল। লালচাঁন লেন। মুকিমচাঁন লেন। কানার গলি। হাপির দোকান। হলুদ মসজিদের গলি। আসিয়ার কিনচান লেনের গলি। প্লেনওয়ালা গলি। মিনমিনির গলি। ট্যাম্পু সাহেবের কলোনি। জাবরা। দয়াগঞ্জ। বেগমগঞ্জ। কোম্পানিগঞ্জ। গঞ্জিঘাট। কুলুটোলা। এর কোনো শেষ নেই। এসব আবার গিয়ে মিলেছে শরৎগুপ্ত রোডে।

প্রতিটি গলিতেই পাওয়া যাবে স্যাম্পল মানুষ। কাউয়ার ট্যাকে থাকে টুন্ডা। আদিতে সে ছিল গুণ্ডা। হাতের আঙুল কাটা পড়ায় এখন সে টুন্ডা। এখানে মানুষ মানুষের বড় কাছাকাছি। যদিও মানুষ থেকে মানুষের দূরত্ব কত আলোকবর্ষ তা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।

সূত্রাপুরের স্থায়ী পাগল দিলু পাগলা। সব সরু গলি আর ছোট রাস্তায় তার অবাধ বিচরণ। নীল রঙের জাঙ্গিয়া ছাড়া আর কিছু পরনে থাকে না। মাঝে মাঝে আরেকটা জাঙ্গিয়া থাকে, সেটা মাথায়। এদিকে জর্জ পাগলার পোশাক-আশাক ঠিকই থাকে। শুধু মাঝে মাঝে মাটিতে শুয়ে ওপরের দিকে ফুঁ দিয়ে আকাশটাকে ওপরে উঠে যেতে বলে। কারো চোখে চোখ পড়লে দায়িত্ব নিয়ে বলে: বুঝা পারছ, হালায় কুনসুম জানি চাপা দিয়া দিব, অসুবিধা নাইক্কা, উপরে উঠায়া দিছি, তা বি সাবধানে থাইকো। জর্জরা সব ভাই পাগল। অবশ্য কে বড় পাগল আর কে ছোট পাগল কোনো প্রকার জরিপ করা হয়নি। মহিলা পাগলের মধ্যে রমজানি বেগমই বহু বছর প্রথম স্থান ধরে রেখেছে। এখন তো তার সবকটা চুলই পাকা। তবু বিড়বিড় করতে থাকে: মুরগির গোশ মাইয়াটা। যে-কোনো নির্বাচনে হারিকেন মার্কায় যে দুইটা ভোট পড়ে তার একটা দেয় রমজানি বেগম। ফাতেমা জিন্নার নির্বাচনী এজেন্ট ছিল সে। দিলুর মুখে এখন অসংখ্য সরু গলি, ছোট রাস্তা। মিটিমিটি মায়াময় হাসি শতভাগে বিভক্ত।

জামশেদের পুরো পরিবার চলে গেছে লাহোরে। বিভিন্ন জায়গায় লগ্নি করা টাকা তুলতে সে থেকে যায়। কেউ তার ক্ষতি করবে না। কেননা মুক্তিযুদ্ধের সময় সে অনেকের উপকার করেছে। সে-টাকা কোনোদিনই আর সে তুলতে পারবে না। এ- কথা সে নিজেও জানে। তবু চেষ্টা করে যায়। সে এখন বস্তা ভরে ত্যাঁড়াব্যাঁকা তারকাটা আনে। লোক লাগিয়ে এবং নিজে দিনরাত খেটে সেসব তারকাটা সোজা করে। তারকাটাকে আমরা অনেক নামে ডাকি। পেরেক, পুইত্তা। ছোট হলে চুবি। জামশেদ শীতকাল গরমকাল সব কালেই লম্বা এক জোব্বা পরে থাকে। জোব্বায় অনেক পকেট। বিভিন্ন পকেটে থাকে ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের পেরেক। ভেতরের একটা পকেটে থাকে দরখাস্ত। সেটা আইয়ুব খানকে লেখা। প্রায় সময় সে আইয়ুব খানকে চিঠি লেখে। চিঠির সারমর্ম: কেন সে এসে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা ঠিক করছে না আর তার পাওনা টাকা উদ্ধারের ব্যাপারে কোনোরূপ সাহায্য করছে না।

মহল্লার নারীদের মধ্যে প্রধান নেত্রী সখিনার মা। যুদ্ধে এক ছেলে হারিয়ে এখনো ছয় ছেলে তার  তাকে কখনো ব্লাউজ পরা দেখেছে মহল্লায় এরকম লোকের সংখ্যা বিরল। তার দ্বিতীয় ছেলে মিয়া চাঁনের স্মরণে কলপাড়ে মিনার বানানো হয়েছিল। মিনারের মাথায় দুটো গর্ত করা চোখ। ঠিক এরকম দুটো ছিদ্র স্কুলের ভেতর জোড়া ডাব গাছের একটাতে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকবাহিনী মিয়া চাঁনকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। স্কুলঘরে নিয়ে ডাব গাছে বেঁধে প্রথমে কথা আদায়ের চেষ্টা করে। ফসকে যাওয়া গুলির চিহ্ন নিয়ে সেই ডাবগাছ আজো দাঁড়িয়ে আছে। পঞ্চাশে এসে সেই ডাবগাছের গর্তে আর চোখ রাখি না। মিনারের চোখে রাখি না চোখ।

ছোপ ছোপ চিত্র

আমাদের কৌমজীবনের সাদাকালো কিছু ছবি ছাপচিত্র হয়ে আছে স্মৃতি অংশে। ছোট গলি থেকে বেরিয়ে মোড়ে এলেই কত রকমের খাবারদাবার। আচার ছিল দশ রকমের ওপরে। চালতা, বরই, আম, জলপাই, আমড়া, তেঁতুল আরো কত কী। তখন পাঁচ পয়সা দশ পয়সা সিকি আধুলির চল। আচারওয়ালা ফজলু ভাই এই কৌম সমাজেরই একজন। পয়সা দিলে ডিব্বায় রেখে দিত। গুনে নিত না। ভাঁজ করা কাগজে আচার উঠিয়ে দিত। তখন আইসক্রিমের দাম দশ পয়সা। নারিকেল দেয়া আইসক্রিম হলে চার আনা দিতে হতো। আচারওয়ালার পাশে নবাবের দোকান। নবাব এখন আর ফুটবল খেলে না। একসঙ্গে পাঁচশোর বেশি হেড দিতে পারত সে। হেড দিতে দিতে পুরো মাঠ চক্কর দিত। নবাবের দোকানে থাকত মাকনা, বেথুন, পানকিচুমকি, বংখই, বইচি ফলের মালা। এছাড়া কালোজাম, গোলাপজাম, ডেউয়া, করমচা, পানিফল, লটকন যখন যার মৌসুম সব পাওয়া যেত। স্কুলফেরত বালকগণ এসব ভাগাভাগি করে খেত। এছাড়া আর কী-বা পাওয়া যেত নান খাতাই, হাওয়াই মিঠাই, শনপাপড়ি, তক্তা বিস্কুট আর সন্ধ্যা হলে কুলফি বরফ। সাইকেল নিয়ে হাওয়া হওয়ার আগে, ছোট লোহার চাকতি একমাথা বাঁকানো লম্বা শিক দিয়ে চালিয়ে সকল ছোট রাস্তা চক্কর দেয়া যেত। বসু বাজার দিয়ে ঢুকে গামার কুস্তি ঘরের পাশ দিয়ে গড়িয়া মঠ দিয়ে টিপু সুলতান রোড দিয়ে ধোলাই খাল হয়ে আবার নারিন্দায় ফেরত আসা। এটাই ছিল দিগ্বিজয়।

একবার পড়ে গেলাম পানিভর্তি গর্তে। ওয়াসা না গ্যাসের পাইপ বসাচ্ছে। তাতে জমে আছে বৃষ্টির পানি। সন্ধ্যা ধর ধর সময়। বিশটা হাওয়াই মিঠাই দু-হাতে ধরে বাড়ি যাচ্ছি। ইটের সাথে উষ্টা লেগে পড়ে গেলাম গর্তে। আর তো হাওয়াই মিঠাই খুঁজে পাই না। কোমরসমান পানিতে উপুড় হয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজছি। সারাগায়ে কাদা লেপটে আছে। চোখে কান্না। বাড়ি গিয়ে কী বলব? একটুও যদি খুঁজে পাওয়া যেত মাকে গিয়ে বলতে পারতাম। কিছুতেই যখন পাচ্ছি না তখন কান টেনে তুলল কানা ইয়াসিন। সেই তো জানলাম কিছু কিছু জিনিস বাতাসে পানিতে মিলিয়ে যায়। কোনোদিন তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

আশির দশক থেকেই সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আর রাজনৈতিক বিশ্বাস হারাতে শুরু করি আমরা। আশির দশক পুরোটাই কেটে গেল মিছিলে- স্লোগানে, লাঠিচার্জ-কাঁদানে গ্যাসে, কারফিউ-হরতালে, আবাহনী-মোহামেডানে। আশির দশক মাস্তানদের কমিশনার হওয়ার দশক। বিশ্বাসঘাতকতার দশক। বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হওয়ার দশক। ঘুষখোরদের সম্মানের চোখে দেখার দশক। নৈতিকতার চূড়ান্ত অবক্ষয়ের দশক। আশির দশক ব্লু ফিল্মের দশক। আশির দশক নেতা বিক্রির দশক। এ-সময় রাস্তাঘাট চওড়া হয়। নতুন নতুন রাস্তা হয়। ভেড়ারা বাঘ আর বাঘেরা গাধা বনে যায়। মাটির দেয়াল ভেঙে পড়ে। রড-সিমেন্টের ব্যবহার বাড়ে। চব্বিশ তলা বিল্ডিং ওঠে। রাতে স্বপ্নে দেখে পরদিন জুম্মার নামাজ পড়তে প্রেসিডেন্ট চলে আসে আমাদের ছোট রাস্তার মসজিদে। যদিও এক সপ্তাহ ধরেই ছোট রাস্তার ছোট-বড় সকলে টের পাচ্ছিল সাদা পোশাকের আনাগোনা।

আমাদের সবাই সবার চেনা। আমাদের চেনা ভিক্ষুক রাবেয়ার মা, ল্যাংড়া হানিফ, কাইতন বিবি, আরেকজন আসে খুদি চাচি। কেউ খুদ নেয়। কেউ চিনি। কেউ চায় এক থাল ভাত। চোরও আমাদের চেনা। বাইরে থেকে কেউ এখানে চুরি করতে আসে না। আর চুরি করার আছেই বা কী! দামি জিনিস বলতে রেডিও আর ঘড়ি। এছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুরি যায় হাঁড়ি-পাতিল নতুবা জামাকাপড়। কিছু চুরি গেলে প্রথমে ডাক পড়ে ম্যান্ডার। ম্যান্ডাই অত্র এলাকার পপুলার চোর। তাকে সাথে সাথে ধরতে পারলে ভালো, না হয় কয়েকদিন হয়ে গেলে মাল ফেরত আনতে খরচ বেড়ে যায়।

সেইসব দিনে স্কুল থেকে গুঁড়া দুধ দিত। আমাদের শিশুরক্ষা স্কুলে দুপুরে দেয়া হতো পাতলা খিচুড়ি। লাইন ধরে সেই খিচুড়ি খেয়ে কেউ কেউ বিকেলে যেত সাধু যোসেফ কারিগরিতে। সেখানে পাওয়া যেত বনরুটি, বাটারবন। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল ক্রিমরোল। ফাদার খুব যত্ন করে খাবার বিতরণ করতেন। আমাদের পুরি-পিঁয়াজু-ফুলুরি-চপের তুলনায় সেসব তখন বনেদি খাবার।

স্কুলফেরত বালকদিগকে নিয়ে প্রায়ই হাজির হই রেশন দোকানে। কয়ালির কাছে হাত বাড়িয়ে দিলেই মুঠভরে চিনি দিত। সেই বালকরাই গোঁফ উঠতে না উঠতেই সিগারেট ধরল। তখন তো এক সিগারেটে পাঁচজন। ফার্স্ট বুক সেকেন্ড বুক লাস্ট বুক। তখন সিগারেট আসত বাবার প্যাকেট থেকে। সাহস করে দুটো-একটা সরিয়ে ফেলতে পারলে তখন রাজাই রাজা। কবে থেকে যেন গোটা একটা সিগারেট খেতে শিখলাম। তখন ক্যাপস্টান, সিজার, সিজারকে বোধকরি কেচি ডাকতাম। গোল্ডফ্ল্যাক, ফাইভ ফাইভ- কে যে রাজা আর কে মহারাজা বলা মুশকিল। কার সঙ্গে কোন সিগার জমে যাবে তখনো ঠিক হয়নি। তেমনি ঠিক হয়নি রানু মমতা তানিয়া কাজল কার সঙ্গে কার ভাব জমবে। কোনো কোনো সিগারেটে ছিল প্লাস আর মাইনাস। পুরস্কারের আশায় সেসবের স্তূপ জমে উঠত। সেসব খালি প্যাকেট দিয়ে আবার ম্যাজিক চেইন, খেলনা বা অন্যান্য শিল্পদ্রব্য বানানো হতো।

এরপর আমরা কিছুদিন চেষ্টা চালালাম মিকশ্চার বানানোর। কতটা তামাক কতক্ষণ ডলতে হবে। তারপর কীভাবে লম্বা পুর করতে হবে। তামাকের পুরের ওপর পাতলা কাগজ ফেলে উল্টে পাক দিতে হবে। এরপর থুতু লাগিয়ে দিতে হবে হালকা চাপ। বলাই বাহুল্য শেষের এই সূক্ষ্ম কর্মটিতে আমাদের অনেকেই ব্যর্থ হলাম। কারোটার পেট ফুলে যায়। কারো পেট সরু হয়। কারো গোলই হয় না, চ্যাপ্টা থেকে যায়। আমার সবটাই ঠিকঠাক হতো। শুধু শেষটায় থুতু উল্টো লাগিয়ে ফেলতাম। আজো পঞ্চাশে এসে অনেক কিছুই ঠিকঠাক করতে করতে শেষটায় উল্টো করে ফেলি।

ম্যারাডোনার হাতে গোল করার উল্লাস নিয়েই তখন আমরা মেতে আছি। আমাদের নিজেদের উল্লাস শুরু হয় আরেকটু পরে ।  আমরা তখন মেথরপট্টি যাই বড়দের জন্যে। পলিথিনে করে দিশি আর সাধনা থেকে সঞ্জীবনী। আমাদের নজর তখন ক্লাবের ক্যারমবোর্ড আর হোটেলের শেষ টেবিলের দিকে। মেথরপট্টিতে তখন শুয়োরের খোঁয়াড়। কাদায় মাখামাখি করে শুয়োরদল হুটোপুটি খেলে। তার পাশে দড়ির খাটিয়ায় অচেতন পড়ে থাকে ছিন্ন মানব। কখনো কখনো সেখানে আবিষ্কৃত হয় নামকরা নায়ক কিংবা গীতিকার লেখক। আমাদের ছোট রাস্তা থেকে কয় মিনিটেরই বা পথ। হুইস্কি রাম জিন জিহ্বায় পড়ার আগে জিহ্বা ছুঁয়েছিল দিশি চোলাই। প্রথম চুম্বনের মতোই এও এক অমোচনীয় স্মৃতি। এরপর কত ক্লাব তিন তারকা পাঁচ তারকা জলে স্থলে আকাশে চেখে দেখলাম। কিন্তু রিকশার গ্যারেজে বসে নাড়িভুঁড়ি উল্টে ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসা বমি ভুলতে পারলাম কই।

রিকশার গ্যারেজে বসেই আমরা পুরো শহরের খবর পেতাম। তখনো টানবাজার, কান্দুপট্টি, ইংলিশ রোড, গোলকপাড় লেন টানটান উত্তেজনায় জাগ্রত।পরিতোষ সেনের মতো ভেজা শরীরের বারবনিতার টলমলে দেহ দেখিনি। তবে হাতে সিগারেট মুখে পান আলুথালু রমণীকুলের সাথে চোখাচোখি হয়েছে বহুবার। ওদের বা ওদের কাছে আসা ছোটলোকদের ঘৃণা করতাম না। ঘৃণা করতাম ওখানে আসা ভদ্রলোকদের। ওখানকার একটি মেয়ে বিবিজান সে বন্ধুর মতো গল্প করত। ছোটলোকরা আসে সুনির্দিষ্ট কর্মটি করতে আর ভদ্রলোক আসে নখ আর দাঁতের আঁচড় বসাতে। ইংলিশ রোডের ঠিক যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে বিবিজানের সাথে কথা

হতো, যেখানটায় দাঁড়িয়ে গণিকাদল ছলাকলা করত, আনাড়ি খদ্দেরকে চোখ মারত, ইশারায় ডাকত, রাষ্ট্রধর্মের সাথে সেই স্যাঁতসেঁতে কুঠুরি এখন পবিত্র স্থানে রূপান্তরিত হয়েছে।

নিষিদ্ধ অঞ্চলে নারী-মদ-নেশা বিবেচনায় বিশেষ খেতাব অর্জন করে ছোট রাস্তার তিন বন্ধু। কইরা, পুইনা আর খাইরু। প্রায় রাতে তিন বন্ধু রিকশা করে ফেরে। আসলে রিকশার ওপরে বসে একজন। সে গাইতে থাকে বাচপান কি মোহাব্বত কো। আর পাদানিতে বাকি দুজন বস্তার মতো পড়ে থকে। ওপরে যে থাকে সে দুই পা দেয় ওদের ওপর। পা ঠুকে ঠুকে গানের তাল রাখে। ছোট রাস্তায় ঢুকে গেলে কেউ কেউ পায়ের কাছে পড়ে থাকাদের বিষয়ে জানতে চায়। ওপরে বসে থাকা খাইরু তখন এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে দেয়। হালারা খাইতে খাইতে মইরা গেছে গা, আমার দোষ না, ফালায়া দিমু, উঠায়া লয়া আইলাম। কইরা আর পুইনা একটু নড়াচড়া দেয়। খাইরু ওদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, আবে হালায় মরে নাইক্কা, দোস তরা তো বে জিন্দা আছস। খাইরু গান গাইতে গাইতে ফিরলেও বাড়ি ফিরে যেতে পারে না। পড়ে থাকে ড্রেনে। পাশ দিয়ে যে যায় তাকেই আকুতি জানায় টেনে তুলতে। ভুক্তভোগীরা দূর দিয়ে চলে যায়। নতুন অনেকেই বুঝতে না পেরে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে হাত টেনে খাইরু পরম আনন্দে জড়িয়ে ধরে বন্ধুকে। উপকারীর সমস্ত দেহে ড্রেনের নোংরা লেগে যায়। সমস্ত হুলস্থলের পর আগমন ঘটে আঞ্জু বেগমের। স্বামীকে একটা লাঠি দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে নিয়ে যায় কলপাড়ে। পুরুষ এবং নারীর গোপন অঙ্গের মিশেলে যত প্রকার গালি হয় তার সব সে খাইরুর ওপর প্রয়োগ করতে থাকে।

সাবালকত্ব

বাঁশের মাথায় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল টানানোর কিছুদিনের মধ্যেই চলে এলো রমরমা ভিডিও কালচার। ক্যাসেটের কল্যাণে একেক মহাদেশের সঙ্গে পরিচয় ঘটল। মাথায় হাত দেয়া বৈজন্তিমালা। লক্ষ্য করলাম মধুবালার একটা চোখ একটু ছোট। তাতে কী আসে-যায়। তবুও কী মিষ্টি মাদকতা। চোখের কথা যদি বলি কাজল দেয়া সুচিত্রা সেন। ফরাসিদের ব্রিজিত বার্দো আছে তো কি আমাদের সুচিত্রা আছে। শ্বশুরসূত্রে সে আমাদের ছোট রাস্তার লোক। হারানো সুর, সাগরিকা বুড়োদের দেখাদেখি আমাদেরও প্রিয় হয়ে উঠল।

সে তো জাগরণের সময়। নতুন নতুন ভ্রমণকেন্দ্র আবিষ্কার। শরীরের ভাঁজে

জ্যামিতিক সুষমার উন্মোচন। একেকজন নক্ষত্রে আলাদা আলাদা গুপ্তবিন্দু

চিহ্নিতকরণ। দলগত উপভোগ থেকে ব্যক্তির চেতনায় ফিরে আসা। চের চেতনা লুপ্ত হয়ে যায় কোন নক্ষত্রনারীর ওষ্ঠের আমন্ত্রণে তাত্ত্বিকরা ভেবে দেখতে পারেন। মুগ্ধ হয়ে শুধু দেখে যাওয়া। পুরুষ এখানে দ্রষ্টা। নারী মূলত দ্রষ্টব্য। লুটপাট হয়ে যায় মানচিত্র সমাজ। ব্যাবিলনের রানীর ঘাড়ে চিতার মতো কামড়ে ধরতে চায় প্রেমিক চিল পুরুষ ক্ষুধার সনদ নিয়ে একে একে প্রবেশ ঘটে অন্ধকার গুহামুখে।

ব্রুস লি, জ্যাকি চেন ছেড়ে একটু একটু করে রেখা, শ্রীদেবী, মাধুরীর দিকে হাত বাড়ালাম। কাকে ছেড়ে কাকে নিই। একদিকে এলিজাবেথ টেইলর, গ্রেটা গার্বো, মেরিলিন মনরো। আরেকদিকে জিনাত আমান, পারভিন ববি, হেমা মালিনি একেকটা নায়াগ্রা প্রপাত। বুক হিম হয়ে আসে। ভূমিকম্প ঘটে আটলান্টিকের গভীর জলে। ওদের বুকের ওঠানামার সঙ্গে একেকটা সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। জন্ম-মৃত্যু আটকে যায়। রসময় গুপ্ত থেকে প্লেবয়ে উত্তীর্ণ হলাম। এভাবে করুণ দরিদ্রতায় ফুঁ দিয়ে জ্বালিয়ে রাখা গেল ভিসুভিয়াস।

সেই থেকে জাতীয়তাবাদী চরিত্র হারিয়ে ফেললাম।

অবান্তর ভাবনা

মৃত্যুর সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা-কাটাকাটি হয়। কিন্তু আপাতত ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছি। স্মৃতি এক ভয়াবহ বিস্মৃতি। এক ন্যানো সেকেন্ড পর্যন্ত সামনে যেতে পারছি না। শুধু অতীত, অতীত আর অতীত। শ্মশানে পড়ে থাকা ছাই জ্যান্ততার দাবি জানায়। অজান্তে কেবল মৃত্যুর দাসত্ব করে যাচ্ছি। তুমুল বৃষ্টিতে গাছের ছায়ায় থিতু হওয়া। বনভূমির নীরবতায় হারিয়ে যাওয়া। লকলকে আগুনের শিখায় নিজেকে আবিষ্কার করা। কোনো রাজনীতি-দর্শনে আস্থা না রাখা। কখনো কি বলতে পারি আমি স্বাধীন। পঞ্চাশ পেরিয়ে এসে বলতে কি পারি একটা ব্যক্তিত্বে পৌঁছেছি। অবচেতনে ধাবিত ছিলাম কিছু না হওয়ার চেষ্টায়। তবু নিজেরই জীবন ধরতে কি পারি হাতের মুঠোয়। একই মূল্য কি ধরে রাখতে পেরেছি। নাকি তাসের প্রতিটি দানের মতো পাল্টে পাল্টে যায় ভূমিকা। প্রতিবছর ক্যালেন্ডার পাল্টায় সেই সাথে আমরাও পাল্টাই কিছুটা।

আমাদের ছোট রাস্তা মিশে গেছে পৃথিবীর সব রাস্তায়। পৃথিবীর সব রাস্তা অবশেষে ঢুকে যায় চৌকাঠের ভেতর। কত কত ফেলে আসা ভুল একাকার হয়ে দেখা দেয়। এখনো ঘুমের ভেতর চমকে উঠি আনন্দ-বেদনার অলিন্দযুদ্ধে। তিরিশ বছর আগে যাকে সুন্দরী বলতে পারতাম। চল্লিশ বছর আগে যাকে বিপ্লবী বলতে পারতাম। পঁচিশ বছর আগে যার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম। আজো কি বুকের ভেতর সেই ভালোবাসাসমেত দাঁড়াতে পারব? একাত্তর থেকে একুশ প্রকৃতির

খেয়াল এ-সময়ে এখানে আছি। কত কত মানুষের সঙ্গ অনুভবে এলো। যে-গতিতে পৃথিবী ঘুরছে তারই মধ্যে কত কী না করে চলেছি আমরা।

আজকাল আয়নার ভেতর নিজেকে আর দেখতে পাই না। আজ যাকে দেখি গতকাল সে ছিল না। আজকের আমি আগামীকাল থাকব না। শুধু পাল্টে যায়। শুধু পাল্টে যায়। একটা জুতা ছিল দীর্ঘদিন ব্যবহার করেছি। তারপর রঙ নষ্ট হয়ে গেল। একদিন ছিঁড়ে গেল। ফেলে দিতে হলো। একটা খয়েরি রঙের কর্ডের প্যান্ট ছিল। কিশোরবেলার অনেক কিছুর সাক্ষী। খুবই প্রিয় ছিল। একসময় শরীরের তুলনায় ছোট হলো। বাতিল করে দিলাম। একটা সাদা ফিটকিরির টুকরা। চার বছর আমার সাথে সাথে বিভিন্ন দেশ ঘুরেছে। এমন কোনো সপ্তাহ নেই টুকরোটা আমার গাল স্পর্শ করেনি। একদিন শেষ হয়ে এলো। পুরনো বাড়িতে একটা বড় আয়না ছিল। সেই আয়নার ভেতর জমে আছে আমার শৈশব-কৈশোর-যুব বেলা। প্রথম গোঁফ- দাড়ি উঠেছিল সেই আয়নার ভেতর। আয়নাটা ভেঙে গেছে। এর ভেতরের কিছুই আর ফেরত আসবে না। মোটা বইয়ের পুটে একটা টিকটিকি একবার কয়েকটা ডিম পেরেছিল। কয়েকদিন পর দেখি চিৎ করা একটা টিকটিকির লাশ পিঁপড়েরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। টিকটিকিটাকে অনেকদিন দেখেছি জ্বলন্ত বাল্বের পাশ থেকে মশা ধরে খেতে।

ঘুমের ভেতর এসব ফিরে ফিরে আসে। কাঠের চেয়ার। পড়ার টেবিল। স্কুলের বেঞ্চ। চটের থলি। প্রথম মানিব্যাগ। সময়ের ঝড়ে দ্রুত সব উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে মাতৃভাষা। দোয়াত-কলম, নিউজপ্রিন্ট, মৃত নদী, একতারা, ডুগডুগি। গ্রহ তারা নক্ষত্র সমস্তই এসে ভিড় করে সরু গলির মুখে।

একদিন এখানে আর খবর আসবে না। মৃত্যু নামক একটি খবর পৌঁছে যাবে বাকি পৃথিবীতে। তখনো কেউ চিৎকার করবে। কেউ হাসবে। পাহাড়কে মৌন বলে ব্যঙ্গ করবে। পেঙ্গুইন দল পরস্পর করমর্দন করবে। পিঠে পিঠ রেখে ফটোগ্রাফি করবে কেউ কেউ। অন্য কোনো পঞ্চাশের গল্প লিখবে অন্য কেউ।

লেখক পরিচিতিঅপু শহীদ

নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। থিয়েটারের সাথে যুক্ত চার দশক। এথিক নাট্যদলের সাধারণ সম্পাদক।

এখনো স্বপ্ন দেখেন কপর্দকশূন্য ভবঘুরে হওয়ার। প্রকাশিত গ্রন্থ ছয়টি। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক এসব নিয়েই লেখালেখির জগৎ।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024